ব্লু ইকোনমি তৈরিতে বিরাট ভূমিকা গ্রহন করতে চলেছে ভারতবর্ষ
রাজেশ রায়:— আমেরিকার এক বিখ্যাত নেভাল অফিসার ও ঐতিহাসিক বিদ হচ্ছেন আলফ্রেড থায়ার মাহান, ওনাকে উনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান স্ট্রাটেজিস্ট বলা হত। তিনি ব্রিটেনের উদাহারন দিয়ে বলেছিলেন বিশ্বে শক্তিশালী হতে গেলে প্রথমে নেভিকে শক্তিশালী করতে হবে। ওনার বক্তব্য ছিল সমুদ্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের সময় সমুদ্রের নিয়ন্ত্রন এবং শান্তির সময়ে সমুদ্রে বানিজ্য দরকার। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই সমুদ্র ও মহাসাগর মানুষের জন্য খুবই উপযোগী সিদ্ধ হয়েছে তা সে বানিজ্যিক ক্ষেত্রেই হোক কিংব স্ট্রাটেজিক বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যই হোক কিংবা যুদ্ধের কারনেই হোক। আজও অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি সমুদ্র। যার জন্য একে ব্লু ইকোনমি বলা হয়। এর থেকেই তৈরি হয়েছে ব্লু ডিপ্লোম্যাসি যার লক্ষ সামুদ্রিক নিরাপত্তা বজায় রাখার পাশাপাশি সামুদ্রিক সম্পদের সঠিক বন্টন। এর জন্য নেভাল বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, কুটনৈতিক গন ও ব্যাবসায়ীদের মধ্যে একটি পারস্পরিক জোট দরকার।
ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রে ব্লু ইকোনমি ও ব্লু ডিপ্লোম্যাসি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এমন একটি দেশ যার তিনদিকে রয়েছে সমুদ্র। ভারতের রয়েছে ৭৫০০ কিলোমিটার লম্বা বিশাল উপকূল ভাগ যা নয়টি রাজ্য জুড়ে আছে এবং রয়েছে ১৩৮২ টি দ্বীপ। ভারতের উপকূল ভাগের প্রায় ৪০ লাখ মানুষের জীবন এই সমুদ্রের উপরই নির্ভরশীল। তাই প্রাকৃতিক ভাবেই ভারতের সামুদ্রিক সম্পদ ও তার বিশাল সমুদ্র ভাগের নিরাপত্তা ভারতের জাতীয় ইস্যু। ভারত অনেকরকম ভাবে ব্লু ইকোনমি কে সমর্থন করে আসছে যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইওআরএ বা ইন্ডিয়ান ওশেন রিম অ্যাসোসিয়েশন। এছাড়া ২০১৫ তে শুরু হওয়া সাগরমালা প্রজেক্টের মাধ্যমে ভারত তাদের উপকূল ভাগ গুলোকে যুক্ত করতে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা ভারত অনেকদিন সমুদ্রকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি যতটা তার ভূভাগ কে দিয়েছে৷ আজ সমুদ্রের গুরুত্ব কে অস্বীকার করা সম্ভব নয় তা সে আন্তর্জাতিক বানিজ্য হোক কিংবা এনার্জি সরবরাহ কিংবা মাছ ও সামুদ্রিক সম্পদ। এই কারনে ভারত মহাসাগর অঞ্চল আজ জিও পলিটিক্যাল হটস্পট। ভারত কী করে ব্লু ইকোনমি শক্তিশালী করার মাধ্যমে ব্লু ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে স্ট্রাটেজিক সুবিধা পাবে? এবং কী করে ভারত এর মাধ্যমে তার নেবারহুড ফাস্ট পলিসি তে গতি আনবে?
ব্লু ইকোনমি কে ছাড়া ব্লু ডিপ্লোম্যাসি হতে পারে না। সোজা কথায় বললে ব্লু ইকোনমি সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের ব্যবহার ও তার সংরক্ষন কে বোঝায়। বিশ্ব ব্যাঙ্কের বক্তব্য অনুযায়ী সামুদ্রিক সম্পদের সঠিক বন্টনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয় এবং সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। বেলজিয়ামের ব্যাবসায়ী ও অর্থনীতিবিদ গুন্টার পাওলি তার ব্লু ইকোনমি বইয়ে লিখেছেন সমুদ্র কে উপযুক্ত উপায়ে ব্যবহার করে অনেক নতুন নতুব ব্যাবসা তৈরি করা সম্ভব যা একটি সমুদ্র নির্ভর মজবুত ব্যাবসায়িক মডেল তৈরি করে। তিনি বলেন ব্লু ইকোনমির মাধ্যমে সমাজ আরও বেশী অর্থনৈতিক ভাবে মজবুত হবে। তবে সামুদ্রিক সম্পদ উত্তলনে অনেক সমস্যা রয়েছে যেমন দক্ষিন চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী নীতি এবং হর্ন অফ আফ্রিকা তে সোমালিয়ার জলদস্যুদের ঝামেলা রয়েছে। এই জন্যই ব্লু ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে এই সব ঝামেলা এড়িয়ে সামুদ্রিক সম্পদের সঠিক ব্যাবহার করে জীবনের মান কে উন্নত করা যেতে পারে।
ওয়ার্ল্ড লিডার, বৈজ্ঞানিক সংস্থা, সাধারব মানুষ এবং বেসরকারি ব্যাবসায়ীরা হচ্ছে সমুদ্র নির্ভর অর্থনৈতিক মডেলের প্রধান অংশ। ১৯৮০ থেকেই জাতিসংঘের সমুদ্র নিয়ে নির্দিষ্ট আইন আছে। তবে ২০১২ সালে জাতিসংঘের কনফারেন্স রিও+ ২০ সামিটে দ্বীপপুঞ্জ বিশিষ্ট দেশ গুলো তাদের অস্তিত্বের জন্য ব্লু ইকোনমি গ্রহনের কথা বলেছে। ১৯৯৭ সালে তৈরি হয় ইন্ডিয়ান ওশেন রিম অ্যাসোসিয়েশন যাতে ভারত মহাসাগরে সীমান্ত থাকা ২৩ টি দেশ যুক্ত আছে, এই এলাকায় ব্লু ইকোনমির জন্য এই সংস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। ঠিক এই জন্যই ভারত সাগরমালা প্রজেক্ট শুরু করেছে যার লক্ষ ভারতের সুদীর্ঘ উপকূল ভাগ বরাবর বন্দর গুলির উন্নয়ন, আধুনীকরন ও সংযুক্তি এবং উপকূল ভাগের মানুষের বিকাশ ঘটানো। ভারত স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত মহাসাগর অঞ্চল ভারতের কুটনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এই এলাকায় ইন্ডিয়া ইউএন অ্যাডোক কমিটি খুব সক্রিয় ছিল কারন এর লক্ষ ছিল বিশ্বের সুপার পাওয়ারদের মধ্যে ঝামেলা থেকে ভারত মহাসাগরকে রক্ষা করা। পাকিস্তান ও চীনের সাথে সীমান্ত নিয়ে ঝামেলার জন্য ভারত অনেকবারই সমুদ্র ততটা গুরুত্ব দেয় নি কিন্তু তা সত্বেও ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব বেড়েই গেছে। যার অন্যতম কারন হচ্ছে ভারত মহাসাগর জাপান ও চীনের গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য কেন্দ্র, মধ্য প্রাচ্যে ও ইউরোপের মধ্যে এনার্জি সরবরাহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ।
আফ্রিকার বানিজ্যিের জন্যও এটি এজটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। বর্তমানে বিশ্বে সমুদ্র নির্ভর ক্রুড অয়েল ট্রান্সপোর্টের দুই তৃতীয়া অংশ, বিশ্বের মোট সামুদ্রিক বানিজ্যের তিন ভাগের এক ভাগ এখান দিয়েই যায়। স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জলদস্যু ও জিও পলিটিক্যাল ঝামেলা। এর জন্যই ভারত এই এলাকার দেশ গুলের সাথে কুটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। মরিশাস, মালদ্বীপ, সেশেলস ও সিঙ্গাপুরের মতন ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র গুলোর সাথেও সম্পর্কের উন্নয়ন ভারতের বিদেশনীতিরই একটি অঙ্গ। শুধু শক্তিশালী নেভিই নয় বরং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উদ্ধার কার্যেও ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ভারত তার সফ্ট পাওয়ারের সাথে হার্ড পাওয়ারের সমতা বজায় রেখেছে। ভারত বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের নেভাল বেসও ব্যবহার করছে যেমন ইন্দোনেশিয়ার সাবাং বন্দর, ওমানের ডুকাম বন্দর, দিয়াগো গার্সিয়া তে আমেরিকার বেস এবং রিইউনিয়ন দ্বীপে ফ্রান্সের বেস উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইরানের চাবাহার বন্দরে ভারতের বিনিয়োগ রয়েছে, সাথে সাথে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মরিশাসের বন্দর ব্যাবহারের চেষ্টা করছে ভারত। ভারতের নেভাল অ্যাক্টিভিটি দেখে মনে হচ্ছে ভারতের পাঁচটি লক্ষ রয়েছে:– ১) বানিজ্যিক জাহাজ পরিবহনে নিরাপত্তা প্রদান ২) ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক সম্পদের সঠিক ব্যাবহার ৩) উদ্ধার কার্য ৪) টেরিরিজম, স্মাগলিং সহ জল দস্যুদের প্রতিরোধ। ৫) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দেশের মধ্যে সামুদ্রিক প্রতিযোগিতা টই এলাকায় নিয়ন্ত্রণে রাখা।
ব্লু ইকোনমি মজবুত করার লক্ষ্যে ভারত কীছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইন্ডিয়ান ওশেন রিম অ্যাসোসিয়েশন বা আইওআরএ। ২৩ টি দেশের এই সংস্থার ২১০৪ সালে ১৪ তম সভায় ব্লু ইকোনমির উপর জোর দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার, অ্যাকাডেমিক, ব্যাবসায়ীরা এই প্রজেক্ট কে সমর্থন করছে। ২০১৪ থেকে ২০২০ তে হওয়া জাকার্তা সম্মেলনে ব্লু ইকোনমির ব্যাপারে কথা হয়৷ ভারত আসিয়ান দেশ গুলোর সাথে ইতিমধ্যেই ব্লু ইকোনমির জন্য চারটি ওয়ার্কশপ করেছে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সাথেও এব্যাপারে কথা হচ্ছে। সাগরমালা প্রজেক্টের ব্যাপারে আগেই বলেছি। এই প্রজেক্টে ভারতের বন্দর গুলোর ধারন ক্ষমতা অন্তত ৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ তে যেখানে বন্দর গুলোর ধারন ক্ষমতা ছিল ৮৭১.৫ মেট্রিক টন তা এখন বেড়ে হয়েছে ১৫৬১ মেট্রিক টন।
আন্তর্জাতিক ভাবেও সাগরমালা প্রজেক্টের প্রমোশন করা হচ্ছে। এবছর ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেনের মতন নর্ডিক দেশ গুলির সংস্থাকে এখানে বিনিয়োগের জন্য বলা হয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং নর্ডিক দেশ গুলির প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে ব্লু ইকোনমি শক্তিশালী করবার জন্য বিশেষ বৈঠক হয়েছে। ২০১৫ তে ভারত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট শুরু করে যার নাম সাগর বা সিকিউরিটি এন্ড গ্রোথ ফর অল। এই প্রজেক্টে ভারত ভারত মহাসাগর এলাকা ভুক্ত নয় এমন দেশ গুলোর সাথেও কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলাট পাশাপাশি তাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রান দিচ্ছে, উদ্ধার কার্যে সহয়তা এবং জলদস্যুদেট দমন করার প্রশিক্ষন দিচ্ছে। সাগর প্রজেক্টের আওতায় ২০১৯ সালে ভারত সরকার লঞ্চ করে ইন্দো প্যাসিফিক ওশেন ইনিশিয়েটিভ বা আইপিওআই। এতে বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্ব বিভিন্ন দেশকে দেওয়া হয়েছে যেমন সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা ভারতের দায়িত্ব, সামুদ্রিক সম্পদের দায়িত্বে আছে ফ্রান্স ও ইন্দোনেশিয়া, সামুদ্রিক ইকোলজি রক্ষার দায়িত্ব অস্ট্রেলিয়ার উপর এবং বানিজ্য, যোগাযোগ এবং পরিবহনের দায়িত্ব জাপানকে দেওয়া হয়েছে। এবছর ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের প্যারিসে ব্লু ইকোনমির উপর ভারত ফ্রান্সের রূপরেখা সম্পর্কে ঘোষনা করা হয়। যাতে উভয় দেশ তাদের সামুদ্রিক ডেটা অ্যানালিসিস একে উভয়ের সাথে শেয়ার করবে। এর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক বানিজ্য, নেভাল ইন্ডাস্ট্রি, মাছ, সামুদ্রিক টেকনোলজি ও রিসার্চ, ভ্রমন সবকীছু। ভারতের ব্লু ইকোনমি ও ব্লু ডিপ্লোম্যাসির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় চীন। চীন ১৫০ বিলিয়ন ডলারের মেগা প্রজেক্ট বিআরআই শুরু করেছে যা সম্পন্ন হলে বিশ্বে চীনের প্রভাব বাড়বে। তাছাড়া চীন ভারত মহাসাগরেও তাদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে, ভারতকে এটাও কাউন্টার করতে হবে। তবে ভারত যত তাড়াতাড়ি তার ব্লু ইকোনমি মজবুত করবে তত তাড়াতাড়ি ভারতের অর্থনীতি ৫ ট্রিলিয়ন ডলার হবে।