জলের তলায় টারবাইন সিস্টেম আগামী দিনের এক নতুন শক্তির উৎস। জলবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ও সৌর বিদ্যুৎ থাকতে কেন এই আন্ডার সিস্টেমের দরকার পড়ল?
আমেরিকাতে এমন এক টেকনোলজির উপর কাজ হচ্ছে যা সফল হলে বিশ্বে অপ্রচলিত শক্তির উৎস সম্পর্কে ধারনাই বদলে যাবে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি হোক বা যেকোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনই হোক, বর্তমানে অপ্রচলিত শক্তি উৎসের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে মানে এমন শক্তি উৎস যার থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করলে পরিবেশের কোন ক্ষতি হবে না। আর এধরণের এমনই এক শক্তি হচ্ছে আন্ডার ওয়াটার টারবাইন। সমুদ্রের তলায় বা নদীর তলায় এধরনের টারবাইন বসিয়ে শক্তি উৎপন্ন করা নিয়েই আমেরিকাতে গবেষণা চলছে। আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি এই বিষয়ে গবেষণা করছে যে কীভাবে সমুদ্রের তলায় টারবাইনের মাধ্যমে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। ইতিমধ্যেই অপ্রচলিত শক্তি উৎস হিসাবে জলবিদ্যুৎ রয়েছে যেখানে নদীকে কৃত্রিম ভাবে কোন জায়গায় ধরে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, বায়ু বিদ্যুৎ এবং সৌর বিদ্যুৎ। কিন্তু এসব শক্তি উৎসেরই কিছু কিছু সমস্যা আছে যার জন্য একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অপ্রচলিত শক্তি উৎস দরকার। আন্ডার ওয়াটার টারবাইন পদ্ধতিতে সমুদ্র বা নদীর তলদেশে তিন ব্লেডের টারবাইনকে বসানো হবে। জলের তলদেশে হবার কারনে সর্বক্ষন জলের প্রবাহ থাকবে এখানে বলে জলের গতিশক্তিতে টারবাইনের ব্লেড ২৪ ঘন্টা ঘুরবে এবং ফলে ডায়নামো ঘুরে সহজেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।
আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি এটাই গবেষণা করছে যে টারবাইন থেকে কতটা শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। ভূগোলে ওশিয়ান কারেন্ট বলে একটা বিষয় আছে যার অর্থ সমুদ্রের জলের তীব্র শক্তিতে যে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফোর্স উৎপন্ন হয় যাকে কাজে লাগিয়ে এই টারবাইন সর্বক্ষন ঘোরানো সম্ভব। এই ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান লক্ষ কার্বনের ব্যবহার কমানো এবং জৈব জ্বালানীর উপর নির্ভরতা কমানো। গত কয়েকমাস ধরেই ভারতে কয়লা সংকট চলছে। যার কারনে ভারতের বড় বড় শহরে রীতিমতো হাহাকার শুরু হয়ে যায়। প্রায় ১৭ ঘন্টা করে বিদ্যুৎ থাকছিল না, বহু ট্রেন বাতিল করা হয়েছিল। কারন ভারতের বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন সিংহভাগ-ই কয়লার উপর নির্ভরশীল। এই কয়লা সংকটের প্রধান কারন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে পর্যাপ্ত কয়লা সরবরাহ না আসা এবং গত বছর ভারতের কয়লাখনি অঞ্চল এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে কয়লা খনিতে ধ্বস নামা। সেজন্য ভারতের মত বিশাল দেশের জন্য বিকল্প শক্তি উৎস দরকারই। ভারতে প্রাকৃতিক ভাবে নদী প্রচুর আছে এবং বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরের মত বিশাল সমুদ্র সীমা আছে, সুতরাং আন্ডার ওয়াটার টারবাইন টেকনোলজি ভারতের জন্য আদর্শ হবে একদমই এবং এই সেক্টর একদম নতুন। কিন্তু এই পদ্ধতি শুনতে যতটা সহজ লাগছে এর প্রয়োগ কিন্তু যথেষ্ট জটিল। সমুদ্রের নীচে যে হাইড্রো কাইনেটিক টারবাইন লাগানো হবে সেগুলোর খরচ অত্যন্ত বেশী এবং জলের তলদেশে এধরনের ইনফ্রাস্ট্রাকচার করা অত্যন্ত জটিল। যার জন্য এখনও সার্বিক ভাবে এই পদ্ধতির ব্যবহার এখনও শুরু হয়নি।
আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি প্রথমে এই প্রজেক্টে পরীক্ষা করে দেখছে কতটা শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব। আমেরিকা ১১ টি এমন প্রজেক্ট শুরু করেছে যাতে ৩৮ মিলিয়ন ডলার ফান্ডিং করা হয়েছে। এই প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয়েছে সার্কস বা সাবমেরিন হাইড্রোকাইনেটিক এন্ড রিভারাইন কিলো মেগাওয়াট সিস্টেম। এই টারবাইন জমিতে থাকা সাধারন টারবাইনের থেকে আলাদা হয়। জমিতে সাধারন টারবাইন ঘোরাতে বাইরে থেকে তীব্র গতিতে জল বা বাষ্প শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, তবেই ডায়নামো ঘুরে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। কিন্তু আন্ডার ওয়াটার টারবাইনে সবসময় জলের প্রবাহ বজায় থাকে। জমিতে থাকা সাধারন টারবাইন যেকোন এক দিকে ঘোরে যেমন যদি ঘড়ির কাটার দিকে ঘোরে টারবাইন তাহলে ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে টারবাইন ঘোরালে শক্তি উৎপন্ন হবে না কিন্তু হাইড্রোকাইনেটিক টারবাইন বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয় যাতে টারবাইনের সামনে এবং পেছনে দুদিক দিয়েই জলের প্রবাহ এলে টারবাইন ঘুরে শক্তি উৎপন্ন হয়। সমুদ্রের নীচে যে তীব্র ঢেউ থাকে যাকো টাইডাল ওয়েভ বলা হয় এই টারবাইন সেই ওয়েভের ধাক্কাও সামলাতে সক্ষম হবে। এবার মনে হতে পারে জলবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ও সৌর বিদ্যুৎ থাকতে এই আন্ডার ওয়াটার টারবাইন সিস্টেমের দরকার কেন পড়ল?
জলবিদ্যুৎ বা হাইড্রো ইলেকট্রিসিটিতে প্রধান সমস্যা হচ্ছে এটি তৈরি করা হয় কোন নদীর ধারাকে ধরে রেখে রিজার্ভার তৈরির মাধ্যমে। উচু হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে ভারতের বেশীরভাগ নদী উৎপন্ন হয়েছে সেখানে এই ধরনের ড্যাম তৈরির ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়, সাথে সাথে স্থানীয় মানুষকে অনেক সময় অন্যত্র নতুন করে বসতি স্থাপন করতে হয়। বায়ু বিদ্যুৎ পদ্ধতিতেও টারবাইন ব্যবহার করা হয় এবং বায়ু প্রবাহ হলে টারবাইন ঘোরে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এটি পুরোপুরি বায়ুর উপর নির্ভরশীল। সঠিক গতিতে বায়ুপ্রবাহ না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা হয়। এবার বাকী রইল সৌরবিদ্যুত। এই পদ্ধতি পুরোপুরি সূর্যের উপর নির্ভরশীল। মেঘলা আকাশ বা রাতে এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই তিন পদ্ধতির কোনটির উপরই ১০০ শতাংশ নির্ভরতা সম্ভব নয়। কিন্তু আন্ডার ওয়াটার টারবাইন সিস্টেমে জলের তলায় সর্বদা জল প্রবাহ রয়েছে, একটি উচ্চ গতিশক্তি সবসময় পাওয়া সম্ভব। ভূগোলের ওশিয়ান কারেন্ট চ্যাপ্টারে একটি কথা বলা হয়েছে যে পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিন হেমিস্ফিয়ার অঞ্চলের জলভাগে সবসময় একটি প্রবাহ লক্ষ করা যায় যা নির্ভর করে দুটি জিনিসের উপর বায়ু ও করিয়োলিস ফোর্সের উপর।
করিয়োলিস ফোর্স একটি কাল্পনিক বল, পৃথিবী যেহেতু আবর্তন করে তাই এই বলের কথা বলা হয়। এই করিয়োলিস ফোর্স অনুযায়ী উত্তর হেমিস্ফিয়ারের দিকে আসা জল বা বায়ু তার ডানদিকে বেঁকে যায় এবং পুরো একটি এলাকা জুড়ে গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। কারন পৃথিবী আবর্তন করে, একে করিয়োলিস এফেক্ট বলে। উত্তর হেমিস্ফিয়ার অঞ্চলে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এবং উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরেরর অনেক জায়গায় এরকম জল প্রবাহ রয়েছে। করিয়োলিস ফোর্স অনুযায়ী দক্ষিন হেমিস্ফিয়ার এলাকায় জল বা বায়ু বাম দিকে বেকে গিয়ে নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। এই সব নির্দিষ্ট অঞ্চলে জল প্রবাহের গতি অনেক বেশী থাকে যার জন্য এখানে আন্ডার ওয়াটার টারবাইনের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। আমেরিকাতে এই বিষয়েই গবেষণা চলছে যদি এই প্রজেক্ট সফল হয় ফসিল ফুয়েলের বিপীরতে অপ্রচলিত শক্তি উৎসের ক্ষেত্রে এক নতুন দিক খুলে যাবে।