আর্টিকেল ৩৭০ তুলে দেবার তিন বছর পর জম্মু কাশ্মীরের ছবি কতটা পাল্টেছে? এই আইন তুলে দেবার যৌক্তিকতা কতোটা?
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয় কিন্তু এরপরেও এমন তিনটি প্রদেশ ছিল যারা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে গেছিল কিন্তু তারা ভারত ও পাকিস্তান কোন পক্ষেই যোগ দেয় নি। এই তিনটি প্রদেশ হচ্ছে জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ এবং জম্মু ও কাশ্মীর। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রদেশ ও আলোচ্য প্রদেশ হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীর। ভারত স্বাধীন হবার পর থেকেই কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অনেক বার যুদ্ধ হয়েছে। কিন্ত গত কয়েক বছরে কাশ্মীরে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে যার জন্য কাশ্মীর শুধু ভারতেই নয় বরং বিদেশেও চর্চার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। ৯ আগস্ট, ২০১৯ সালে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি জম্মু ও কাশ্মীরের আর্টিকেল ৩৭০ তুলে দেয়, ফলে ৬৫ বছর চলা জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা উঠে যায়।
এই বছরই জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে দুটি আলাদা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয় লাদাখ এবং জম্মু কাশ্মীর। লাদাখকে আলাদা করবার কথা বহুদিন ধরেই চলছিল। তবে জম্মু কাশ্মীরে দিল্লি ও পন্ডিচেরীর মত সংসদ তৈরি করা হয় যেখানে স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারবে। তখন তো অনেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন করেছিল এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আবার অনেকে সমালোচনাও করেছিল। তবে আজ তিনবছর পর এটা স্পষ্ট যে এই পদক্ষেপ কতটা দরকারী ছিল। আজ জম্মু কাশ্মীরের উন্নতির পাশাপাশি এখানের মানুষের সাথে ভারতের বাকী অংশের মানুষের সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে। এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
জম্মু কাশ্মীর কিন্তু ভারতে পিছিয়ে পড়া রাজ্য গুলোর মধ্যে পড়ে না। এখানে সামাজিক ও স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা যথেষ্ট উন্নত। ২০১৭ সালে জম্মু কাশ্মীরের ইনফ্যান্ট মরটালিটি রেট ছিল ২৩, যেখানে বাকী ভারতের গড় ৩৩ এবং শুধু মধ্য প্রদেশেরই ৪৭. প্রতি হাজার জন মানুষের মধ্যে একবছরে কতজন মারা যায় তাকেই ইনফ্যান্ট মরটালিটি বলে। তাহলে বুঝতেই পারছেন জম্মু কাশ্মীরে স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা ভালই। ভারতের বাকী রাজ্য গুলোতে মানুষের গড় জীবনকাল ৬৮.৭ বছর কিন্ত জম্মু কাশ্মীরে গড় হচ্ছে ৭৩.৭ বছর। জম্মু কাশ্মীরে ভারতের বাকী রাজ্য গুলোর তুলনায় লিঙ্গ অনুপাতে বা ছেলের বিপরীতে মেয়ে ৯১৭, যেখানে বাকী ভারতে এটা ৮৯৬, যদি অর্থনীতির কথা বলা হয় তাহলে ২০১৭ সালে জম্মু কাশ্মীরে পার ক্যাপিটা স্টেট জিডিপি ১.০২ লাখ, যা ভারতের ১.১৭ লাখের আশেপাশে, যেখানে বিহারের ৪০,৮৩২ এবং উত্তর প্রদেশের ৫৭,০২৪। ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী জম্মু কাশ্মীরে দারিদ্রতার অনুপাত ১০.৪ শতাংশ ছিল যখন বাকী ভারতের দারিদ্রতার অনুপাত ছিল ২১.৯ শতাংশ। এসব হিসাব দেখে হয়ত মনে হবে জম্মু কাশ্মীর ভারতের বাকী রাজ্য গুলোর থেকে অনেক উন্নত কিন্তু বাস্তব পুরো ভিন্ন। দশকের পর দশক ধরে এখানে চলা উগ্রবাদী কাজকর্মের জন্য এখানের মানুষের মনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে।
২০১৫ সালে ডক্টরস উইথআউট বর্ডার নামে একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর করা সমীক্ষায় দেখা গেছে জঙ্গিবাদী কার্যকলাপের জন্য কাশ্মীরের ৪৫ শতাংশ লোকের মনে একধরনের ট্রমার সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন কাশ্মীরি পিটিএসডি বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভুগছে। ভারত সরকারের করা মেন্টাল হেলথ সমীক্ষায় ভারতের ৮.৩ শতাংশ লোক মানসিক অবসাদে ভুগছে, সেখানে কাশ্মীরে ৪৫ শতাংশ। এই তথ্য রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দেবার মতন। যেখানে একদিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো কাশ্মীরের ভাল সেখানে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা মানসিক অবসাদে ভোগে যার কারনে জঙ্গিদের ফাঁদে পা দিয়ে এখানকার সাধারন মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। ২০১১ সালের জনগননা অনুযায়ী গোটা ভারতে তরুন জনসংখ্যা বিশেষ করে চোদ্দ বছর বয়সীদের অনুপাত ৩১ শতাংশ কিন্তু কাশ্মীরে এই অনুপাত ৩৪ শতাংশ। সুতরাং এই বিপুল তরুন প্রজন্ম যাতে ভুল পথে চালিত না হয় তার জন্য আর্টিকেল ৩৭০ তুলে দেওয়া হয়েছে কাশ্মীর থেকে। আর্টিকেল ৩৭০ অনুযায়ী জম্মু কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল যাতে জম্মু কাশ্মীরে বাকী ভারতের থেকে আলাদা একটি নিজস্ব সংবিধান ছিল। কোন একটি দেশের একটি প্রদেশে যদি বাকী দেশের থেকে আলাদা সংবিধান, আইন থাকে তাহলে সেখানে বিচ্ছিন্নবাদীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর আগে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের জন্য যদি কোন নতুন প্রকল্প ঘোষনা করত তখন তা কাশ্মীরের বিধানসভায় আগে পাশ করাতে হত, অনেক সময় রাজনৈতিক কারনে এসব প্রকল্প পাশ হত না ফলে স্থানীয় কাশ্মীরিরা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হত। কিন্তু এখন আর্টিকেল ৩৭০ তুলে নিয়ে কাশ্মীরকে ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করা হয়েছে যাতে কাশ্মীরিরা বাকী ভারতীয়দের মতো একই সংবিধান ও আইনের সুবিধা পায়।
২০০৫ সালে ভারতে শুরু হওয়া রাইট টু ইনফর্মেশন এবং ২০০৯ সালে শুরু হওয়া রাইট টু এডুকেশন থেকে এতদিন বঞ্চিত ছিল কাশ্মীরিরা। ২০০৬ সাল ও ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া সিডুল কাস্ট ও সিডুল ট্রাইব সংরক্ষন থেকে এতদিন বঞ্চিত ছিল কাশ্মীরের বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায় গুজ্জার, বাকারওয়ালস, গাদিসের মত সম্প্রদায়। এখন কাশ্মীরের মানুষও ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী মৌলিক অধিকারের সুবিধা পাচ্ছে। বর্তমানে জম্মু কাশ্মীরে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতোই পঞ্চায়েত নির্বাচন, ব্লক ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল ও জেলা কাউন্সিল নির্বাচন করা হচ্ছে যাতে এখানে গনতন্ত্রের ভিত আরও মজবুত হয়েছে। তবে শুধু আর্টিকেল ৩৭০ এর দ্বারাই নয়, আর্টিকেল ৩৫ এও কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছে। ১৯৫৪ সালে এই বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় যাতে এখানকার স্থানীয় প্রশাসনকে অধিকার দেওয়া হয় কারা এখানাকার স্থায়ী বাসিন্দা হবে তা নির্বাচন করার। আর্টিকেল ৩৭০ এর কারনে কাশ্মীরে বাকী ভারতীয়দের জায়গা কেনার ব্যাবসা করার অধিকার ছিল না যার কারনে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়েছিল কাশ্মীর। এখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার জন্য বিনিয়োগই আসেনি। কাশ্মীরের পার ক্যাপিটা জিডিপি মোটামুটি ভালই কিন্তু বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে উপার্জনের পার্থক্য প্রচুর। কাশ্মীরের ৭৩ শতাংশ জনসংখ্যা গ্রাম্য অঞ্চলে থাকে যেখানে উপার্জনের হার খুবই কম ফলে বেকারত্ব প্রচুর। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরে আতঙ্কবাদীরা কাজ করেছে। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরে প্রচুর বিনিয়োগ করছে যার কারনে স্থানীয় মানুষ তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বুঝতে পারছে।
জম্মু কাশ্মীর সরকার ২০২১ সালে ২৮,৪০০ কোটি টকার উন্নয়ন প্যাকেজ ঘোষনা করেছে যা ২০৩৭ পর্যন্ত চলবে। জম্মু কাশ্মীরে প্রাইভেট সেক্টর সংস্থা ও জমির জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষনা করা হয়েছে। ২০২২ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে জম্মু কাশ্মীরের তরুন প্রজন্মের সাহায্যের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। মার্চ, ২০২২ এ জম্মু কাশ্মীরে শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য ৪২২৬ টি প্রোপোজাল এসেছে যার মোট ভ্যালু ৪৭,৪৪১ কোটি টাকা। এতে গোটা উপত্যকা জুড়ে ২.৩ লাখ চাকরী তৈরি হবে যাতে তরুন প্রজন্ম কাজ করবার সুযোগ পাবে। বিদেশ থেকেও কাশ্মীরে বিনিয়োগের জন্য চেষ্টা করছে ভারত সরকার সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে ৩৬ সদস্যের একটি দল কাশ্মীর ঘাঁটিতে পরিদর্শনে এসেছিল। ২০২৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত হওয়া জি-২০ সম্মেলন কাশ্মীরেই অনুষ্ঠিত হবে যাতে আন্তর্জাতিক স্তরে কাশ্মীরে বিনিয়োগ হবার সম্ভবনা বাড়বে। একটা সময় ভারতের স্বর্গ কাশ্মীরে পর্যটকদের ঢল নামত কিন্তু কয়েক দশক ধরে জঙ্গিবাদী কার্যকলাপের ফলে এখানের পরিস্থিতি বদলে যায়। কিন্তু আর্টিকেল ৩৭০ তুলে দেবার পর এবং কাশ্মীরের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরাসরি ভারত সরকার গ্রহন করার পর এখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আশা করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে এখানে আবারও পর্যটকদের ঢল নামবে। কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা যেমন কেশর, আপেল ও কালিমের প্রচারের জন্য ভারত সরকার বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। কাশ্মীরে আরও উন্নত স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার জন্য ২০২০ সালে জম্মুতে এবং ২০২২ সালে কাশ্মীরের অবন্তিপুরাতে এইমস তৈরি করেছে ভারত সরকার। ২০২২ এর ১৫ আগস্টের মধ্যে পুরো কাশ্মীর জুড়ে ১০০ শতাংশ বাড়িতে নিশুল্ক পানীয় জলের ব্যবস্থা করছে ভারত সরকার। এছাড়া গোটা কাশ্মীর জুড়ে প্রচুর ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কাজ চলছে যাতে অনেক রাস্তা তৈরি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনাতে যেখানে ২০১৬-১৭ তে কাশ্মীর নবম স্থানে ছিল সেখানে ২০২১ এ কাশ্মীর তৃতীয় স্থানে চলে আসে।
এটা তো গেল জম্মু কাশ্মীরের কথা, এবার লাদাখের কথায় আসা যাক। যখন আর্টিকেল ৩৭০ তুলে নেওয়া হয় সবাই জম্মু কাশ্মীরের কথাই ভাবছিল কিন্তু লাদাখও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। লাদাখকে ল্যান্ড অফ পাসেস বলা হয়। স্থানীয় ভাষায় লা মানে পাস এবং দাখ মানে ল্যান্ড। চীন ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী এই জায়গা স্ট্রটেজিক্যালি ও পর্যটনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জম্মু কাশ্মীরের বাকী অংশের থেকে লাদাখের সংস্কৃতি পুরো আলাদা। যার জন্য কয়েক দশক ধরে লাদাখকে জম্মু কাশ্মীর থেকে আলাদা করার কথা চলছিল। বলা হচ্ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ফান্ডিং এর বেশীরভাগই জম্মু কাশ্মীরে খরচা করা হত এবং লাদাখ বঞ্চিত থাকত সেজন্য এখানে যতটা দরকার ততটা উন্নয়ন হয়নি। এই জন্য কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত প্রদেশ ঘোষনা করে এখানে অনেক প্রজেক্ট শুরু করেছে। লাদাখকে ন্যাশনাল পাওয়ার গ্রিডের সাথে যুক্ত করা হয়েছে যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় থাকে এবং পরিবেশের জন্য ঘাতক ডিজেল জেনারেটরের ব্যবহার কমে। লাদাখের রিমোট গ্রাম গুলোতে অপটিক্যাল ফাইবার বসানো হচ্ছে যাতে ইন্টারনেটে গতি আসে। লাদাখে প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছে যাতে ১০,০০০ ছাত্র ছাত্রী পড়তে পারবে এবং এখানে বৌদ্ধ শিক্ষাও যুক্ত করা হয়েছে। লাদাখে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন ঔষধ আমাচি তিবেটিয়ান ওষুধের ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর জন্য লে তে দি ন্যাশনাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট ফর সোয়া রিগপা তৈরি করা হয়েছে যাতে প্রাচীন ঔষুধ সম্পর্কে গবেষণা করা হবে। লাদাখকে ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ শিডিউলে যুক্ত করবার কথা বলা হচ্ছে যাতে আসাম, মেঘালয়ের মত ৭৫ শতাংশ উপজাতি অধিষ্যুত লাদখের মানুষ নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে উন্নয়ন ঘটাতে পারে। সুতরাং আর্টিকেল ৩৭০ যা কাশ্মীরের জন্য এক অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছিল তা হটানোর পর ধীরে ধীরে কাশ্মীর ভারতের মূল স্রোতে মিশে যাবে।