ডিফেন্স

মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বিরুদ্ধে নতুন জোট তৈরিতে নেতৃত্বে দিচ্ছে ভারতবর্ষ

করে তার বন্ধু দেশের উপর। বন্ধু মানে খুবই ভালো সম্পর্ক, এবার কোন দেশ একটি দেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হবে সেটা কী ভাবে সম্ভব! দেখুন জিও পলিটিক্সে দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হতে পারে দুটি কারনে প্রথমত দুটি দেশের স্বার্থ এক হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত উভয় দেশের শত্রু এক হতে হবে, তহলেই দুই দেশের মধ্যে মজবুত জোট গঠন সম্ভব হবে। আজ আলোচনা করা হবে নতুন কোয়াড সম্পর্কে। কোয়াড শব্দের অর্থ চার অর্থাৎ চারটি দেশের জোট। কোয়াড শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে আমেরিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। তবে নতুন কোয়াডে থাকবে ভারত, আমেরিকা, ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। এবার মনে হতে পারে কোয়াড তো আছেই তাহলে আবার নতুন কোয়াড গঠনের প্রয়োজনীয়তা কী? দেখুন উভয় ক্ষেত্রেই অঞ্চল আলাদা সুতরাং চ্যালেঞ্জ ও আলাদা হবেই। প্রথম কোয়াডের ক্ষেত্রে এলাকা হচ্ছে ইন্দো প্যাসিফিক এবং দ্বিতীয় কোয়াডের ক্ষেত্রে এলাকা হচ্ছে মধ্য প্রাচ্য। কিছুমাস আগে ভারত, ইসরায়েল, আমেরিকা ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বিদেশ মন্ত্রীরা যৌথভাবে একটি বৈঠক করে, সেখানেই ঠিক কোয়াডের মতন আরও একটি জোট গঠন করা হবে। মধ্য প্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনেই এই নতুন জোট গঠন করা হচ্ছে। আজ এই সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

এই নতুন কোয়াডের মূল লক্ষ্য তিনটি ক্ষেত্রে :– ১) আবহাওয়া পরিবর্তন :— বর্তমানে যে কোনও জোট গঠনে প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে আবহওয়া কারন সবারই লক্ষ্য কার্বন মুক্ত বিশ্ব তৈরি করা। ২) স্বাস্থ্য :– করোনা মহামারীর ফলে বিশ্বের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও পুরো ভেঙে পড়ে যার জন্য নতুন রোগের সাথে মোকাবিলায় পরিকাঠামো দরকার। 

৩) মেরিটাইম সিকিউরিটি :– এই অঞ্চলে রয়েছে হরমুজ প্রণালী ও পারস্য উপসাগর যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক কেন্দ্র, তাই এই জলপথ সুরক্ষিত রাখা প্রয়োজন। এই কোয়াড তৈরি করা হচ্ছে মূলত পশ্চিম এশিয়ায় রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অস্থিরতার কারনে। এই পশ্চিম এশিয়াকে আমেরিকা মধ্য প্রাচ্য বা মিডিল ইস্ট বলে কারন আমেরিকার অবস্থান থেকে এটি পূর্ব দিকে অবস্থিত। আবার এই এলাকাকে গল্ফ অঞ্চলও বলা হয়। আগে এই অঞ্চলে শান্তি বজায় ছিল কিন্তুূ বর্তমানে এই এলাকায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন সৌদি আরবকে মুসলিম বিশ্বের লিডার বলা হত কারন জনসংখ্যা ও মক্ক মদিনার কারনে। এখন সৌদি আরবের জায়গা নিচ্ছে তুরস্ক। সৌদি আরবের সাথে কাতার, ইয়ামেনের ঝামেলার কারনে এই অঞ্চলের লোকেরা একটি শক্তিশালী জোট খুঁজছে। বর্তমানে এই এলাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে তা হচ্ছে আব্রাহামিক চুক্তি। ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মধ্যে এই চুক্তি হয়। বাহরিন ও এই চুক্তি করতে রাজি। আব্রাহামিক মানে ইসলাম ও ইহুদী উভয় ধর্মকেই আব্রাহামিক ধর্ম বলা হয় এবং আব্রাহাম ছিলেন একজন মহাপুরুষ। এই চুক্তি অনুযায়ী সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে। আসলে জন্মলগ্ন থেকেই বারবার ইসরায়েলকে আশেপাশের দেশের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কারন আরব দেশ গুলোর দাবি ছিল ফিলিস্তিন নামে একটি দেশের উপর জোর করে ইসরায়েল গঠন করা হয়েছে। তবে বর্তমানে আমেরিকার সহায়তায় আরব দেশগুলো এই অঞ্চলে শান্তির জন্য ইসারায়েলকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তত। এই চুক্তি অনুযায়ী বাহরিন ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ইসরায়েলে তাদের দূতাবাস খুলবে। এবার মনে হতেই পারে দূতাবাস খোলার অর্থ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং ফিলিস্তিনের অধিকার থেকে সরে আসা!! দেখুন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু ও স্থায়ী বন্ধু বলে কিছু হয় না। নিজের দেশের জাতীয় স্বার্থ সবার আগে বিবেচনা করা হয়। এইসব দেশ গুলোর এই চুক্তি করার প্রধান উদ্দেশ্য টুরিজম, বানিজ্য এবং নিরাপত্তা জোরদার করা। ইসরায়েলের ডিফেন্স টেকনোলজি জগত বিখ্যাত এবং আইটি সেক্টরেও ইসরায়েল সেরা। কিছুদিন আগে ইসরায়েলের একটি বিশেষ সফটওয়্যার পেগাসেস কে নিয়ে অনেক কথা উঠেছিল। বলা হয় এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিপক্ষের ফোন সহ সমস্ত ইলেকট্রনিস ডিভাইসে নজর রাখা যায়। তাই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে অর্থনৈতিক ও কারীগরি উভয় ক্ষেত্রেই লাভ হবে দেশ গুলোর। 

মধ্য প্রাচ্যে এই জোট তৈরি ছিল সময়ের দাবী। এর জন্য বেশ কিছু কারন আছে। ১)  তুরস্কের জন্য।  তুরস্ক বেশ কীছু বছর ধরে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের লিডার হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে। সাধারনত সৌদি আরবকেই মুসলিম বিশ্বের প্রধান হিসাবে ধরা হত কিন্তু তুরস্ক ইদানীং বলছে সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার ভাল সম্পর্ক আছে এবং আমেরিকা মুসলিম বিরোধী সেজন্য সৌদি আরবকে বিশ্বাস করা যাবে না। তুরস্ক ভারত বিরোধী কথাও বলে প্রায় সময়ই। আবার তুরস্কের সাথে ইসরায়েল, আমেরিকা ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সমস্যাও আছে। সুতরাং এই সব দেশ গুলোর শত্রু একই দেশ। ২) আমেরিকা ক্রমশ পূর্ব এশিয়াতে সরে আসছে। পূর্ব এশিয়াতে থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপান, ফিলিপিন্স সর্বত্র আমেরিকা তার সেনা মোতায়েন রেখেছে। কারন এই এলাকা বর্তমানে জিও পলিটিক্সের হট স্পট। এখানে রয়েছে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগর। বিশ্বের অধিকাংশ বানিজ্য এই এলাকা দিয়েই হয় কিন্তু বিগত কয়েল বছর ধরে এখানে চীন তার আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। কারন চীন দক্ষিণ চীন সাগর নিজের বলে দাবি করছে। সেজন্য এখানে থাকা বাকী দেশ গুলো ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্সের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। এই সব দেশ গুলোকে নিরাপত্তা দেবার জন্য আমেরিকা এখানে তার নেভি, এয়ারফোর্স, সেনাবাহিনী মোতায়েন রেখেছে। কারন চীনকে কাউন্টার করতে হলে শক্তি প্রদর্শন করতে হবে। এর ফলে কী হয়েছে মধ্য প্রাচ্যে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে কারন আমেরিকা মধ্য প্রাচ্য থেকে তার সেনা ক্রমশ পূর্ব এশিয়াতে সরিয়ে আনছে। আমেরিকার এই মহূর্তে মধ্য প্রাচ্যে তেমন কোন দরকার নেই। এর আগে আমেরিকা মধ্য প্রাচ্যে নিজেকে ব্যাস্ত রাখত কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে আমেরিকা অপ্রচলিত শক্তির উপর জোর দেওয়া শুরু করে যার জন্য আমেরিকা এখান থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে ফলে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে তার সুযোগ নিতে পারে চীন কারন চীন ইতিমধ্যে তার বিআরআই প্রজেক্টের মাধ্যমে মধ্য প্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। 

সুতরাং চীনকে এখানে আটকাতে এই অঞ্চলে একটি জোট গঠন দরকার ছিলই। দুবছর আগেও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট চীনের ব্যাপরে কিছু বলত না। বিশেষ করে জার্মানি চীনকে সমর্থন করত কারন জার্মানি মনে করত চীনের সাহায্যে তাদের অর্থনীতি মজবুত হচ্ছে। কিন্তু করোনা মহামারীর কারনে ইউরোপের দেশ গুলো সহ জার্মানি বুঝতে পারে ধীরে ধীরে তারা চীনের উপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সেজন্য দেশ গুলো এখন চীনের বিকল্প খোঁজা শুরু করেছে এবং এটা ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ কুটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের।

৩) মধ্য প্রাচ্যে চীন ক্রমশ নিজের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ইসরায়েলের আইটি সেক্টরে গত এক বছরে চীন ২৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ইসরায়েল বিখ্যাত তার টেকনোলজির জন্য এবার সেই টেকনোলজি চীন পাবে। ইসরায়েলের দুটি বন্দরে চীন বিনিয়োগ করছে্ ইসরায়েলের ইনফ্রাস্ট্রাকচারে চীন ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। সৌদি আরবের সাথে চীনের সম্পর্ক যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। সৌদি আরবে ড্রোন ফ্যাক্টরি তৈরি করছে চীন। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সবচেয়ে বড় ব্যাবসায়িক পার্টনার চীন। মিশরের সুয়েজ খাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারন ভূমধ্যসাগর হয়ে আফ্রিকা ও দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগের এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পথ। এই সুয়েজ ক্যানেল বাড়ানোর প্রজেক্টে চীন যুক্ত আছে। ইরানে চীন পুরোপুরি নিজের প্রভাব বিস্তার করছে। কারন আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারনে ভারত ও একটু ইরান থেকে দূরে সরে গেছে। এই সুযোগটা চীন কাজে লাগিয়েছে। ইরানকে ১০ বিলিয়ন ডলার লোন দিয়েছে চীন। তাছাড়া বিআরআই প্রজেক্ট ও ডিফেন্স সেক্টরেও ইরানে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেবে চীন। ভারতের জন্য ইরানের চাবাহার বন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারন এই বন্দর হয়েই মধ্য এশিয়ার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব। সেজন্য ভারত চীনকে কুটনৈতিক ভাবে কাউন্টার করার জন্য ইরানের সাথেও সুসম্পর্ক রেখেছে। আমেরিকার এই জন্য সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইসরায়েলকে নতুন কোয়াড জোটে রেখেছে যাতে চীন পুরোপুরি প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। 

এটা তো গেল চীনকে কাউন্টার করার জন্য আমেরিকার ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহিকে দরকার। এবার মনে হতে পারে এই নতুন কোয়াডে ভারতের কী লাভ? মধ্য প্রাচ্যে চীন যাই করুক আমাদের কী দরকার?? দেখুন ইন্দো প্যাসিফিক এলাকায় পুরোনো কোয়াড গ্রুপ আছেই কিন্তু পশ্চিম ভারত মহাসাগর নিয়ে করা হবে??? সোজা কথায় সংযুক্ত আরব আমিরশাহির কাছে পারস্য উপসাগরে হরমুজ প্রণালী, গল্ফ অফ এডেনের বাব এল বন্দর, যেখান দিয়ে প্রতিদিন ৬.২ মিলিয়ন ব্যারেল ক্রুড অয়েল যায়, সুয়েজ ক্যানেল এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ পথ। এখান দিয়ে ভারতের সামুদ্রিক বানিজ্য হয়, এনার্জি সাপ্লাই হয়। ধরুন ভারত মধ্যপ্রাচ্যে ভারত কোন জোট তৈরি করল না। জিও পলিটিক্সের নিয়ম হচ্ছে যদি আপনি কোন কাজ না করেন তার মানে এই নয় যে আপনার ক্ষতি হবে না কোনও কারন শূন্যস্থান কোনওদিন পড়ে থাকে না। ভারত যদি কোনও পদক্ষেপ না নেয় এবং চীন যদি এইসব দেশ গুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি করে তাহলে কোনওদিন ভারত চীন যুদ্ধের সময় চীন নিজের প্রভাব খাটিয়ে ভারতের সাপ্লাই বন্ধ করে দেবে। তাছাড়া এসব এলাকায় নিরাপদে বানিজ্যের জন্য ড্রাগ মাফিয়া, জলদস্যুদের কাউন্টার করবার জন্য এসব দেশ গুলোর সহযোগিতা দরকার ভারতের। চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তান। আবার তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব আছে। সেজন্য ভারত মধ্যপ্রাচ্যে না এলে সুবিধা পাকিস্তানেরও হবে। তাছাড়া ইসরায়েল ও ভারতের বন্ধুত্ব বহু পুরোনো। ভারতর ডিফেন্স ও টেকনোলজি ইসরায়েল দেয়। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ভারতের এনার্জির বড় উৎস। সেজন্য নতুন কোয়াডের মতন জোট ভারতের ও দরকার। পশ্চিম ভারত মহাসাগরে প্রথম থেকেই ভারত ও আমেরিকান নেভি রয়েছে। সুতরাং একসাথে যৌথভাবে জোট তৈরি করলে আরও শক্তিশালী হওয়া যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *