ডিফেন্স

হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা- দি ফাদার অফ ইন্ডিয়ান নিউক্লিয়ার পোগ্রাম। কেন তাঁর রহস্যময় মৃত্যুর জন্য আমেরিকার ইনটেলিজেন্সকে দায়ী করা হয়?

রাজেশ রায়:– আজ আমরা ভারতকে যে অবস্থানে দেখি তা সম্ভব হয়েছে কেবল বিশেষ কিছু মানুষের জন্য। ভারতের জন্য তারা তাদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে দিতে পিছুপা হননি। এদের মধ্যেই একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা যিনি ভারতকে একটি বিশেষ সক্ষমতা দিয়েছিলেন যার জন্য পৃথিবীর বড় বড় শক্তিশালী দেশও আজ মিলিটারি পাওয়ারে ভারতের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেবার আগে দশ বার ভাবে। এই বিশেষ সক্ষমতাটি হচ্ছে পরমানু অস্ত্র। হোমি জাহাঙ্গীর ভাবাকে ভারতের পরমনু পোগ্রামের জনক বলা হয়। নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট থেকে শুরু করে, ইন্সটিটিউট তৈরি এমনকী রিসার্চের জন্য বিজ্ঞানীদের সিলেকশন সব কাজ তিনি করতেন। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টের বিষয় যে মানুষটি মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে ভারতকে পরমানু আক্রমনে সক্ষম দেশ তৈরি করতে পারত, সেই মানুষটির নাকী হঠাৎ এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়ে যায়। সবচেয়ে অবাক বিষয় তার ঠিক দুসপ্তাহ আগে ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর রহস্যময় ভাবে মৃত্যু হয় তাসখন্দে। যার জন্য হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার মৃত্যু নিয়ে অনেকের দাবি এর পেছনে জড়িত আছে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স বিভাগ সিআইএ। আজ এবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, সাথে সাথে হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার জীবনের বিশেষ কিছু অজানা ঘটনা ও তৎকালীন রাজনৈতিক প্রক্ষাপ।

ভারতের নিউক্লিয়ার পোগ্রামের জনক খ্যাত হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার জন্ম হয় ১৯০৯ সালের ৩০ অক্টোবর একটি ধনী পার্সি পরিবারে। সেই পরিবারের তখন সম্পর্ক ছিল দেশের অন্যতম বিখ্যাত ব্যাবসায়ী দিনশাও মানেকজি পেটিট ও ডোরাবজি টাটার সাথে। ওনার দাদুর নামও ছিল হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা যিনি মহীশুরের ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ এডুকেশন ছিলেন। ওনার বাবা জাহাঙ্গীর হোরমুসজী ভাবা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেন। ওনার মা মেহেরেন সির দিনশাও মানেকজি পেটিটের নাতনি ছিলেন ওনার এক পিসি মেহেরবাই এর বিয়ে হয়েছিল টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজী টাটার বড় ছেলে স্যার ডোরাবজি টাটার সাথে। এরকম বিখ্যাত পরিবারের ছেলে হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা বোম্বের আলফিনস্টিন কলেজ থেকে পাস করার পর ১৯২৭ সালে দি রয়েল ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে যোগদান করেন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউস কলেজে যান। সেখানে ১৯৩১-৩২ এ তার অসাধারন মেধার জন্য সোলেমন স্টুডেন্টশিপ ইন ইন্জিনিয়ারিং সম্মানে ভূষিত করা হয় তাঁকে। ১৯৩৩ এর ডিসেম্বরে ওনার প্রথম সায়েন্টিফিক পেপার দি অবজরবেশন অফ কসমিক রেডিয়েশন প্রকাশ হয়। এরপরই তিনি নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে ডক্টরেট উপাধি পান। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে ছুটি কাটাতে যখন ভারতে আসেন তিনি তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যার জন্য তিনি কিছুদিন ইংল্যান্ড যাননি আর। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের ফিজিক্স বিভাগ থেকে তাঁকে সেসময় রিডারের জন্য অফার করা হয়। তিনি খুশি হয়ে সেই অফার গ্রহন করেন যার সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে সেসময় ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের ফিজিক্স বিভাগের প্রধান ছিলি বিখ্যাত বিজ্ঞানী সিভি রমন। হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার লক্ষ ছিল ভারতকে নিউক্লিয়ার পাওয়ার দেশ হিসাবে তৈরি করা যাতে গোটা বিশ্বের সামনে একটি শক্তিশালী দেশ হিসাবে পরিচিত পায় এবং এরজন্য দরকার পরমানু বোম্ব। তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জহরলাল নেহেরু কে ভারতের নিউক্লিয়ার পোগ্রামের জন্য রাজি করান, তিনি বোঝান বিজ্ঞানই ভবিষ্যত। এরপর ভাবা ইনস্টিটিউট ফর কসমিক রে রিসার্চ ইউনিভার্সিটি তৈরি করেন। ১৯৪৪ সালে পয়েন্ট পার্টিক্যাল নিয়ে কাজ করবার সময় পরমানু হাতিয়ার তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। তিনি টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ বা টিআইএফআর এর ডিরেক্টর হন। এছাড়াও তার নেতৃত্বে অ্যাটমিক এনার্জি এস্টাবলিশমেন্ট ট্রম্বে বা এইইটি গঠন করা হয় যার বর্তমান নাম ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার। এই দুটি ইন্সটিটিউটকেই ভারতে পরমানু অস্ত্র তৈরির ভিত বলা হয়। ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যানও হন হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। তার এই অসাধারন প্রতিভার জন্য তিনি অ্যাডামস পুরস্কার ও পদ্মভূষন পান। ১৯৫১, ১৯৫৩ এবং ১৯৫৬ এ তিনি ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কারের জন্য মোনোনীত হয়েছিলেন। এসব কারনের জন্যই তাকে ভারতের পরমানু পোগ্রামের জনক বলা হয়। 

এয়ার ইন্ডিয়া বিমান ১০১, যা একটি বোয়িং ৭০৭ মডেল, একে কাঞ্চনজঙ্ঘা নামেও ডাকা হত। এই বিমান দুর্ঘটনায় হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা মারা যায়। ২৪ জানুয়ারী, ১৯৬৬ তে সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালার মাউন্ট ব্ল্যাঙ্কে দুর্ঘটনায় বিমানটি ধ্বংস হয়ে যায়, যাতে বিমানে থাকা ১১৭ জন যাত্রীই মারা যায়। এই বিমানে করে তিনি ভিয়েনা যাচ্ছিলেন। সরকারি ভাবে এই দুর্ঘটনার প্রধান কারন বলা হয় জেনেভা বিমানবন্দরের সাথে বিমানের পাইলটের যোগাযোগে ভুল বোঝাবুঝি। তবে একাধিক রিপোর্টে বলা হয় এটা কোনও দুর্ঘটনা ছিল না বরং আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর পরিকল্পনা ছিল। আসলে আমেরিকা চাইছিল না ভারত পরমানু অস্ত্র তৈরি করুক। ১৯৬৪ সালে চীনের পরমানু হাতিয়ার টেস্টিং এর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবাকে জিজ্ঞেস করেন ভারত কী পারবে পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে? তখন ভাবা বলেন ভারত পারবে। অক্টোবর, ১৯৬৫ তে অল ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশনে হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা জানান যদি সরকার অনুমতি দেয় তাহলে আঠারো মাসের মধ্যে তিনি পরমানু বোম্ব তৈরি করতে সক্ষম। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় দেখুন ১৯৬৬ সালের ১১ জানুয়ারি রহস্যজনক ভাবে মারা যায় লালবাহাদুর শাস্ত্রী। ঠিক তার দুসপ্তাহ পরে ২৪ জানুয়ারী মৃত্যু হয় হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার। আসলে এই দুটো ঘটনা ইঙ্গিত করে ভারতকে কেউ যেনো পরমানু ক্ষমতা অর্জন করতে দিতে চায় না। লেখক জর্জ ডগলাসের তার লেখা কনভারসেসন উইথ ক্রোতে তে একজন প্রাক্তন সিআইএ অফিসার রবার্ট ক্রোলিকে জিজ্ঞেস করে এসব ব্যাপারে অনেক গোপন তথ্য পান। জর্জ ডগলাস রবার্ট ক্রোলির সাথে একটি ফোনে এই কথা বলেন। যেখানে রবার্ট ক্রোলি স্বীকার করেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার মৃত্যুর জন্য সিআইএ দায়ী। হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার প্রসঙ্গে রবার্ট বলে ভাবার বিমানের কার্গো সেকশনে একটি বোম্ব রাখা হয়েছিল, বিমানটি আল্পস পর্বতে পৌঁছানোর পরই বিস্ফোরন ঘটানো হয়। রবার্ট আরও বলে ভাবা সেসময় পরমানু অস্ত্র তৈরি করছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের গভীর বন্ধুত্ব ছিল সেজন্য তাদের কাছে ভাবা বিপদজনক ছিল খুব। লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রসঙ্গে রবার্ট বলে তাকে মারাও তাদেরই পরিকল্পনা কারন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর নেতৃত্বে ভারত পরমানু বোম্ব তৈরির খুব কাছে পৌঁছে গেছে। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল। উভয় দেশই চাইছিল যত বেশী সম্ভব দেশকে নিজেদের ব্লকে আনতে। এশিয়াতে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল পাকিস্তান, যার জন্য ভারত স্বাভাবিকভাবেই সেসময় আমেরিকার কাছে শত্রু ছিল। এদিকে ওয়েপনসের জন্যও ভারত তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল। যার জন্য ভারত যখন পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে চলেছিল তখন আমেরিকা এই পদক্ষেপ নেয়।

ড্যানিয়েল রোচ নামে এক সুইস পর্বতারোহী ও অ্যাভিয়েশন এক্সপার্ট পুরো পাচ বছর ধরে আল্পস পর্বতমালায় এয়ার ইন্ডিয়ার এই বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত করেন তিনি ২০০৯ এর এক রিপোর্টে জানান এয়ার ইন্ডিয়া ১০১ এর ধ্বংসাবশেষ দেখে মনে হচ্ছে কোন মিলিটারি বিমান, বোম্ব বা মিসাইল দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। ১৯৫০ এ এই এলাকায় আরও একটি এয়ার ইন্ডিয়া বিমান ধ্বংস হয়েছিল যার নাম ২৪৫ মালাবার প্রিন্সেস। কিন্ত এই বিমানের ধ্বংসাবশেষ একই জায়গায় পাওয়া গেছিল যেখানে ১০১ এর ধ্বংসাবশেষ প্রায় ২৫ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। সাধারনত কোন বিমান দুর্ঘটনা হলে তার ধ্বংসাবশেষ একই জায়গায় থাকে কিন্তু কোনও বিমান মিসাইল বা বোম্ব দ্বারা আঘাত হলে তার ধ্বংসাবশেষ অনেকটা এলাকা জুড়ে থাকে। এছাড়া পর্বতারোহী আরনড ক্রাইস্টম্যান ও জুলিয়াস বার্গার বিমানের ধ্বংসাবশেষের কাছে একটি ডিপ্লোমেটিক ব্যাগ পায় যাতে দি হিন্দুস্তান টাইমস, দি হিন্দু, দি স্টেটসম্যানের মত খবরের কাগজের পাশাপাশি সেসময়ের ক্যালেন্ডার এবং নিউইয়র্কে নিযুক্ত ভারতীয় প্রতিনিধি সিজেকে মেননকে লেখা চিঠি ছিল। তবে আজও হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু একটি রহস্য। তবে এসব করেও ভারতকে আটকানো যায় নি। ১৯৭৪ সালে অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধার মাধ্যমে পোখরানে ভারত প্রথম পরমানু বোম্ব টেস্ট করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *