ডিফেন্স

জাপানের সেনাকে সেইসময় ডেভিল আর্মি বলা হত। শুধু মজার জন্য প্রচুর মানুষ হত্যা করেছিল। ইতিহাসের কলঙ্কিত ন্যানকিং ম্যাসাকার

রাজেশ রায়:– বিশ্বের ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা রীতিমতো বাকরুদ্ধ করে দেয়। যদি ইতিহাসের পাতা উল্টানো হয় দেখবেন যে কোন যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মেয়েরা। যখনই কোন দেশ কোন দেশকে আক্রমন করেছে এবং যুদ্ধে জয় লাভের পর পরাজিত দেশের মানুষের উপর নারকীয় অত্যাচার করেছে যার মধ্যে সবচেয়ে বেশী অত্যাচার মহিলাদের উপরই হয়েছে। ইতিহাসের এসব নারকীয় স্মৃতি আজও মানবজাতি বহন করে চলেছে। এমনই এক নৃশংস ঘটনা হচ্ছে ন্যানকিং ম্যাসকার বা রেপ অফ ন্যানকিং। জাপানের রাজকীয় সেনা সেময় হঠাৎ চীন আক্রমন করে চীনের ন্যানকিং শহরে বাচ্ছা, বয়স্ক, মহিলা সবাইকে হত্যা করে যা ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় হিসাবে পরিচিত। জাপানের সেনা কে সেইসময় ডেভিল আর্মি বলা হত যারা শুধু মজার জন্য এত মানুষকে হত্যা করেছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে তারা নতুন নতুন উপায় বার করে মানুষকে হত্যা করেছিল। জাপানতো পরে এই ঘটনা অস্বীকারই করে দিয়েছিল কিন্ত সমস্ত প্রমান দেখে জাপান বাধ্য হয়ে এই ঘটনা স্বীকার করে। আজ এই ন্যানকিং ম্যাসাকার সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করব। 

চীনের ইতিহাস যদি দেখি তাহলে দেখা যাবে ১৩ শতকে চেঙ্গিস খান সাংহাই সহ উত্তর চীন দখল করে নেয় এবং প্রচুর মানুষকে হত্যা করা হয়। ১৬ শতক আসতে আসতে চীনে কুইং রাজবংশের শাসন শুরু হয়, এই সময় চীন প্রচুর গরীব হয়ে পড়ে। এবার আসা যাক জাপান প্রসঙ্গে, ইতিহাসে প্রায় সমস্ত যুদ্ধই হয়েছে অন্য দেশের জমি দখল কে কেন্দ্র করে। চীন ও জাপানের মধ্যেও সমস্যা ছিল কোরীয়াকে নিয়ে। দু’পক্ষই কোরিয়াকে নিজেদের বলে দাবি করত। এই নিয়ে ১৮৯৪ সালে চীন ও জাপানের মধ্যে প্রথম সিনো- জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। দুই বছরের মধ্যে চীনকে পরাস্ত করে জাপান পুরো কোরিয়া দখল করে নেয়। ১৯৩৭ সালে দুই দেশের মধ্যে আবারও যুদ্ধ শুরু হয় যাকে বলা হয় দ্বিতীয় সিনো জাপান যুদ্ধ। তবে ততদিনে জাপান ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যে জাপান ছিল তা ভয়ানক আগ্রাসী ও অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। এই সময় আবার চীনে গৃহযুদ্ধ চলছিল, মাও জেদং এর কমিউনিস্ট দল ও চ্যাং কাই সেকের ন্যাশানালিস্ট দলের মধ্যে। যার জন্য সেসময় চীনের সেনাবাহিনী দুর্বল ছিল, সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল না। এই সুযোগে ১৯৩১ সালে জাপান তাদের সেনাবাহিনী উত্তর চীন সীমান্তে মোতায়েন করে এবং ১৯৩৭ এর মধ্যে সাংহাই শহর সহ উত্তর চীনের অনেক জায়গা দখল করে নেয়। তবে চাইনিজ সেনাবাহিনী যথেষ্ট যুদ্ধ করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাপান জিতে যায়। এবার ন্যানকিং এর ব্যাপারটা একটু বলি। ১৯২৮ সালে ন্যানকিং কে চীনের রাজধানী হিসাবে ঘোষনা করা হয়। ১৯৪৯ সালে যখন মাও জেদং ক্ষমতায় এসে তিয়েনমেন স্কোয়ার থেকে কমিউনিজমের লালা পতাকা ওড়ায় তখন বেজিংকে চীনের নতুন রাজধানী ঘোষনা করা হয়, ততদিন পর্যন্ত ন্যানকিংই ছিল চীনের রাজধানী। ১৯৩৭ সালে যখন জাপান চীন আক্রমণ করে তখন চীনের কমিউনিস্ট দল ও ন্যাশানালিস্ট দল একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করে কিন্তু জাপান হেরে যেতে আবার নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে। শেষ পর্যন্ত মাও জেদং এর কমিউনিস্ট দল জয় লাভ করে এবং পিপলস রিপাবলিক অফ চীনের জন্ম হয়। যাই হোক এবার ১৯৩৭ সালে আবার ফিরে যাওয়া যাক। ব্যাটেল অফ সাংহাই হেরে যাবার পর চ্যাং কাই সেক বুঝতে পেরেছিল রাজধানী ন্যানকিং এর পতন সময়ের অপেক্ষা। চ্যাং কাই সেক তখন তার সমস্ত সেনাকে ন্যানকিং থেকে বেড়িয়ে আসতে বলে। এই সময় জার্মানী চ্যাং কাই সেককে বলে জাপানিদের শহরের আরও ভেতরে প্রবেয় করতে দেওয়া হোক তারপর আক্রমন করে সহজে ওদের হারানো যাবে। কিন্তু চ্যাং কাই সেক ভবিষ্যতে আরও যুদ্ধের জন্য নিজের সেনাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। সেই সময় ন্যানকিং এর মানুষ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছিল। এক দল লোক চাইত তারা চীনের অংশ সুতরাং চীনের সেনা তাদের রক্ষা করুক। কিন্তু আরেক দল ভাবত চীনে এই সময় গৃহযুদ্ধ চলছে এর থেকে জাপানী সেনা অনেক ভাল। যখন জাপান সেনা ন্যানকিং শহরে প্রবেশ করে তখন অনেক মানুষ তাদের বাড়ির জানলা থেকে জাপানের পতাকা উড়িয়ে জাপান সেনাকে অভ্যত্থনা জানিয়েছিল। চ্যাং কাই সেকের পালিয়ে যাবার পরও ন্যানকিং শহরে মেজর ত্যাং সেংজির নেতৃত্বে প্রায় এক লাখ সেনা ছিল কিন্তু জাপানের সেনাবাহিনীর মতন সুদক্ষ ও শক্তিশালী ছিলনা। ১৯৩৭ সালের ১ ডিসেম্বর জাপনাি সেনা ন্যানকিং শহরের দিকে মার্চ শুরু করে এবং ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো ন্যানকিং কে ঘিরে ফলে। জাপান ন্যানকিং কে স্যারেন্ডার করবার আদেশ দেয় কিন্তু ১০ ডিসেম্বর অবধি চীন কোন জবাব দেয়নি। এর ফলে ১২ ডিসেম্বর থেকে ভয়ানক আক্রমণ শুরু করে জাপানি সেনা। প্রথম এক সপ্তাহ ধরে চাইনিজ সেনাকে ধরে ধরে হত্যা করা হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে শুধু মজার জন্য চাইনিজ সেনাকে হত্যা করতে শুরু করে জাপান। জাপনিজ সেনা চীনের সেনাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিত। কখনও জাপনিজ সেনা নিজেদের মধ্যে বাজি ধরত কে আগে ১০০ টা মাথা কাটবে, এই ভাবে নৃশংস হত্যা যজ্ঞ শুরু হয়েছিল ন্যানকিং এ। ইয়াংতে নদীর তীরে অবস্থিত ন্যানকিং শহর। জাপনিজ সেনা পরাজিত চাইনিজ সেনাকে এক লাইনে নদীর তীরে দাড় করিয়ে জীবন্ত অবস্থায় আগুন লাগিয়ে দেয়, যাস্ট কল্পনা করুন কতটা ভয়াবহ ছিল এই অবস্থা। সেসময় ইন্টারনেট ছিল না যার জন্য বাইরের দেশের লোক এসম্পর্কে কীছুই জানত না। পরে ফটো তে সব দেখা যায়। আসলে জাপানিজ সেনা চাইনিজদের হত্যা করবার আগে তাদের সাথে দাড়িয়ে ছবি তুলত। জাপানের মানিষ তাদের সেনাবাহিনীর এই কাজ কে রীতিমতো সমর্থন করত, জাপানের সেনাকে দেশের বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। জাপানিজ সেনা চাইনিজ মহিলাদের গন ধর্ষন শুরু করে, ছেলের সামনে মা কে, বাবার সামনে মেয়েকে ধর্ষন করে হত্যা করা হয়। এমনকী পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অন্য সদস্যকে হত্যা করতে বাধ্য করা হয়। পুরো ন্যানকিং শহর জুড়ে বড় বড় গর্ত করে জাপনিজ সেনা সেখানে চাইনিজ দের মৃতদেহ ফেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কী করে মানুষকে হত্যা করা যায় তার জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি নেয় জাপাম সে সময়। যেমন একজন বৌদ্ধ মংকে বলা হয় একটি মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে, সেই মংকে অসম্মত হলে তার পুরুষাঙ্গ কেটে তাকে মেরে ফেলা হয়। জাপনিজ সেনা চাইনিজ দের মাটিতে অর্ধেক পুতে দিত দিয়ে তার উপর ক্ষুদার্ত কুকুরদের ছেড়ে দিত। এভাবে পুরো ন্যানকিং শহর জুড়ে নারকীয় হত্যালীলা করে সেই সময় জাপানিজ সেনা। প্রায় ৩ লাখ চাইনিজ কে হত্যা করা হয় এবং প্রায় ৮০,০০০ চাইনিজ মহিলাকে ধর্ষন করা হয়। আট বছরের বাচ্চা থেকে আশি বছরের বয়স্ক মানুষ কেউই রেহাই পায় নি। পুরো ইয়াং তে নদী রক্তের রঙে লাল হয়ে গেছিল। দেখুন একটা কথা আছে কর্ম ফল কখনও ক্ষমা করে না। ১৮৯০ থেকে ১৯৪৪ অবধি জাপান যেসব অত্যাচার করেছে তা বর্ননাতীত। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যখন পরমানু বোম্ব ফেলা হয় জাপানে তখন যে ধ্বংসযজ্ঞ হয় তা জাপানকে পুরো ভেঙে দেয়, হ্যা জপাানের সাথে অবশ্যই খারাপ হয়েছে কিন্তু প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবেই। যে যে দেশ এমন নৃশংসতা করেছে তাদেরই অবস্থা এমন হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক গন ধর্ষন ও ৩০ লাখ হত্যা করেছিল, আজ পাকিস্তানের অবস্থা দেখুন। প্রায় চার থেকে ছয় সাপ্তাহ অবধি এই দানবীয় অত্যাচার চলে পুরো ন্যানকিং শহর জুড়ে। এই অত্যাচার আরও চলত কিন্তু সেসময় ভগবানের মতন ন্যানকিং বাসীদের উদ্ধার করতে সামনে আসে জন রেবে নামে এক নাজি ব্যাবসায়ী। ভাবুন জন রেবে একজন নাজী যে নিজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রচুর ইহুদীদের নারকীয় ভাবে হত্যা করে সে নাকী ন্যানকিং বাসী দের বাঁচায়। জন রেবে ৮ কিলোমিটাট এলাকা জুড়ে একটি আন্তর্জাতিক প্যাসেজ তৈরি করে যাতে হাজার হাজার ন্যানকিং বাসী এখানে পালিয়ে আসে। এখানে জাপনিজ সেনা আসতে পারত না কারন তাহলে পুরো ইউরোপীয়ান সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ত। জন রেবের অনুরোধে হিটলার তার সেনা দিয়ে সাহায্য করে। ভাবতে অবাক লাগলেও সেসময় হিটলার সত্যিই সাহায্য করেছিল।

১৯৮৫ সালে ন্যানকিং পৌরসভা এই অত্যাচারের স্মরনে ন্যানকিং ম্যাসাকার মেমোরিয়াল হল তৈরি করে। এটি এমন জায়গায় তৈরি করা হয়েছে যেখানে ১০,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১৬ সাল অবধি এখানে অন্তত ১০,৬১৫ জনের নাম খোদাই করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে ড্যানিয়েল কোয়ান তার ফটো এক্সিবিশনে এই ঘটনাকে দি ফরগোটন হলোকাস্ট বলে উল্লেখ করেছেন৷ ২০০৫ সালে ন্যানকিং এ জন রেবের পুরোনো ঘরকে সংরক্ষণ করে জন রেবে এন্ড ইন্টারন্যাশনাল সেফটি জোন হল তৈরি করা হয় যা ২০০৬ সালে জন সাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর চীন ন্যানকিং মেমোরিয়াল ডে ঘোষনা করে। ২০১৫ সালের ৯ অক্টোবর ন্যানকিং ম্যাসাকার ইউনেস্কোর অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে এই ন্যানকিং ম্যাসাকার নিয়ে ১৯৭০ সাল অবধি চীনের চেয়ারম্যান মাও জেদং কোন কথা বলে নি কারন সেই সময় জাপানের সাথে চীনের বানিজ্যিক সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৭০ সালে চীন প্রথম এই ঘটনার কথা জাপানকে জানায় এবং টোকিও এর আাদালতে প্রমান দেওয়া হয় কিন্তু জাপান সরকার এটা চীনের মিথ্যা রটনা বলে স্বীকার করেনি। ১৯৮৪ সালে জাপানিজ সেনার একটি সংস্থা ১৯৩৭-৩৮ এর কীছু জাপানি সােনার সাথে সাক্ষাৎকারে এটা প্রমান পায় সত্যিই সেসময় এই নৃশংস ঘটনা ঘটে। ১৯৯৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন জাপনিজ প্রধানমন্ত্রী টোমিচি মুরায়ামা সরকারি ভাবে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *