ডিফেন্স

জাপান সীমান্তে আবার মিসাইল মোতায়েন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে রাশিয়া-জাপান যুদ্ধ হতে পারে? রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে ঝামেলার কারণ কি?

রাজেশ রায়:—- ভারতে একটা কথা আছে শত্রুকে কখনও দুর্বল ভাবতে নেই। ঠিক এই কথাটাই প্রযোজ্য রাশিয়া ও জাপানের ক্ষেত্রে। ৮ ফেব্রুয়ারী ১৯০৪ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ পর্যন্ত হওয়া রাশিয়া ও জাপানের যুদ্ধে ইতিহাসে প্রথমবারের মতন কোন এশিয়ান দেশ ইউরোপীয়ান দেশকে হারায়। এই সময় জাপানের রাজা ছিল এম্পিরিয়র মেজি, যিনি ১৮৬৭ সালে জাপানের সিংহাসনে বসেন। সেইসময় জাপানের রীতিমতো আধুনিকরন করেছিলেন তিনি। এই সময় রাশিয়ার রাজা ছিলেন জার নিকোলাস দ্বিতীয়। এই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রধান ভুল ছিল এটা যে জাপানকে ছোট দেশ হিসাবে দুর্বল ভাবা। সত্যি কথা বলতে কী রাশিয়ার বিশাল আয়তনের সামনে জাপান কিছুই নয়। রাশিয়াকে দশ ভাগে ভাগ করলে, সবচেয়ে ছোট ভাগের আয়তনও জাপানের থেকে বেশী। অবস্থা এমন ছিল যে রাশিয়া জাপানকে তাদের শত্রু হবার ও যোগ্য মনে করত না। এবার জানা যাক এই যুদ্ধের কারন কি ছিল! জাপান ও রাশিয়ার ঝামেলার সূত্রপাত ১৮৯৪-৯৫ সালে হওয়া প্রথম চীন জাপান যুদ্ধের মাধ্যমেই শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে জাপান জয় লাভ করে এবং কোরিয়া সহ চীনের মান্চুরিয়া ও তাইওয়ান দখল করে নেয়। এখান থেকেই বিবাদের সূত্রপাত হয়। এই সময় চীনের শাসক ছিল কুইং রাজবংশ। কিন্তু কুইং রাজবংশ দুর্বল ছিল এই সময় যার সুযোগ নিয়ে রাশিয়া চীনের সীমানায় নিজেদের সীমানা বাড়াতে চাইছিল। রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সীমানা রয়েছে মান্চুরিয়া হয়ে, রাশিয়া তাদের ভ্লাদিবস্তক থেকে এই মান্চুরিয়া পর্যন্ত ১০০০ মাইল লম্বা রেলওয়ে লাইন তৈরি করতে চাইছিল কিন্তু মান্চুরিয়া ছিল জাপানের অধীনে তাই রাশিয়া ১৮৯৫ এর পর চীনকে সমর্থন করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে জোট গঠন করে জাপানকে চাপ দিতে থাকে। ফলে মান্চুরিয়ার লিয়োতং প্রদোশ সহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা গুলো থেকে জাপান তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেয় বাধ্য হয়ে। তবে মান্চুরিয়ার কিছু কিছু জায়গায় তখনও জাপানিজ সেনা ছিল। রাশিয়া মান্চুরিয়া দখল করতে চাইছিল কারন মান্চুরিয়া আর্থিক ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রদেশ ছিল এখানে কয়লা, লোহা, সোনা প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। এই ঘটনা থেকেই জাপান রাশিয়াকে নিজেদের শত্রু৷ মানতে শুরু করে। জাপানিজ সেনা সরে যাওয়ার পর রাশিয়া চীনের সাথে একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া ভ্লাদিবস্তক থেকে মান্চুরিয়া অবধি রেললাইন তৈরি করে এবং মান্চুরিয়ার আর্থার বন্দর ও তার আশে পাশের এলাকা ২৫ বছরের জন্য লিজে নিয়ে নেয়। এই আর্থার বন্দর খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারন এখান থেকে পুরো কোরিয়া ও মান্চুরিয়ার উপর নজর রাখা সম্ভব। রাশিয়া পোর্ট আর্থারকে পুরো শক্তিশালী সেনা ঘাঁটিতে পরিনত করে, রাশিয়া এখানে তাদের দেড় লাখ সেনা ও যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করে। এরপর রাশিয়ার নজর গিয়ে পড়ে কোরিয়ার উপর। সেই সময় উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া একসাথে একটি কোরিয়া দেশ ছিল। কোরিয়ার নিজস্ব শাসক ছিল যে চীনের কুইং রাজবংশের অধীনে থাকত। জাপান কোরিয়া দখল করলেও কোরিয়ার অনেক প্রদেশ তখনও স্বাধীন ছিল এবং কোরিয়ান রাজা চাইতনা জাপানের অধীনে থাকতে। এইজন্য কোরিয়ান রাজা সেসময় রাশিয়া ও চীনের সমর্থন করে। জাপানিজ সেনা কোরিয়ার রাজার প্রাসাদে আক্রমণ করে কিন্তু রাজা কোনও রকমে পালিয়ে আসে এবং রাশিয়ান সেনারা কোরিয়ান রাজাকে বাঁচিয়ে নেয়। এই ঘটনায় জাপান ক্ষুব্ধ হয়। আগুনে আরও ঘি ঢালবার জন্য রাশিয়া ইয়ালু নদীর মোহনা এবং বন্দর নিজেদের অধিকারে আনে যেখান থেকে পুরো কোরিয়ার উপর নজর রাখা যায়। ইয়ালু নদীকে আমরক বা আমনক নদীও বলা হয় যা উত্তর কোরিয়া ও চীনের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে। এরপরই জাপান রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। জাপানের একটা স্ট্রাটেজি ছিল যে জাপান যুদ্ধ শুরু করবার কোন ঘোষনা না করেই হঠাৎ করে শত্রুর উপর আক্রমন করত। ১৯০৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী রাতে জাপানিজ নেভি হঠাৎই পোর্ট আর্থাররে আক্রমন করে প্রচুর রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে দেয়। রাশিয়া এর জন্য প্রস্ততই ছিলনা। আসলে রাশিয়া কোনওদিন জাপানকে তাদের শত্রু হিসাবে যোগ্য মনে করেনি। ফেব্রুয়ারী মাস থেকে আগস্ট মাস অবধি পোর্ট আর্থারে রাশিয়া ও জাপানের যুদ্ধ চলে। শেষ পর্যন্ত এখানে রাশিয়া পরাজিত হয়। রাশিয়ার দুর্বলতা বুঝতে পেরে জাপান পুরো কোরিয়াতেই আক্রমণ করে দখল করে নেয় এবং রাশিয়ানরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। পোর্ট আর্থার ও কোরীয়ার পর এবার জপানাের লক্ষ্য ছিল পুনরায় মান্চুরিয়া দখল। যার জন্য ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে মান্চুরিয়ার মাকদুন বন্দরে আক্রমন করে জাপান, এখানেও রাশিয়া পরাজিত হয়। মে মাসে আবারও মান্চুরিয়াতে রাশিয়া ও জাপানের যুদ্ধ হয়, আবারও পরাজিত হয় রাশিয়া। জাপান তাদের হোকাইডু দ্বীপে কাছে থাকা রাশিয়ার সাকলিন দ্বীপ পর্যন্ত দখল করে নেয়। শত্রুকে দুর্বল ভাবার মূল্য দিতে হয় রাশিয়াকে। এরকম অবস্থায় যুদ্ধ থামানোর জন্য আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে পোর্টসমাউথ সন্ধি করায় এবং উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হয়। এবার জানা যাক কেন বারবার রাশিয়া জাপানের কাছে পরাজিত হচ্ছিল। 

১) সবচয়ে বড় কারন রাশিয়া জাপান কে দুর্বল ভেবে বসেছিল যার জন্য গুরুত্ব দেয়নি।

২) ১৮৯৪-৯৫ সালে জাপানিজ সেনা পোর্ট আর্থার, কোরিয়াতে চীনের কুইং রাজবংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করে ফলে তাদের সেই জায়গা সম্পর্কে ভৌগোলিক জ্ঞান ও অনুভব রাশিয়ার থেকে বেশী ছিল।

৩) জাপানের অস্ত্র সেইসময় রাশিয়ার থেকে আধুনিক ছিল যা রাশিয়া জানত না।

৪) রাশিয়া মূলত জাপানের সাথে যুদ্ধ করেছিল ব্রিটেনের ভরসায় কারন আগেই বলা হয়েছে রাশিয়া ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে জোট করেছিল জাপানের বিরুদ্ধে কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া এদের থেকে কোন সহায়তা পায়নি।

বর্তমানে জাপান যথেষ্ট শান্ত দেশ তবে এখনও রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে কিছু বিতর্কিত বিষয় আছে। কিছুমাস আগে একটা খবর শোনা গেছিল যে প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের কাছে কুরিল দ্বীপপুঞ্জে রাশিয়া তাদের মিসাইল মোতায়েন করেছে। প্রথমে এই দ্বীপের অবস্থান দেখা যাক। জাপানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ হচ্ছে হোকাইডু, হোনসু, সিকোকো ও ওকিইসো। যদি জাপানের অবস্থান বিশ্ব ম্যাপে দেখেন দেখবেন জাপানের বাঁদিক রয়েছে রাশিয়া। এখানেই স্ট্রাটেজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে কুরিল দ্বীপপুঞ্জ। এর উত্তর দিকে রয়েছে কামচাটকা পেনিনসুলা। ঠিক এরপরেই রয়েছে অনেককটা দ্বীপ পুরো একসাথে যা গিয়ে মিশেছে জাপানের হোকাইডু দ্বীপের সাথে। এসব দ্বীপকেই একত্রে কুরিল দ্বীপপুঞ্জ বলা হয়। রাশিয়া জাপানের কাছে এই দ্বীপে তাদের মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করেছে। তবে এর মানে এটা নয় যে এখনই রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধ হবে। তাহলে রাশিয়া কেন এই সিস্টেম মোতায়েন করল? এর মাধ্যমে রাশিয়া কি সংকেত দিতে চাইছে? জাপানের একদম উত্তরে রয়েছে হোকাইডু দ্বীপ আর এর সাথেই যুক্ত রয়েছে কুরিল দ্বীপপুঞ্জের পুরো চেন যাতে অন্তত ৫৬ টি ছোট বড় দ্বীপ রয়েছে। জাপান এই কুরিল দ্বীপ নিজেদের বলে দাবি করে কিন্তু এই দ্বীপ বর্তমানে রাশিয়ার অধীনে রয়েছে। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এবং ওখোতসক সমুদ্রের মাঝে থাক এই কুরিল দ্বীপপুঞ্জের চারটি প্রধান দ্বীপ ইতুরুপ, কোনাসির, হাম্বোমাই ও সিকোতান, এগুলোকে জাপান নিজেদের বলে দাবি করে। এই কুরিল দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ হচ্ছে মতুয়া দ্বীপ, ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ ওভাল আকৃতির এই দ্বীপে রাশিয়া তাদের ব্যাস্টিয়ন কোস্টাল ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করেছে। তবে এটাই প্রথম নয় এর আগেও এখানে মিলিটারি বেস ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর অর্থের অভাবে এই বেস বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এবার আবার এখানে মিলিটারি বেস সচল করেছে রাশিয়া। রাশিয়ার মোতায়েন করা ব্যাস্টিয়ান কোস্টাল ডিফেন্স সিস্টেমের রেঞ্জ ৫০০ কিলোমিটার। রাশিয়া শুধু মিসাইলই মোতায়েন করেনি বরং মিলিটারি বেস, সাঁজোয়া গাড়ি অর্থাৎ পুরো মিলিটারি বেস তৈরি করছে। কিন্তু রাশিয়া এটা করলই কেন?? তার আগে এটা জানা যাক কুরিল দ্বীপপুঞ্জের বন্টনের ব্যাপারে। ১৮৫৫ সালে জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি হয় যাকে বলা হয় ট্রিটি অফ সিমোডা যাতে রাশিয়া কুরিল দ্বীপপুঞ্জের চারটি দ্বীপ ইতুরুপ, কোনাসির, হাম্বোমাই ও সিকোতান জাপানকে দেয় এবং বাকী দ্বীপ গুলো নিজেদের অধিকারে রাখে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে যায় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমেরিকার কিছু বৈঠক হয় যাতে এইসব দ্বীপ গুলো জাপানের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দিয়ে দেওয়া হয়। এইসব দ্বীপে বসবাসকারী জাপানি মানুষদের জোর করে দ্বীপ ছেড়ে জাপানের হোকাইডু দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই সব দ্বীপে বসবাসকারী জাপনিদের আইনু বা ইজো বলা হত। এইসব দ্বীপ গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন এখানে মাছ, গ্যাস ও তেলের ভান্ডার রয়েছে যা অর্থনীতির জন্য ব্যাপক কাজে দেবে, তাছাড়া পর্যটনের বিশেষ এলাকা এগুলো। রাশিয়ার নিজের জন্য এই দ্বীপ গুলো বিশেষ দরকারী কারন এই দ্বীপের কাছে রাশিয়ার ভ্লাদিবস্তক বন্দর রয়েছে। রাশিয়ার তীব্র ঠান্ডায় পুরো বন্দর, সমুদ্র ৪-৫ মাস জমে বরফ হয়ে যায় ফলে রাশিয়ান জাহজাকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে হলে কুরিল দ্বীপপুঞ্জ হয়ে যেতে হবে। সুতরাং এই দ্বীপ গুলো রাশিয়া নিজেদের অধীনে রাখতে চাইছে। এবার আপনাদের মনে হতে পারে এতদিন পর রাশিয়া হঠাৎ কেন এখানে সামরিক স্থাপনা করছে। আসলে রাশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমান করতে চাইছে। ইন্দো প্যাসিফিক এলাকা ভবিষ্যতের প্রধান হটস্পট, তাই রাশিয়াও প্যাসিফিক এলাকায় নিজেদের উপস্থিতি জানিয়ে রাখছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *