ডিফেন্স

রহস্যেঘেরা ব্ল্যাকবক্স। গোটা বিমান ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু ব্ল্যাকবক্স ধ্বংস হয় না?

রাজেশ রায়ঃ কিছুদিন আগে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে তা আপনারা সকলেই জানেন। তামিলনাড়ুর কুন্নুড় এ ভারতীয় বিমানবাহিনীর Mi-17V5 হেলিকপ্টার ধ্বংসে আমাদের সিডিএস বা  চীফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপীন রাওয়াত জী সহ ওনার স্ত্রী এবং ভারত মায়ের আরও ১২ জন বীর পুত্র বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন। শোকস্ত্বদ্ধ এই ঘটনায় গোটা দেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। এই দুর্ঘটনায় একমাত্র বেঁচে ছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন ভরুন সিং, ওনার শরীরের বেশীরভাগ অংশ পুড়ে গিয়েছিল তবুও ৩ দিন ধরে লড়াই করে অবশেষে তিনিও হার মেনেছেন। ওনার জন্যই আমাদের তেজস এয়ারক্রাফটের রেকর্ড এখনও অক্ষুন্ন আছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর লাইট কমব্যাট অ্যাটাক, সুপারসনিক এয়ারক্রাফট তেজস পৃথিবীর একমাত্র ফাইটার জেট যা কখনও ধ্বংস হয় নি। সেই ২০০১ সালে তেজস এর প্রথম প্রোটোটাইপের ফ্লাইট টেস্ট হয়েছিল তারপর আজ ২০ বছর ধরে তেজস এর ৫০০০ বার টেস্ট হয়েছে কিন্তু একবার ও তেজস ধ্বংস হয় নি৷ পৃথিবীর অন্য কোন এয়ারক্রাফট এর এই রেকর্ড নেই। কিন্তু একবার ফ্লাইটের সময় তেজস এর ইন্জিনে সমস্যা দেখা দেয়, সেইসময় বিমানটির ককপিটে এই ভরুন সিং জী। উনি নিজের জীবন বাজি রেখে শেষপর্যন্ত সেই তেজসটিকে সফল ল্যান্ডিং করিয়েছিলেন। যার জন্য তেজসের একবার ও ধ্বংস না হওয়ার রেকর্ড অক্ষুন্ন আছে। এর জন্য ওনাকে রাষ্ট্রপতি মেডেল ও দেওয়া হয়। আজকের যে বিষয় সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ টপিক যার জন্য এই কথা গুলো জানাতেই হল।

ব্ল্যাকবক্স জিনিস টা কী? কেনো এই জিনিসটা এত গুরুত্বপূর্ণ? সোজা ভাষায় বলতে গেলে একজন মানুষ অস্বাভাবিকভাবে মারা গেলে তার  শরীরের যেমন ময়নাতদন্ত করা হয় তেমন একটি বিমান বা হেলিকপ্টার হঠাৎ ধ্বংস হলে তার কারন জানতে ব্ল্যাকবক্সের প্রয়োজন পড়ে। ব্ল্যাকবক্স নামটা শুনে আপনাদের মাথায় হয়ত কালো রং এর কোন বাক্সের কথা ঘুরছে কিন্তু বাস্তবে ব্ল্যাকবক্স হয় উজ্জ্বল কমলা রঙের। ব্ল্যাকবক্স নামটা এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। সেইসময় ব্রিটিশ বিমানবাহিনী সহ মিত্র দেশ গুলোর বিমানে এই গোপন ব্ল্যাকবক্স ব্যবহার করা হত। ১৯৪৫ সালের মে মাসে একটি প্রতিবেদন “রেডার ফর এয়ারলাইন্স” এ এর কথা প্রথম উল্লেখ করা হয়। ১৯৫৮ সালে ব্রিটিশ এরোনটিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল ব্ল্যাকবক্স শব্দটি ব্যবহার করে। প্রথমে এগুলো কালো রং এরই হত কিন্তু ১৯৬৭ থেকে এগুলোকে উজ্জ্বল কমলা রঙের করা হতে থাকে যাতে বিমান বা হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়ে গেলে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সহজেই চোখে পড়ে উজ্জ্বল রং।

এতক্ষণে নিশ্চয় ব্ল্যাকবক্স সম্পর্কে আপনাদের একটা প্রাথমিক ধারনা চলে এসেছে। ব্ল্যাকবক্স কাজ করে কী ভাবে? ব্ল্যাকবক্সের দুটো ভাগ আছে প্রথম হচ্ছে ককপিট ভয়েস রেকর্ডার বা CVR.  ককপিট হল বিমান বা হেলিকপ্টার এর চালক বসে তাকে ককপিট বলে। ককপিটে কী কথা হয় তা রেকর্ড করে এই সিভিআর। দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার বা FDR. এই এফডিআর মূলত বিমান বা হেলিকপ্টারটির পারফরম্যান্সের ডাটা রেকর্ড করে যেমন ফুয়েল, বাতাসের চাপ, অক্সিজেনের পরিমান, ইন্জিন এর কার্যক্ষমতা, শত্রুর মিসাইল অ্যাটাক হল কীনা এধরনের প্রায় ৮০ টির বেশী বিভিন্ন ডাটা রেকর্ড করে। এই এফডিআর কে রাখা হয় বিমানের সবথেকে নিরাপদ জায়গায় যেখানে রাখলে বিমান ধ্বংস হলেও এটা সুরক্ষিত থাকে। সাধারণত বিমান বা হেলিকপ্টারের লেজের দিকে এফডিআর কে রাখা হয়। 

এবার স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে বিমান দুর্ঘটনা ঘটলে ব্ল্যাকবক্সের মাধ্যমে তার কারন জানা যাবে কী করে? দেখুন ককপিট ভয়েস রেকর্ডার বা সিভিআর পাইলটদের কথা, যাত্রীদের প্রতি তাদের মেসেজ, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে পাইলটদের মেসেজ সব রেকর্ড রাখে। পরে এসব অ্যানলিসিস করে দুর্ঘটনার আগের মহূর্তের পরিস্থিতি জানা যায়। এর সাথে  দুর্ঘটনার আগের মহূর্তে বিমান টি কী সিগন্যাল দিয়েছিল সেটাও রেকর্ড থাকে। যেমন উদাহারন স্বরূপ একটি বিমান এর একটি ইন্জিন বিকল হয়ে গেলে প্যান প্যান প্যান বলে তিনবার সিগন্যাল দেয় যার অর্থ অর্ধেক এমারজেন্সি অবস্থা, একটা ইন্জিন বিকল হয়ে গেছে, আরেকটা ইন্জিনেও বিমান ল্যান্ড করতে পারবে। এবার বিমান বা হেলিকপ্টার এর দুটি ইন্জিনই বিকল হয়ে গেলে ” মে ডে,  মে ডে,  মে ডে” বলে সিগন্যাল পাঠায় যার অর্থ খুবই খারাপ অবস্থা বিমান এবার ধ্বংস হবে।

এবার আরও একটা প্রশ্ন সবার মনেই আসবে যে গোটা বিমান ধ্বংস হয়ে যায়  কিন্তু ব্ল্যাকবক্স ধ্বংস হয় না?? আপনাদের জানিয়ে রাখি ব্ল্যাকবক্স শকপ্রুফ, ওয়াটারপ্রুফ, ফায়ারপ্রুফ হয়ে থাকে। ব্ল্যাকবক্স তৈরি হয় বিশেষ সুপার স্টিল দিয়ে। বিমান বা হেলিকপ্টারে আগুন লেগে দুর্ঘটনা ঘটে, ব্ল্যাকবক্স এমনভাবে তৈরি হয় যাতে ২৬০ ডিগ্রির বেশী তাপমাত্রা সহন করতে পারে। এটি জলের গভীরতায় ৩০ দিন একাটানা সচল থেকে সিগন্যাল ছাড়তে থাকে। একটি বিমান যদি ৭৫০ কিমি/ঘন্টা গতিতে নীচে এসে মাটির সাথে সংঘর্ষে যদি ধ্বংস হয় তাহলেও ব্ল্যাকবক্সের কিছু হয় না। একটি ব্ল্যাকবক্সের উপর আড়াই টন ওজন এলেও এর কিছু হয় না। একটি ব্ল্যাকবক্স কে কোন কিছু দিয়ে কাটাও যায় না এতটাই শক্তিশালী এটা। একটি বিশেষ উপায়ে এটা খুলতে হয়। ১৯৬০ সালে ট্রান্স অস্ট্রেলিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নং ৫৩৮ কুইন্সল্যান্ডের কাছে দুর্ঘটনায় পরে ধ্বংস হয়ে যায়। তরপর থেকে অস্ট্রেলিয়া তাদের সমস্ত ব্ল্যাকবক্স রাখা বাধ্যতামূলক করে। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের প্রথম দেশ যারা সমস্ত ফ্লাইটে ব্ল্যাকবক্স রাখা বাধ্যতা মূলক করে। ১৯৬৪ সাল থেকে আমেরিকা ব্যবহার শুরু করে।  

কিছুদিন আগে হওয়া ভারতীয় বিমানবাহিনীর Mi-17v5 হেলিকপ্টারটির ও ব্ল্যাকবক্স সংগ্রহ করা হয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এতে দেখা গেছে লাস্ট মেসেজ রয়েছে ৫ মিনিটের মধ্যে হেলিকপ্টার বেসে ল্যান্ড করবে আর তারপরেই হঠাৎ ধ্বংস হয়ে যায়। আশ্চর্যজনক ব্যপার হচ্ছে পাইলট প্যান প্যান প্যান বা মে ডে বলে কোন মেসেজ ও পাঠায় নি, যার অর্থ হেলিকপ্টারে কোন টেকনিক্যাল সমস্যা ছিল না। Mi-17 একটি রাশিয়ান হেলিকপ্টার সেদিন যে হেলিকপ্টার টি ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা সর্বাধুনিক V5 মডেল। আর সিডিএস এর মতন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির হেলিকপ্টার নিশ্চয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ভাবে দেখা হয়। তাছাড়া সেদিন হেলিকপ্টার টি নিজের দিক ছেড়ে ভুল করে ৫০০ মিটার রাস্তা ভুল করেছিল, এত বড় ভিআইপি ব্যক্তির হেলিকপ্টারে এমন সমস্যা হবার কথা না। যাইহোক দিনের শেষে এটাও একটা মেশিন। আমাদের যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। চিরনিদ্রার দেশে উনি ভাল থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *