ডিফেন্স

ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। চীনকে পেছনে ফেলে সারা পৃথিবীতে যেভাবে ভবিষ্যতে টেকনো জায়েন্ট হতে চলেছে ভারতবর্ষ

অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে। ফাইনালি কেন্দ্রীয় সরকার বহু প্রতীক্ষীত সেমিকন্ডাক্টর ফিল্ডে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অ্যাপ্রুভাল দিয়ে দিল। এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিল ক্যাবিনেট কমিটি। আজকের এই স্টেপ ভবিষ্যতে ভারত কে টেকনো জায়েন্ট হতে সাহায্য করবে। আচ্ছা পুরো ব্যাপারটা ভালভাবে আলোচনা করা যাক। সেমিকন্ডাক্টর কী জিনিস, এর চাহিদা কেমন, এই সেক্টরে ভারতের ব্লু প্রিন্ট এবং কী কী অসুবিধা হতে পারে? 

আজ আমরা যে যুগে বাস করছি সেখনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ইলেকট্রনিকস এর ব্যবহার প্রচুর। বর্তমান যুগ ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার, আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের (AI). আর এই ইলেকট্রনিকস এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর চিপসেট। মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভি, ক্যামেরা, রেল ইঞ্জিন, বিমান, গাড়ি এমনকি এখন স্মার্ট ফ্যান, লাইটেও সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়। ভারতে যে পরিমান ইলেকট্রনিকস এর চাহিদা বাড়ছে তার একটা হিসাব আপনাদের বলি ২০১৪-২০২০ এই ৭ বছরে ভারতে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের ইলেকট্রনিকস তৈরি হয়েছে। ডাটা অনুযায়ী আগামী ৬ বছরে এর চাহিদা ৩০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হবে!!!!!! যদি ভারতীয় মুদ্রায় হিসাব করি তার পরিমান দাড়াবে ২০ লাখ কোটি টাকা। শুধু ভাবুন এত বিশাল মার্কেট ভারতের। ভারত সরকার ডিজিটাল ইন্ডিয়া ক্যাম্পেইন করছে, ডিজিটাল ইন্ডিয়া তৈরিতে যেসব ইলেকট্রনিকস লাগে তাতে সেমিকন্ডাক্টর গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এই ফিল্ডে ইনভেস্ট করলে তবে আমরা আত্মনির্ভর ভারতের দিকে আরও একস্টেপ এগিয়ে যাব।

একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন বর্তমানে একটি কাস্টমাইজ ভাল গাড়ি অর্ডার দিলে তা ম্যানুফাকচারিং হতে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগে তার একটা বড় কারন কী জানেন? এই চিপসেট কারন গাড়ির দরজা হ্যান্ডেলিং থেকে শুরু করে মিউজিক সিস্টেম সবেতেই এই চিপসেট দরকার। বিশ্বজুড়ে এই করোনা মহামারীতে সেমিকন্ডাক্টর চিপসেট উৎপাদন ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হয়েছে। একটি হিসাব অনুযায়ী এর জন্য বিশ্বজুড়ে শুধু অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি তে ক্ষতি হয়েছে ২১০ বিলিয়ন ডলার!!!!! 

ঠিক এরজন্যই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ক্যাবিনেট কমিটি সেমি কনডাক্টর ফিল্ডে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করল, আরও ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। যাতে ভবিষ্যতে  আমরা নিজেদের দেশেই পুরো একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারি। ভারতের অর্থনীতি কে ব্যাপক বৃদ্ধি করবে এই সেক্টর। ভারতবর্ষ সেমিকন্ডাক্টর এর প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। ডাটা অনুযায়ী ২০২০ পর্যন্ত ভারত সেমিকন্ডাক্টর আমদানি করেছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের, ২০২৫ এর মধ্যে এটি বেড়ে দাড়াবে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার। তাই এই ফিল্ডে সঠিক বিনিয়োগ করলে ২০২৫ এর মধ্যে আমাদের জিডিপি ৫ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ছুঁতে পারে।

আপনাদের ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে যে সেমিকন্ডাক্টর ফিল্ডে ভারত সরকার ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। তাহলে এটা হবে কী করে আসুন এটা জানা যাক। একটি সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম তৈরিতে প্রধান অংশ হচ্ছে সিলকন ফ্যাব্রিকেশন যা দিয়ে এই সেমিকন্ডাক্টর চিপসেট তৈরি হয়, তারপর আসে ডিসপ্লে ম্যানুফাকচারিং যেমন মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভির ডিসপ্লে, এরপর আসে কমপাউন্ড সেমিকন্ডাক্টর যাতে সিলিকন কার্বাইড, গ্যালিয়াম নাইট্রাইড ব্যবহার হয়। কম্পাউন্ড সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয় গাড়িতে, টেলিকম টাওয়ারে, রেল ইন্জিনে। সবশেষে আসে প্যাকেজিং,  এই পুরো প্রসেস ভারতে তৈরি হবে।এই মহূর্তে বিদেশের বড় বড় সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি তে যেসব ইন্জিনিয়ার রয়েছে তার ২০% ভারতীয়। সুতারং ভারতে প্রতিভার অভাব নেই বুঝতেই পারছেন। ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৮৫০০০ হাইলি কোয়াফাইড স্টুডেন্ট কে বিশেষভাবে ট্রেনিং দেবার, তার জন্য স্পেশাল একটি প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে যার নাম CTS বা চীপ টু স্টার্টআপ। এতো গেলো চীপসেট তৈরির প্রসেস। এবার আসে এই চিপসেট ডিজাইন প্রসেস, একটি চিপসেট যত ছোট হবে তত এর ডিজাইন ভাল হবে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা ডিজাইনার ভারত থেকেই তৈরি হয়। এর জন্য ভারত সরকার একটি নতুন প্যাকেজ ঘোষনা করেছে যার নাম DLI বা ডিজাইন লিংকড ইনশেনটিভ। এই প্যাকেজ অনুযায়ী একজন ডিজাইনার যাতে স্টার্টআপ তৈরি করতে পারে তার জন্য ভারত সরকার ৫০% আর্থিক সহায়তা করবে। কম্পাউড সেমি কনডাক্টর তৈরির ক্ষেত্রে ভারত সরকার ১৫-২০ টি বিশেষ ইউনিট তৈরি করবে যাতে ৩৫,০০০ হাইলি কোয়ালিফাইড চাকরি হবে এবং এক লক্ষ অন্যান্য জন হবে। ভারত সরকার আগামী ২০ বছরের জন্য পুরো একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে এই ভাবে। 

সেমিকন্ডাক্টর চীপসেট যত সাইজে ছোট হবে তত এর কোয়ালিটি ভাল হবে। এই মহূর্তে মোহালি তে ১৮০ ন্যানোমিটার প্ল্যান্ট রয়েছে আরও ২৮-৪০ ন্যানোমিটার প্রোডাকশন বৃদ্ধি হবে। ভারতের প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানি গুলো এই কাজে এগিয়ে এসেছে। টাটা গ্রুপ ৩০০ মিলিয়ন ডলারের একটি সেমিকন্ডাক্টর চীপসেট প্ল্যন্ট তৈরি করবে শোনা যাচ্ছে। ভেদান্ত গ্রুপ দক্ষিণ কোরিয়ার কোন কোম্পানির সাথে যৌথভাবে প্ল্যান্ট তৈরি করতে পারে, সাহাস্রা ইলেকট্রনিকস ও সেটআপ তৈরি করবে, আরও অনেক কোম্পানি রয়েছে। ইতিমধ্যে মিনিস্ট্রি অফ ইলেকট্রনিকস ও ইনফরমেশন টেকনোলজি জানিয়েছে তাদের কাছে বিদেশের অন্তত ২০ টি কোম্পানির প্রোপোজাল আছে ভারতে প্ল্যান্ট সেটআপের জন্য। সরকার কম সুদে লোন এবং ল্যান্ড ও দিতে পারে সংস্থা গুলিকে।

সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি তৈরির ক্ষেত্রে এই মহূর্তে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে আছে ভারত। এর বড় কারন জিও পলিটিক্স। এতদিন সেমিকন্ডাক্টর চিপসেটের জন্য ভারত, আমেরিকা, ইউরোপ চীন, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার উপর নির্ভর করত। আমেরিকা ও চীনের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই এর জন্য চীনের উপর নির্ভরতা কমাতে প্রত্যেকটি দেশ নিজেদের ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করছে যার জন্য এই সুযোগে চীন ও তাইওয়ান এর মধ্যে বিরোধিতার সুযোগে ভারত তাইওয়ানের সাথে কথা বলছে যাতে সেমি কনডাক্টর প্ল্যান্ট ভারতে তৈরি করা যায়।

সবশেষে একটা কথা যে এত প্ল্যান শুনতে ব্যাপক লাগলেও তার বাস্তবে রুপায়নে একটু সময় লাগবে কারন এই টেকনোলজি অত্যন্ত জটিল। এই ধরনের হাইলি অ্যাডভান্সড টেকনোলজির জন্য প্রয়োজনীয় সেটআপ তৈরিতে সময় লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা লোকাল প্রাইভেট কোম্পানি গুলো হার্ডওয়্যার ও ইলেকট্রনিকস নির্মানে এগিয়ে আসতে হবে। ২০২৫ এর মধ্যে ভারতে ৬০ বিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর লাগবে, ভারতের লক্ষ অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলারের প্রোডাক্ট ভারতে তৈরি করা। এছাড়াও আরও একটা সমস্যা আছে মেশিনারি। সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট তৈরি করতে অনেক বড় বড় মেশিনারি লাগে। আগে একটা মেশিনারি আমদানি করতে ১৬ সপ্তাহ লাগে। কিন্তু করোনা মহামারীর কারনে প্রত্যেক দেশ তাদের নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করছে যার জন্য এখন একটি মেশিনারি অর্ডার দিলে আসতে ৬২ সপ্তাহ সময় লাগবে। ইউরোপে আগে সেকেন্ডহ্যান্ড মেশিন পাওয়া যেত কিন্তু এখন সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না, এত ডিমান্ড। 

সুতরাং ভারত সরকারের এই স্কিম এর সুফল ৩-৪ বছর পর থেকে পাওয়া যাবে। তবে ভারত সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে ভারত ভবিষ্যতে সেমিকন্ডাক্টর পাওয়ার হাউস হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *