ডিফেন্স

১৯৭১ সালে সংঘটিত গরীবপুরের যুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেতে পাকিস্তানের ব্যাটেল ট্যাঙ্ক গুলিকে ভারতবর্ষের দ্য পাঞ্জাব রেজিমেন্ট যা করেছিল

নিউজ ডেস্কঃ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে কেটে গেছে বহু বছর। বাংলাদেশ এবং ভারতের বহু বীর সন্তানের কৃতিত্ব জড়িয়ে আছে এই জয়ের পেছনে। তবে, উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সংঘটিত গরীবপুরের যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জয়লাভের রাস্তা সহজ হতো না মোটেই। যুদ্ধ শুরুর আগে পূর্ব সেক্টরে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর দ্বারা অর্জিত এই সিদ্ধান্তমূলক জয় সম্পর্কে আজ আমরা জানবো কিছু তথ্য।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর সরকারিভাবে যুদ্ধ ঘোষণার আগেই ওই বছরের ২১ নভেম্বর ভারতের পূর্ব ফ্রন্টে একটি বড়সর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নভেম্বরের ওই দুর্ভাগ্যজনক দিনগুলিতে, ভারতীয় সেনা প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে এরকম বড় কোনো স্থল যুদ্ধ এবং বিমান সংঘর্ষে জড়িত হয়েছিল। পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে এই যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমেই পরবর্তীতে শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তীর দিকে ক্রমশ এগোচ্ছি আমরা। এমন গুরুত্বপূর্ণ এক মুহূর্তে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পুরোনো সেই বিজয়ের দিকে নেহাত ফিরে না তাকালেই নয়। 

১৯৭১ সালে, বছরের শুরুতেই ক্রমে অস্থিরতা বাড়তে আরম্ভ করেছিল ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে। ক্রমে সেই অস্থিরতা সংঘর্ষের আকার নেয় অক্টোবর মাসের পর থেকে। বয়রা সলিয়েন্টে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান থেকে ক্রমে ভারতের দিকে প্রসারিত আঙুল আকৃতির এক ছোট অঞ্চল হলো গরীবপুর। এই গরীবপুর প্রোট্রুশন এবং স্যালিয়েন্ট ব্যবহার করেই ভারতের সীমান্ত প্রদেশে এবং মূল স্থলভাগে আর্টিলারি ফায়ার অ্যাসাল্ট এবং হামলা চালাচ্ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। যুদ্ধের গুঞ্জন তখন শুরু হয়ে গেছিল সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেই। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী একত্রে টহল অভিযানের মাধ্যমে শত্রুদের আক্রমণ রোধে নিয়োজিত ছিল। 

সামরিক ভাষায় বলতে গেলে, প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানের উন্নতিসাধনের অর্থই হলো উভয় পক্ষের নিজ নিজ অবস্থান সুরক্ষিত করার জন্য নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ। অথবা, উদ্দেশ্যপ্রণিত ভাবে কোনো আক্রমণাত্মক অপারেশনের জন্য একটি লঞ্চপ্যাড ধরে রাখা এবং তার বিকাশ করা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গরীবপুর দখল করে তা পাকিস্তানি সেনার হাত থেকে সুরক্ষিত করে ভারতীয় সেনাবাহিনী আক্রমণের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবে। এই অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ১৪তম ব্যাটালিয়ন, দ্য পাঞ্জাব রেজিমেন্ট (নাভা আকাল) সহ ৪৫জন অশ্বারোহীকে নিয়ে গঠিত ‘সি’ স্কোয়াড্রনকে।

আক্রমণকারী বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল ২০-২১ নভেম্বর রাতেই নিরবে এক আক্রমণ হানার। সেই মত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ওপর নজরদারি চালানোর জন্য কয়েকজন ভারতীয় সেনা নিয়ে গঠিত এক দল মূল সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুটা এগিয়ে চালাতে থাকে টহলদারি। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় টহল বাহিনী সম্মুখীন হয়ে পড়ে পাকিস্তানের অপর এক টহল বাহিনীর সামনে। ফলে সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য। পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আর কে সিং সৈন্যদের নির্দেশ দেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গরীবপুর পুনর্দখলের চেষ্টা চালাতে।  ব্যাটালিয়নের চারটি কোম্পানী এবং ট্যাঙ্কের স্কোয়াড্রন প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর শেষ পর্যন্ত ২১ নভেম্বর ভোর ৩টার মধ্যে গরীবপুর দখল করতে সক্ষম হয়।  প্রথম থেকেই আশা রাখা হয়েছিল পাকিস্তান তাদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে পাল্টা আক্রমণ করবে।

ঠান্ডা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতেই ক্যাপ্টেন এম.এস-এর অধীনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সেনাদের নিয়ে গঠিত হয় এক দল। যার মধ্যে একজন আর্টিলারি পর্যবেক্ষককে আলাদা করে পাঠানো হয় পাকিস্তানী সেনার প্রত্যেক পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণের জন্য। ক্যাপ্টেন এম.এস এর বুদ্ধিমত্তা ভারতকে সেদিন বড়োসড়ো বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচায়। ব্যাটেলিয়ানের কাছে খবর আসে গরিবপুরের দিকে রাস্তা ধরে সার বেঁধে এগিয়ে আসছে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ট্যাংকগুলিকে প্রস্তুত করা হয়। পদাতিক বাহিনী বন্দুক হাতে গরীবপুর এলাকা দখল করে রেখেছিল এবং পাকিস্তানি চার্জের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ট্যাঙ্কগুলিকে আগেই পাঠানো হয়েছিল সামনের দিকে।

প্রত্যাশিতভাবেই পাল্টা আক্রমণ হয় এবং শত্রুরা তাদের ১০৭ পদাতিক ব্রিগেড এবং আমেরিকার তৈরি ৩ (স্বাধীন) আর্মার্ড স্কোয়াড্রনকে যশোর থেকে সরিয়ে গরীবপুরের উত্তর দিকে নয় কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায়।

পাকিস্তানের তরফে প্রথম আক্রমণটি ধেয়ে আসে সকাল ৬ টায়। কিন্তু, এরকম আকস্মিক এক আঘাতের জন্য প্রথম থেকেই প্রস্তুত ছিলেন ৪৫ জন অশ্বারোহীর নিয়ে গঠিত স্কোয়াড্রন “সি” এর কমান্ডার মেজর ডি এস নারাং। পাকিস্থানি সেনা দ্বারা অধিকৃত অঞ্চলগুলি থেকে তাদের তাড়িয়ে ভারতীয় সেনাকে সুরক্ষা প্রদান করার জন্য তিনি দক্ষতার সাথে  PT-76 লাইট ট্যাঙ্ক পরিচালনা শুরু করেন।জল ও স্থল উভয় জায়গাতেই এই ট্যাঙ্ক সমান ভাবে কাজ করতে সক্ষম হলেও শ্যাফের মতো প্রধান যুদ্ধ ট্যাঙ্কের তুলনায় এতে বর্ম সুরক্ষা ছিলো খুবই কম। 

পাকিস্তানি সেনার হাতে থাকা সামরিক অস্ত্রের তুলনায় PT-৭৬ অপেক্ষাকৃত হালকা এবং কম শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও এই ট্যাংকের প্রাণঘাতী ফায়ারেই পাকিস্তান নিজেদের বহু পদাতিক বাহিনী ও ট্যাঙ্ক হারিয়ে শেষ পর্যন্ত আক্রমণ বন্ধ করে। বীরের মতো যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও মেজর ডিএস নারাং মারাত্মকভাবে আহত হন। শেষপর্যন্ত শহীদ হন তিনি। পরবর্তীতে তিনি তার দুর্দান্ত নেতৃত্ব এবং বীরত্বের জন্য মহাবীর চক্রে ভূষিত হন।

পাকিস্তানি পদাতিক ব্রিগেড তাদের আক্রমণের গতি ও হিংস্রতা বাড়িয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর পর পর আরও তিনটি হামলা চালায়। পাকিস্তানের শেষ আক্রমণটি সেনাবাহিনীর ২৫ গজের মধ্যে এসে পৌঁছালেও ভয়ংকর সেই পরিস্থিতির মধ্যেই ১৪ পাঞ্জাব (নাভা আকাল) এবং ‘সি’ স্কোয়াড্রনের ৪৫ কোন অশ্বারোহী দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে শেষ অব্দি লড়াই চালিয়ে গেছিলো। যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্রন্ট লাইনে পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক। নিহত হন ৬০-৭০ জন, আহত হন ১০০ জন এবং ধ্বংস হয়ে যায় ১১ টি ট্যাঙ্ক। অপরদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মেজর ডিএস নারাং সহ নিহত হন আরো ৭ জন, আহত হন ২২ জন এবং ধ্বংস হয়ে যায় ৩টি ট্যাংক।

একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন এবং ট্যাংকার স্কোয়াড্রন পাকিস্তানি ব্রিগেডের আক্রমণ রদ করতে সক্ষম হয়।  চারটি পাকিস্তানি F-86 সাব্রে জেট সকাল ৯:৩০ নাগাদ ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হেনে সৈন্যবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায়  কদাদক নদীর প্রান্তে অবস্থিত ফেরিটি ক্ষতিগ্রস্ত করে।

নতুন করে পাকিস্তানের সাথে কোন রকম সংঘর্ষে জড়াতে না চাওয়ায় ২২ শে নভেম্বর এর আগে পর্যন্ত ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএএফ) অনুপ্রবেশকারীদের আক্রমণ করা থেকে রদ ছিলো ।তবে, ২২ সে নভেম্বরের পর সৈন্যদের ছাড়পত্র দেওয়া হয় অনুপ্রবেশকারী বিমানগুলিকে আটকানোর জন্য।  পাকিস্তানি সাবরে বিমান সেদিন পরপর তিনবার গরীবপুরে আক্রমণ চালিয়েছিল। শেষে, বিকেল ৩ টের সময় তৃতীয়বার আক্রমণের মাঝে আইএএফ তাদের দুটি Gnat এবং দুটি MIG যুদ্ধ বিমান নিয়ে ঘিরে ফেলে পাকিস্তানী বিমানগুলিকে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনটি সাবরে গুলিবিদ্ধ হয় এবং চতুর্থটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।এক্ষেত্রে উল্লেখ্য ভারতীয় পাইলটদের অসাধারণ দক্ষতার কারণে পাকিস্তানের সদ্য আমদানি করা উচ্চপ্রযুক্তির সাবরের বিরুদ্ধে  gnat এর সাফল্যের হার ছিলো এতোই বেশি যে ‘সাবরে কিলার’ উপাধি অর্জন করেছিল gnat গুলি।  

Gnats-এর পুরো বিভাগটি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম. এ গণপতি এবং ফ্লাইং অফিসার ডোনাল্ড লাজারাস উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন। অপরদিকে মিগ যুদ্ধবিমানগুলো ওড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন ফর্মেশন লিডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রয় অ্যান্ড্রু ম্যাসি এবং তার উইংম্যান হিসাবে ফ্লাইং অফিসার এস.এফ. সোয়ারেজ। যুদ্ধ শেষে এই চারজন পাইলটকে তাদের অপরিসীম বীরত্বের জন্য ভারত সরকারের তরফ থেকে বীর চক্রে ভূষিত করা হয়েছিল।

দুই পাকিস্তানি পাইলটকে সেই সময় মুক্তিবাহিনী বন্দী করে নিয়ে যায়।  এই পাইলটদের মধ্যে একজন ছিলেন পারভেজ মেহেদি কোরেশি। যিনি পরবর্তীকালে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর (পিএএফ) প্রধান হিসাবে ক্ষমতায় আসেন।

স্থলভূমি এবং আকাশপথ উভয় ক্ষেত্রেই এই যুদ্ধে ভারত জয় লাভ করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে সাহস এবং দক্ষতার সাথে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে ব্যাটালিয়ন শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে গরীবপুর দখল করতে সক্ষম হয়।  উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান, সামরিক অস্ত্র সমস্ত থাকা সত্বেও পাকিস্তানি বাহিনী আকাশপথে যেভাবে ভারতীয় সেনার কাছে হার মানতে বাধ্য হয় তা স্থল থেকেই প্রত্যক্ষ করেছিলো শত শত মানুষ। ভারতীয় সৈন্য এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছসিত করে মহাদেশের এই প্রথম বায়োবীয় যুদ্ধে সকলের সামনে ভারতীয় সেনা ধ্বংস করে পাকিস্থানের সাবরে যুদ্ধবিমান সহ মোট তিনটি বিমান। অপরদিকে সে তুলনায় ভারতীয় সেনার ক্ষয়ক্ষতি ছিল নেহাতই স্বল্প। ঘটনার পর থেকে পুরো যুদ্ধে পাকিস্তান আর কখনো আকাশপথে যুদ্ধের চেষ্টা করেনি।

১৯৯৬ সালের, উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা হলো এয়ার চিফ মার্শাল পারভেইজ এম কোরেশির PAF-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা। দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বয়ং গ্রুপ ক্যাপ্টেন ডোনাল্ড লাজারাস তাকে তার কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন যেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে যুদ্ধ চলাকালীন আকাশে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাদের দেখা হয়েছিল। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, লাজারাস আবার তার শুভেচ্ছা বার্তার প্রত্যুত্তরে পাকিস্তানের বিমান প্রধানের কাছ থেকে আরেকটি চিঠি পেয়েছিলেন। চিঠিতে লাজারাসকে ধন্যবাদ জানানোর সাথে সাথে পারভেইজ এম কোরেশি যুদ্ধের সময় লড়াইয়ের ময়দানে ভারতীয় পাইলটদের অদম্য সাহস এবং দক্ষতারও প্রশংসা করেছিলেন। ছোট ঘটনা হলেও দেশ ধর্ম নির্বিশেষে প্রকৃত যোদ্ধাদের মধ্যে সৌজন্যবোধ যে এখনো বজায় রয়েছে তা প্রমাণ করার জন্য এটিই হলো যথেষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *