অস্ত্র ক্রয় করার পেছনে ইসলামিক দেশগুলোর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। কত হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয় করছে তারা জানেন?
নিউজ ডেস্কঃ মধ্য প্রাচ্যের অশান্তি যে সারা পৃথিবীর মাথা ব্যাথার কারন তা আর নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে তাদের এই ঝামেলার মধ্যে রাশিয়া এবং আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসা ভালো ভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে আর তার ফলে প্রান হারাচ্ছে নিরীহ প্রচুর মানুষ। বিশেষ করে ইরান এবং সৌদি আরবের যে লড়াই তা আসতে আসতে সকলের সামনে আসতে শুরু করেছে।
ইউরোপ এবং আমেরিকার থেকে প্রচুর পরিমানে অস্ত্র ক্রয় করছে মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলি। এক একটি দেশ এতো পরিমানে অস্ত্র ক্রয় করছে যে আসতে আসতে তাদের অস্ত্র সম্ভার বিরাটভাবে বেড়েছে। একাধিক আন্তর্জাতিক সুত্রের মতে মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তির জন্য আলাদাভাবে অস্ত্র তৈরি করছে বেশ কিছু দেশ।
জার্মানের এক সংবাদমাধ্যমের মতে ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে যত পরিমানে অস্ত্র বিক্রি করা হয়েছে তার মধ্যে ৩৭ শতাংশ অস্ত্র বিক্রি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের অস্ত্রের বিরাট এক সম্ভার যায় আরবের দেশ গুলিতে। আমেরিকার তৈরি করা অস্ত্র রয়েছে সেখানকার দেশ গুলির হাতে। পৃথিবীতে যেসকল দেশ গুলি অস্ত্র বিক্রি করে তাদের মধ্যে প্রথম তিনটি দেশ হল আমেরিকা, রাশিয়া এবং ফ্রান্স।
মধ্য প্রাচ্যে ঝামেলার ফলে শেষ ৫ বছরে অস্ত্র ক্রয় দেখে অনেকেরই চিন্তা বেড়েছে। তার প্রধান কারন হল এই যে ২০১৬ থেকে ২০২০ এর মধ্যে অস্ত্র ক্রয় বেড়েছে ২৫ শতাংশ। বর্তমানে সৌদি আরব সব থেকে বেশি অস্ত্র ক্রয় করে থাকে। তাদের অস্ত্র ক্রয় বেড়েছে ৬১ শতাংশ।
ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহ দমন করার জন্য বিরাটভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে সৌদির জোট। তাদের সাথে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, কুয়েত, জর্ডান এবং বাহরাইন। ৬ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রান হারিয়েছে প্রায় ২ লক্ষ ৩৩ হাজার মানুষ।
আবারও অন্যদিকে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে দুই পক্ষকে মদত দিয়েছিল কাতার, তুরস্ক, আরব আমিরাত এবং মিশরের মতো দেশ। কাতারের অস্ত্র ক্রয়ের পরিমাণ বহুগুন বেড়েছে। কিছু মাস আগেই আরব আমেরিকা থেকে ৫০ তি এফ ৩৫ এর মতো যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছে। পাশাপাশি ১৮ টি ড্রোন। মোট ২ হাজার ৩০ কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে তারা। শুধু তাই নয় কোন কোন দেশ অস্ত্র ক্রয় করেছে তা ঠিকমতো ভাবে জানা না গেলেও ২০২০ সালে ৫ টি দেশ ১৯৫ কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে জার্মানের থেকে।
তবে এর মধ্যে সবথেকে বেশ অস্ত্র ক্রয় করেছে মিশর।ক্রেতা আরব দেশগুলো এসব অস্ত্র প্রধানত ইয়েমেন আর লিবিয়ায় প্রাণঘাতী যুদ্ধে ব্যবহার করছে।
ডোনাল্ড ট্র্যাম্প প্রেসিডেন্ট থাকার সময় একাধিক বেফাঁস মন্তব্য করেছিলেন। তবে তার মধ্যে যে প্রচুর ঠিক কথা বলে গেছেন তা অনেকেরই জানা। ২০২০ সালে তিনি একবার বলেছিলেন যে “ নিজের বাড়ির ভাড়াটিয়ার থেকে অর্থ আদায়ের থেকে অনেক বেশি সহজ আরবের দেশ গুলির থেকে অর্থ আদায় করা”। অর্থাৎ আরবের মতো দেশ গুলির থেকে সামরিক অস্ত্র বিক্রি করে অর্থ আদায় করা অনেকবেশি সহজ। এই কথা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হলে কথাটি যে কতোটা সত্য তা বেশ ভালো করেই জানেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসার রমরমা ছিল। মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলিতে প্রচুর টাকার অস্ত্র ব্যবসা করেছে আমেরিকা।
আমেরিকা ইউরোপের মতো দেশ গুলি যে অস্ত্র বিক্রি করছে মধ্য প্রাচ্যে তার বেশিরভাগতটাই চলে যাচ্ছে আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরান, কাতার, কুয়েত, ওমান, এবং মিশরসহ অন্যান্য আরব দেশগুলোতে। ইসরায়েল, ইরান এবং তুরস্কের ভীতিকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর পরিমানে অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। যেখানে অত্যাধুনিক টেকনোলোজির যুদ্ধাস্ত্র বেশি পরিমানে রয়েছে। ২০১০ সাল থেকে বিরাটভাবে ঝামেলা বৃদ্ধি পেয়েছে মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলির মধ্যে। শুধু টাই নয় পাশাপাশি সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেনের সাথে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ লেগেই রয়েছে। আর এই কারনে মধ্যে প্রাচ্যের দেশ গুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সন্দেহ এবং অবিশ্বাস রয়েছে। অন্যদিকে আবার আমেরিকা, রাশিয়ার পাশাপাশি শক্তিধর বেশ কিছু রাষ্ট্র যেমন সৌদি আরব, তুরস্ক এবং ইরান মধ্য প্রাচ্যে চরম মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করেছে। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য অস্ত্র ক্রয় করার প্রবনতা বাড়ছে বিরাটভাবে। একে অপরের সাথে যুদ্ধ করার মতো প্রবণতা চোখে পড়ছে। আর এই সুযোগ নিয়ে সারা পৃথিবীতে অস্ত্র তৈরিকারী দেশ এবং কর্পোরেশনগুলো মধ্যপ্রাচ্যে শত বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম বিক্রি করছে।
মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করলেও তাদের কাছে অভিজ্ঞ পাইলট না থাকার ফলে একাধিক অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। সবথেকে বড় ব্যাপার হল এই যে এই প্রানঘাতি যুদ্ধাস্ত্রের একটি বড় অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। আর এতে করে হাজারো নিরীহ মানুষের মৃত্যু এবং মানবতা মারাত্বকভাবে ধ্বংস হলেও কিন্তু থেমে নেই অস্ত্র বানিজ্য আর প্রভাব বিস্তারের অশুভ প্রতিযোগিতা।
মধ্য প্রাচ্যের অন্যতম ধনী দেশ গুলি সামরিক ক্ষমতা এতো বেশি কোনোদিন সেভাবে ছিলনা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অস্ত্র ক্ররার হার দেখে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে রয়েছে বেশ কিছু দেশ।
কূটনৈতিক ভাবে দেখেতে গেলে বেশ কিছু দেশের সাথে আরবের দেশ গুলির সম্পর্ক আবার ভালো হচ্ছে। কারন ২০২০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্যাম্প ৫০ টি এফ ৩৫ এবং ১৮ টি কমব্যাট ড্রোন বিক্রি করার অনুমতি দিয়ে ২৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সাক্ষরিত করেন। পরে বাইডেন শাসনকালেও ঠিক তাই হয়। যদিও একাধিক বিশেষজ্ঞদের মতে ইসরায়েলের সাথে আরবের কূটনৈতিক সম্পর্ক ঠিক করার জন্য এটি করা হয়। কারন এই এফ ৩৫ এর এক বিরাট প্রডাকশান হয় ইসরায়েলে।
পাশাপাশি আরবের অন্যতম ধনী দেশ বাহরাইনের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক ভালো হাওয়ার অন্যতম কারন হল তাদের মূল টার্গেট ইসরাইলের থেকে প্রচুর পরিমানে অত্যাধুনিক সামরিক সাজ সরঞ্জাম, অস্ত্র এবং ড্রোন ক্রয় করা। আর তার প্রধান কারন হল মধ্যপ্রাচ্যের ইরান এবং তুরস্ককের প্রভাব প্রতিহত করা। সেইকারনে আরব আমিরাতের পথ অনুসরণ প্রাণঘাতী অস্ত্র সজ্জিত রাখতে নির্বিচারে অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছে বাহরান, কাতার, কুয়েত, ওমান, মিশরসহ অন্যান্য আরব দেশগুলো।
তবে অন্যদিকে আবার কাতারের মতো দেশ বারবার হুমকির কারনে প্রচুর পরিমানে অস্ত্র ক্রয় করতে বাধ্য হয়েছে। তারা তাদের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের সাথে ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নজিরবিহীনভাবে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অধিক যুদ্ধবিমান, ট্যাংক এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম আমদানি বা ক্রয়ের জন্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। কাতারের সরকার তাদের বিমানবাহিনীকে আধুনিক করতে ৯৬ টি নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ক্রয় করতে ইতিমধ্যে আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাথে ২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সম্পন্ন করেছে। যদিও কাতারের এই ৯৬ টি যুদ্ধবিমান ক্রয় করা দেখে বেশ কিছু দেশ একটু হতবাকই হয়েছেন। তবে একটা কথা না বললেই নয় যে এরফলে বিশেষ ভাবে লাভবান হচ্ছে আমেরিকা এবং ফ্রান্সের মতো দেশ গুলি। স্টকহোম ইন্টারন্যশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে পৃথিবীর ১০ টি সমরাস্ত্র কোম্পানির তিনটি রয়েছে চিনে। বর্তমানে সবথেকে বেশি অস্ত্র আমেরিকা তৈরি করলেও চীনের অবস্থান ঠিক তারপরেই। তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়ার মতো দেশ।পৃথিবীর সবথেকে বড় ১০টি সমরাস্ত্র নির্মাতা কোম্পানির তালিকায় প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যন্ত দখল করে আছে আমেরিকার চারটি কোম্পানি। এগুলো হল যথাক্রমে লকহিড মার্টিন, বোয়িং, নরথ্রোপ গ্রুম্যান এবং রেথিয়ন। আমেরিকার লকহিড মার্টিন পৃথিবীর সবথেকে বড় সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান গুলি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রাণঘাতি অস্ত্র রফতানি করে পুরো পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।