অফবিট

চীনের বিআরআইকে এড়িয়ে ভিন্নপথে রাশিয়ার সাথে বানিজ্য শুরু ভারতের

প্রথমবারের জন্য রাশিয়ার সাইবেরিয়ার কুজবাস এলাকা থেকে দুটি ট্রেন কয়লা নিয়ে কিমেরোভো অঞ্চলের মাধ্যমে আইএনএসটি নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়েছে এবং এই পথে কাজাখিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান হয়ে ইরানের বন্দর আব্বাসে কয়লা বহন করে নিয়ে এসেছে। বন্দর আব্বাস থেকে কয়লা জাহাজে করে মুম্বাই বন্দরে এসেছে। আইএনএসটি বা ইন্টারন্যাশনাল নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর একটি ৭,২০০ কিলোমিটার লম্বা রেলপথ যা রাশিয়া, আজারবাইজান, ইরান, মধ্য এশিয়া ও ভারতকে সংযুক্ত করেছে। জাহাজ, রেলপথ ও সড়কপথে পন্য পরিবহনের জন্য এই নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। মুম্বাই, মস্কো, তেহরান, বাকু, বন্দর আব্বাস, আস্ট্রখান, বন্দর আনজালির মতো গুরুত্বপূর্ন শহরগুলোর মধ্যে বানিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করার জন্য এই করিডর তৈরি করা হয়েছে। তবে আইএসটিসি প্রজেক্টে নিত্যনতুন দেশকে যুক্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এগারোটি মধ্য এশিয়ান দেশ এই প্রজেক্টে যুক্ত রয়েছে। এই পুরো প্রজেক্ট পূর্ব ও পশ্চিম দুইভাগে বিভক্ত। এবার রাশিয়া থেকে কাজাখিস্তান, তুর্কিমেনিস্থান ও ইরান হয়ে কয়লা ভারতে এসেছে। রাশিয়া থেকে ভারতে এই কয়লা আসার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। 

বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়া সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ন দেশ। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে রাশিয়া। কিন্তু তার মধ্যেও ভারত ও রাশিয়ার কুটনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্পর্ক যথেষ্ট মজবুত। ভারত থেকে রাশিয়াতে রপ্তানি ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ঠিক তেমনি রাশিয়া থেকেও ভারতে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে বিশেষ করে খনিজ তেলের। রাশিয়া থেকে সাধারনত সমুদ্রপথে কোনও জিনিস ভারতে আসে। কিন্তু সমুদ্রপথে পন্য পরিবহনে বেশ কীছু সমস্যা রয়েছে। যেমন 

আন্তর্জাতিক স্তরে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার কারনে কখনও কোনও দেশ রাশিয়ান জাহাজ আটকে দিতে পারে। তাছাড়া হর্ন অফ আফ্রিকা ও আরব সাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের আক্রমন ও হুথী বিদ্রোহীেদর আক্রমনের ভয়ও রয়েছে। এসব কারনে জাহাজের ইনসিওরেন্স বেড়ে যায় এবং পন্যের দামও বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া সমুদ্রপথে সরাসরি রাশিয়া থেকে ভারতে পন্য পরিবহনে অন্তত ৩০-৪০ দিন সময় লাগে। কিন্তু আইএনএসটি ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে মাত্র দশদিনে ভারতে পন্য আনা সম্ভব। আইএনএসটি ব্যবহার করলে রাশিয়া থেকে ভারতে পন্য আনতে ৩০ শতাংশ খরচ কম হয় এবং ৪০ শতাংশ সময় বেঁচে যায়। এই করিডর ব্যবহার করলে সুয়েজ খাল ও চীনের বেল্ট এন্ড রোড বা বিআরইকেও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। ভারত তার শক্তি চাহিদার ৮০ শতাংশই বাইরে থেকে আমদানি করে সুতরাং আইএনএসটি করিডর ব্যবহার করলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর শক্তির ব্যাপারে ভারতের নির্ভরতা কমবে। ভারত অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের উপর জোর দিলেও এখনও এই বিভাগে যথেষ্ট সময় লাগবে সেজন্য আরও কয়েক দশক কয়লার চাহিদা থাকবেই ভারতের। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়া খনিজ তেল ও কয়লার দাম যথেষ্ট কমিয়ে দিয়েছে। যার জন্য ভারত রাশিয়া থেকে যথেষ্ট পরিমানে কয়লা ও খনিজ তেল কিনছে। 

২০২৩-২৪ সালে ভারত রাশিয়া থেকে ১৫.১ মিলিয়ন টন কয়লা কিনেছে। রাশিয়া থেকে কম দামে এত বেশী পরিমান কয়লা কেনার ফলে অস্ট্রেলিয়ার থেকে কয়লা কেনা কমিয়ে দিয়েছে ভারত। ২০২১-২২ সালে যেখানে ভারত রাশিয়া থেকে তার মোট চাহিদার ৮ শতাংশ কয়লা কিনতো সেখানে ২০২৩-২৪ সালে ভারত ২১ শতাংশ কয়লা কিনেছে রাশিয়া থেকে। এই কারনে আইএনএসটি করিডর ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। ২০০২ সালে ভারত, রাশিয়া ও ইরান এই আইএনএসটি প্রজেক্ট শুরু করেছিল। প্রথম থেকেই আইএনএসটিকে মাল্টিমোডাল অর্থাৎ রেল, সড়কপথ ও সমুদ্রপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে ২০০২ সালের দিকে রাশিয়া এই প্রজেক্টে তেমন আগ্রহ দেখায়নি কারন সেসময় ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে বানিজ্য কম হত কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ন বিপরীত। বরাবর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছিল রাশিয়ার প্রধান বাজার। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় রাশিয়ার ভারত ও চীনের মতো নতুন বাজারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রাশিয়ার সাথে সরাসরি স্থল পথে চীনের যোগাযোগ রয়েছে কিন্তু ভারতের নেই। সেজন্য রাশিয়া আইএনএসটির কাজ দ্রুতগতিতে করছে। বেশীরভাগ মধ্য এশিয়ান দেশ একটা সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল যার জন্য এসব দেশগুলোর মধ্যে রেল সংযোগ রয়েছে। যেমন আজারবাইজান একটা সময় সোভিয়েত ভুক্ত দেশ ছিল যার জন্য রাশিয়ার সাথে আজারবাইজানের রেল যোগাযোগ রয়েছে। তবে মধ্য এশিয়ার একটি দেশ ইরানের সাথে রাশিয়ার বর্তমানে কুটনৈতিক সম্পর্ক ভালো হলেও অতীতে দুই দেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক ততটা মজবুত ছিলনা, যার জন্য রাশিয়া থেকে ইরান পর্যন্ত ট্রেন যোগাযোগ নেই। এজন্য রাশিয়া দুটি ইরানিয়ান শহর রাস্ট ও আস্তারার মধ্যে ১৬৪ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন নির্মান করছে যার মাধ্যমে ইরানের বন্দর আব্বাসে পন্য পরিবহন আরও সহজ হবে। এই পুরো প্রজেক্টে রাশিয়ার ১.৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। আইএনএসটিতে নতুন নতুন অনেক সদস্য যুক্ত করা হচ্ছে। যেমন ইরানের চাবাহার বন্দরকে যুক্ত করা হয়েছে এই প্রজেক্টে। চাবাহার বন্দর থেকে সরাসরি আফগানিস্তানে যোগাযোগ সম্ভব। এর আগেও আইএনএসটি করিডরের মাধ্যমে কীছু জিনিস ভারতে আনা হয়েছিল কিন্তু সেটা পশ্চিম আইএনএসটি করিডরের মাধ্যমে। পূর্ব আইএনএসটি করিডরের মাধ্যমে এইপ্রথম কোনও দ্রব্য ভারতে আনা হল। কিন্তু এই করিডরের কিছু সমস্যাও আছে যেমন নার্গোনা কারবাখের অঞ্চল নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হয় যা আইএনএসটি করিডরের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া এই করিডরের বেশীরভাগ পরিকাঠামোই সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ের তৈরি, এগুলো আপগ্রেড করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *