মাকড়সার জালের মতোন সূড়ঙ্গ। জম্মু কাশ্মীর ও লাদাখে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে যে প্ল্যান
১৫ এপ্রিল, ২০১৩ সালে ৫০ জন চাইনিজ সেনা এলএসি অতিক্রম করে ডেপসাং এলাকায় প্রবেশ করে। পরেরদিন এই ঘটনা লক্ষ্য করে আইটিবিপি চীনের সেনার ৩০০ মিটার দূরে নিজেদের ঘাঁটি তৈরি করে। পরবর্তী তিন সপ্তাহ পর্যন্ত উভয়পক্ষের সেনাই সেখানে উপস্থিত ছিল। ৫ মে ভারত ও চীনের মধ্যে আলোচনার পর চীনের সেনাবাহিনী সরে যায়। উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনায় ভারত ২৫০ কিলোমিটার দূরে চুমার বিভাগে বাঙ্কার তৈরি থেকে নিরত হয়, এরপরেই চীনের সেনাবাহিনী এখান থেকে সরে যায়। চুমার বিভাগে ভারতের বাঙ্কার নির্মানকে চীন তাদের জন্য হুমকী মনে করছিলো। আকসাই চীনে লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসির কাছে দৌলত বাগ ওল্ডি ত্রিশ কিলোমিটার দক্ষিনে এই ঘটনা হয়েছিল যার জন্য এই ঘটনা ডেপসাং স্ট্যান্ডঅফ বা দৌলত বেগ ওল্ডি ঘটনা নামে পরিচিত। এই ঘটনার সময় চাইনিজ সেনাবাহিনী ট্রাক ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে লজিস্টিক সরবরাহ পাচ্ছিল কিন্ত সেই তুলনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর লজিস্টিক সরবরাহ অনেকটাই দুর্বল ছিল যার জন্য সেসময় চীনের কথা মানতে বাধ্য হয় ভারত। এই ঘটনার পর ২০২০ সালে পুনরায় চাইনিজ সেনাবাহিনী এই অঞ্চল থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিনে গালওয়ান উপত্যকাতে পুনরায় অভিযানের চেষ্টা করেছিল কিন্তু এবার আধুনিক সড়ক থাকার কারনে এবং দ্রুত লজিস্টিক সরবরাহের কারনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে পীছু হটতে বাধ্য হয়ে চীনের সেনাবাহিনী। ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার পাকিস্তান ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকার উন্নয়ন শুরু করে যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী শক্তিশালী হয়। বিআরও বা বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন সীমান্তবর্তী এলাকায় উন্নয়নের জন্য একাধিক আধুনিক সড়ক ও সূড়ঙ্গ নির্মান করছে যাতে সব আবহাওয়াতেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনও সমস্যা না হয়। ভারত সরকারের নীতির কারনে ২০১৩ সালের তুলনায় বর্তমানে চীন ও পাকিস্তান সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী বর্তমানে আরও অনেক বেশী শক্তিশালী। মোদী সরকার সীমান্তবর্তী এলাকায় পরিকাঠামো উন্নয়নে সর্বোচ্চ জোর দিয়েছে। ভারত সরকার জম্মু কাশ্মীরে ও লাদাখে চীন ও পাকিস্তান সীমান্তে রেকর্ড সংখ্যক স্ট্রাটেজিক সূড়ঙ্গ তৈরি করছে যা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য করে তুলবে।
২০১৩ সালের ডেপসং স্ট্যান্ডঅফ হোক কিংবা ২০১৭ সালের ডোকলাম স্ট্যান্ডঅফ অথবা ২০২০ সালের গালওয়ান ঘটনা সবক্ষেত্রেই চীনের সেনাবাহিনী আগে বিতর্ক তৈরি করেছে। চীন এলএসির আশেপাশে পরিকাঠামো উন্নয়ন অনেক আগেই করে ফেলেছে। এলএসির কাছে চীন আধুনিক সড়ক, এয়ারফিল্ড ভারতের আগেই তৈরি করেছে। যার জন্য চীনের সেনাবাহিনী বারবার বিতর্ক তৈরি করে এলএসি পেরিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করতে থাকে। এর জন্য ভারতেরও প্রয়োজন এলএসির কাছে এমন সড়ক নির্মান যাতে সারাবছর ভারতীয় সেনাবাহিনী এলএসিতে পৌঁছাতে পারে এবং লজিস্টিক সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন থাকে। ঠিক এইজন্যই প্রয়োজন স্ট্রাটেজিক সূড়ঙ্গ যা সড়কের মাধ্যমে এলএসিকে সারাবছর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যবহারের উপযুক্ত করে রাখবে। ভারত চীন সীমান্ত বা এলএসি এবং ভারত পাকিস্তান সীমান্ত এলওসি বা লাইন অফ কন্ট্রোলে ব্যাপক পরিকাঠামো উন্নয়ন শুরু করেছে। জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের এমন একটি রাজ্য যা এলওসি এবং এলএসি উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।
জম্মু ও কাশ্মীরের লাইফলাইন বলা হয় ৪৪ নং জাতীয় সড়ককে যা পরীপঞ্জাল পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরকে সংযুক্ত করেছে। জম্মু ও শ্রীনগরের মধ্যে বানিহাল পাসকে এড়াবার জন্য ১৯৫৬ সালেই ২.৮৫ কিলোমিটার লম্বা জওহর সূড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। এই রাস্তাতেই ২০২১ সালে তৈরি করা হয়েছে বানিহাল কাজিগুন্ড সূড়ঙ্গ যার দৈর্ঘ্য ৮.৪৫ কিলোমিটার। পুরোনো হয়ে যাওয়া জওহর সূড়ঙ্গের বিকল্প এটি। এই বানিহাল কাজিগুন্ড সূড়ঙ্গ জম্মু ও শ্রীনগরের মধ্যে দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার কম করে দিয়েছে, এর ফলে জম্মু থেকে শ্রীনগর পৌঁছাতেও আরও ত্রিশ মিনিট সময় কম লাগছে। এছাড়া জম্মু কাশ্মীরে বানিহাল কাজিগুন্ড রেলওয়ে সূড়ঙ্গও তৈরি করা হয়েছে যার দৈর্ঘ্য ১১.২১ কিলোমিটার। সীমান্তের কাছে রেলওয়ে টানেলের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী।
জম্মু কাশ্মীরে পাটনিটপ, কুড ও বাটোট অঞ্চলের বিকল্প হিসাবে ২০১৭ সালে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি সূড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে যার দৈর্ঘ্য ৯.২৮ কিলোমিটার। এই সূড়ঙ্গের জন্য জম্মু ও শ্রীনগরের মধ্যে দূরত্ব ত্রিশ কিলোমিটার এবং যাত্রা সময় দুই ঘন্টা কম হয়েছে। বানিহাল কাজিগুন্ড সূড়ঙ্গ এবং ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি সূড়ঙ্গ তৈরি হওয়ার আগে জম্মু থেকে শ্রীনগর পৌঁছাতে আট থেকে নয় ঘন্টা সময় লাগতো কিন্তু এই দুটি সূড়ঙ্গ তৈরি হওয়ার পর জম্মু থেকে শ্রীনগর পৌঁছাতে ৫.৫ ঘন্টা সময় লাগে। এছাড়া জম্মু কাশ্মীরে শুধমহাদেব সূড়ঙ্গ, খেল্লানি সূড়ঙ্গ ও নন্দী সূড়ঙ্গ নির্মীয়মান রয়েছে। এসব সূড়ঙ্গ নির্মান সম্পূর্ন হলে জম্মু থেকে শ্রীনগর পৌঁছাতে চার ঘন্টা সময় লাগবে। এই সমস্ত সূড়ঙ্গই জাতীয় সড়ক ৪৪ এর উপর তৈরি করা হয়েছে বা নির্মীয়মান রয়েছে। জম্মু কাশ্মীরে জাতীয় সড়ক ১৪৪এ পুঞ্চকে আখনুর এবং আখনুরকে জম্মুর সাথে সংযুক্ত করেছে। এই জাতীয় সড়ক এলওসির সমান্তরালে রয়েছে যার জন্য এই পথ ভারতের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ন। এইপথে চারটি গুরুত্বপূর্ন সূড়ঙ্গ কান্ডি সূড়ঙ্গ, নৌশেরা সূড়ঙ্গ, সুঙ্গাল সূড়ঙ্গ ও ভিম্বার গলি সূড়ঙ্গ নির্মান চলছে।
২০২৪ সালের মধ্যে এই চারটি সূড়ঙ্গ নির্মানই সম্পূর্ন হয়ে যাবে। এই চারটি সূড়ঙ্গ নির্মানের ফলে এলওসিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লজিস্টিক সরবরাহ সারাবছরই বজায় থাকবে, এর পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতিও মজবুত হবে। জম্মু কাশ্মীরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ন রাস্তা হচ্ছে কাঠুয়া বাদেরওয়া জাতীয় সড়ক যা শ্রীনগর ও কাঠুয়াকে সংযুক্ত করেছে। এখানে ৬.৮ কিলোমিটার লম্বা ছাত্তেরগালা সূড়ঙ্গ নির্মানের কাজ চলছে। ৪০০০ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত এই সূড়ঙ্গ জম্মু ও কাশ্মীরের কাঠুয়া এবং ডোডা জেলাকে সংযুক্ত করেছে। ২০২৭ সালের মধ্যে এই সূড়ঙ্গ নির্মান সম্পূর্ন হয়ে যাবে। এছাড়া জাতীয় সড়ক ৫০১ এর উপর অমরনাথ যাত্রার জন্য শেষনাগ সূড়ঙ্গ, পীর কী গালি সূড়ঙ্গ ও সাধনা সূড়ঙ্গ নির্মানের কাজ চলছে। এসব সূড়ঙ্গ নির্মানের কাজও ২০২৭ সালের মধ্যে সম্পূর্ন হয়ে যাবে।
জম্মু কাশ্মীরে জাতীয় সড়ক ১ শ্রীনগর, কার্গিল ও লেকে সংযুক্ত করেছে। এলওসি এবং এলএসি উভয় জায়গার জন্যই এই সড়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। ২০২৩ সালে এই সড়কে তিনটি প্রধান গুরুত্বপূর্ন সূড়ঙ্গ নির্মান করা হয়েছে, ৬.৫ কিলোমিটার লম্বা জেড মোড় সূড়ঙ্গ, ১৪.২ কিলোমিটার লম্বা জোজিলা সূড়ঙ্গ এবং ২ কিলোমিটার লম্বা নীলগারার সূড়ঙ্গ। আগে শ্রীনগর থেকে লে যেতে ১৩-১৪ ঘন্টা সময় লাগতো এবং শীতকালে তীব্র তুষারপাতে প্রায়ই সড়ক বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু এই তিনটি সূড়ঙ্গ নির্মানের ফলে শ্রীনগর থেকে লে যেতে নয় ঘন্টা সময় লাগছে বর্তমানে এবং সড়ক সারাবছর খোলা থাকছে। এই রাস্তায় কার্গিল থেকে লে পর্যন্ত আরও দুটি সূড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছে নামিকা লা সূড়ঙ্গ এবং ফোটু লা সূড়ঙ্গ। এছাড়া কার্গিল থেকে বাতালিক পর্যন্ত রাস্তায় জান্সকার পার্বত্যঞ্চলের মধ্যে দিয়ে হামবোটিং লা সূড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছে। লেকে সিয়াচেন ও কারাকোরাম পাসের সাথে সংযুক্ত করার জন্য খারদুংলা সূড়ঙ্গ নির্মান করা হচ্ছে যা খারদুংলা পাসের বিকল্প।
২০২৭ সালের মধ্যে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হয়ে যাবে। ডেপসাং এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য সাসের লা সূড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে লে পৌঁছানোর জন্য দুটি প্রধান পথ রয়েছে একটি হচ্ছে জাতীয় সড়ক ১ যা শ্রীনগর, কার্গিল হয়ে লে পর্যন্ত গেছে এবং আরেকটি হচ্ছে জাতীয় সড়ক ৩ যা মানালি কেলং হয়ে লে পর্যন্ত গেছে। মানালি ও কেলং এর মধ্যে হিমাচল প্রদেশে ২০২০ সালে ৯.০২ কিলোমিটার লম্বা অটল সূড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে ইতিমধ্যেই। তবে এই অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা আরও সহজ করার জন্য আরও তিনটি সূড়ঙ্গ নির্মান চলছে, বারালাচ্ছা লা সূড়ঙ্গ, লাচুং লা সূড়ঙ্গ এবং তাংলাং লা সূড়ঙ্গ। ২০২৭ সালের মধ্যে এই সমস্ত সূড়ঙ্গ নির্মান সম্পূর্ন হয়ে যাবে। এর ফলে মানালি থেকে লে পৌঁছাতে চার ঘন্টারও কম সময় লাগবে। এছাড়া ভারত সরকার লেতে পৌঁছানোর জন্য তৃতীয় আরেকটি রাস্তা তৈরি করেছে। সাহারানপুর, পন্টা সাহিব, কাজা, প্যাংগং লেক, চসুল হয়ে লে পর্যন্ত এই রাস্তা ২০২৯ সালের মধ্যে সম্পূর্ন হয়ে যাবে। এই রাস্তায় নয়টি স্ট্রাটেজিক সূড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছে। এই রাস্তার মাধ্যমে প্যাংগং লেকের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন অঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরও দ্রুত লজিস্টিক সরবরাহ করা সম্ভব হবে।