অফবিট

ভারত সরকারের জম্মু বারামুল্লা রেলপথ। কাশ্মীর উপত্যকাকে ভারতের বাকী অংশের সাথে যুক্ত

অসাধারন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারনে জম্মু কাশ্মীরকে পৃথিবীর স্বর্গ বলা হয়। যার জন্য প্রতিবছর ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর পর্যটক এখানে ছুটে আসে। কিন্তু অসাধারন সৌন্দর্যের অধিকারী কাশ্মীর উপত্যকা শুধুমাত্র সড়কপথে ভারতের বাকী অংশের সাথে যুক্ত ছিল এতদিন। শ্রীনগরকে জম্মুর সাথে যুক্ত করে জাতীয় সড়ক ৪৪, কিন্ত এই সড়কপথে প্রায়ই পাহাড়ধ্বস অথবা তুষারধ্বস দেখা যায়। শীতকালে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়। অত্যাধিক তুষারপাত ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারনে কখনও কখনও কয়েক সপ্তাহ এই পথ বন্ধ থাকে। এছাড়া জম্মু কাশ্মীর স্ট্রাটেজিক ভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। জম্মু কাশ্মীরের সাথে পাকিস্তানের ১,২০০ কিলোমিটার লম্বা সীমানা রয়েছে যাকে এলওসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বলা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘকাল ধরে পাকিস্তান কাশ্মীরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে এই অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি করতে চেষ্টা করেছিল। তাছাড়া আকসাই চীনে চীনের সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারনে কাশ্মীর উপত্যকা সহ লাদাখ উপত্যকাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী সবসময় মোতায়েন রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহসিকতার কারনেই পাকিস্তান ও চীনের সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গিয়ে কাশ্মীর আবারও তার পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছন্দে ফিরেছে। কিন্তু এত পর্যটকের চাপ সামলানোর জন্য কাশ্মীরে সংযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রয়োজন ছিল। এই কারনেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রক উধামপুর বারামুলা রেলওয়ে প্রজেক্টের সূচনা করেছে। এইপথে রেললাইন নির্মানের জন্য ভারতীয় ইঞ্জিনিয়াররা একের পর এক রেকর্ড তৈরি করে চলেছে।

জম্মু থেকে বারামুল্লা পর্যন্ত ৩৩৮ কিলোমিটার লম্বা রেলওয়ে লাইন তৈরি করছে রেলমন্ত্রক, যাতে জম্মু থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সংযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হয়। ভারতীয় রেলওেয়ের উত্তর রেলওয়ের ফিরোজপুর বিভাগের অধীনস্থ এই রেলপথ জম্মু থেকে শুরু হয়ে উধমপুর হয়ে বারামুল্লা পর্যন্ত গেছে, এই বারামুল্লা স্ট্রাটেজিক ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ন। এই বারামুল্লার কাছেই এলওসি এবং তারপরেই পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর রয়েছে। এই রেলপথেই অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম রেল সেতু ৩৫৯ মিটার লম্বা চেনাব সেতু। আইফেল টাওয়ারের থেকে উঁচু এই চেনাব সেতু ভারতের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং মার্ভেল। এই রেলপথে উধামপুর থেকে বারামুল্লা পর্যন্ত রেলপথকে ইউবিআরএল বা উধামপুর শ্রীনগর বারামুল্লা রেললিংক বলা হয়। ভারতীয় রেলওয়ের এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মানে সাধারনত দশ থেকে বারো কোটি টাকা খরচ হয় কিন্ত কাশ্মীর উপত্যকাকে ভারতের বাকী অংশের সাথে রেলপথে সংযুক্ত করতে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মানে ৯০ কোটি টাকার বেশী খরচ হচ্ছে। এর প্রধান কারন দুর্গম ভৌগোলিক পরিবেশ যা রেলপথ নির্মান করার জন্য প্রধান অন্তরায়। কাশ্মীর উপত্যকার চারদিকে উঁচু পার্বত্যঞ্চল রয়েছে। কাশ্মীর উপত্যকার উত্তর পূর্বে রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা, দক্ষিন পশ্চিমে রয়েছে পীরপঞ্জাল পর্বত এবং এই উপত্যকার মাঝামাঝি গেছে ঝিলাম নদী। 

জম্মু কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর পুরো কাশ্মীর উপত্যকার মাঝামাঝি অবস্থিত। একশো বছরেরও বেশী সময়ধরে শ্রীনগরকে জম্মুর সাথে যুক্ত করবার প্রচেষ্টা করা হচ্ছিল। ১৯০২ সালে ব্রিটিশরা শ্রীনগরকে জম্মুর সাথে যুক্ত করবার চেষ্টা শুরু করেছিল। সেসময় পাকিস্তান ও ভারত বিভক্ত না থাকায় শিয়ালকোট থেকে জম্মু পর্যন্ত রেললাইন আগে থেকেই ছিল। ১৮৯৭ সালেই ব্রিটিশরা শিয়ালকোট থেকে জম্মু পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার লম্বা রেলপথ নির্মান করেছিল। কিন্ত পীরপঞ্জাল ও হিমালয় পর্বতের কারনে জম্মু থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত রেললাইন তৈরি অসম্ভব ছিল, এই কারনে ব্রিটিশরা জম্মু থেকে রাওয়ালপিন্ডি হয়ে শ্রীনগর পর্যন্ত বিকল্প পথে একটি রেললাইন তৈরির পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু কাশ্মীরের মহারাজা এই প্রস্তাবে অসম্মত হয়। এই প্রজেক্টে ব্রিটিশরা লাভবান হত কিন্তু প্রজেক্টের বেশীরভাগ খরচ কাশ্মীরের মহারাজকে দিতে হত সেকারনে কাশ্মীরের মহারাজ এই প্রজেক্টে সম্মত হয়নি। 

১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর শিয়ালকোট পাকিস্তানের ভাগে যাওয়ায় জম্মু থেকে শিয়ালকোট পর্যন্ত রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর জম্মুকে ভারতের বাকী অংশের সাথে যুক্ত করবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয় এবং ১৯৭৫ সালে পাঠানকোট থেকে জম্মু পর্যন্ত রেলপথ তৈরি করা হয়। ১৯৮৩ সালে জম্মু থেকে উধামপুর পর্যন্ত রেলপথ নির্মানের কাজ শুরু হয়। কিন্ত ৫৩ কিলোমিটার এই রেলপথ তৈরি করতে একুশ বছর সময় লেগে যায়। 

২০০৫ সালে জম্মু উধামপুরের সাথে সংযুক্ত হয়। জম্মু উধামপুর রেলপথ নির্মানের সময়েই ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও জম্মু থেকে বারামুল্লা পর্যন্ত রেলপথ নির্মানের প্রজেক্ট শুরু করেন। ২০০২ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী এই প্রজেক্টকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় প্রকল্প হিসাবে ঘোষনা করেন। ২০০৭ সালের মধ্যে প্রজেক্টটি সম্পূর্ন হওয়ার কথা থাকলেও পীরপঞ্জাল পর্বতের কারনে জম্মু থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত রেলপথ তৈরি করা এত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়নি। বরং কাশ্মীর উপত্যকার বানিহাল থেকে বারামুল্লা পর্যন্ত ১১৩ কিলোমিটার লম্বা একটি রেলপথ তৈরি করা হয় যাতে লোকাল ট্রেন যাতায়াত করে। 

২০১৪ সালের মধ্যে উধমপুর থেকে শ্রীমাতা বৈষ্ণোদেবী কাটরা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার লম্বা রেলপথ তৈরি করা হয়। জম্মু থেকে বারামুল্লা পর্যন্ত সম্পূর্ন রেলপথে সবচেয়ে সমস্যা ছিল কাটরা থেকে বানিহাল পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার লম্বা রেলপথ নির্মান করা কারন এই রেলপথ পুরো পীরপঞ্জাল পর্বতের মাঝাখান দিয়ে গেছে। কাটরা থেকে বানিহাল পর্যন্ত রেলপথ তৈরির কাজ চলছে বর্তমানে, এই রেলেপথে ৩৫টি সূড়ঙ্গ ও ৬২টি সেতু রয়েছে। এই পথেই সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি সেতু চেনাব সেতু ও আঞ্জি খাদ সেতু রয়েছে। আঞ্জি খাদ সেতু ভারতের প্রথম তার দিয়ে নির্মিত ঝুলন্ত রেলসেতু। চেনাব সেতু নির্মানে ১,৫০০ কোটি টাকা ও আঞ্জি খাদ সেতু নির্মানে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই রেলপথের খারি সাম্বার অংশে ১২.৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সূড়ঙ্গের উদ্ভোদন করেছেন। টি ৫০ নামে এই সূড়ঙ্গ বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ রেল সূড়ঙ্গ। ২০১০ সালে এই সূড়ঙ্গ নির্মান শুরু হয় যা শেষ হতে চোদ্দ বছর সময় লেগে যায়। পীরপঞ্জাল পর্বতশ্রেনীর মধ্যে তুষারধ্বস, পাহাড়ধ্বস মধ্যে সূড়ঙ্গ নির্মান অত্যন্ত জটিল, এখানে লজিস্টিক পরিবহনও কষ্টসাধ্য যারজন্য এই প্রজেক্টে এত দেরী হয়েছে।  ৫০ টি সূড়ঙ্গের সমান্তরালে আরও একটি সূড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে জরুরী পরিস্থিতিতে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য। তাছাড়া এই সূড়ঙ্গের প্রতি ৩৭৫ মিটারে জরুরী পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া টি ৫০ সূড়ঙ্গে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাও রয়েছে। এর আগে ভারতের দীর্ঘতম রেল সূড়ঙ্গ ছিল ১১.২ কিলোমিটার লম্বা টি ৮০ সূড়ঙ্গ যাকে পীরপঞ্জাল সূড়ঙ্গও বলা হয়। বানিহাল থেকে কাজিগুন্ড বিভাগে এই টি ৮০ সূড়ঙ্গ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ২০ ফেব্রুয়ারি ৪৮.১ কিলোমিটার লম্বা বানিহাল থেকে সাঙ্গলদান পর্যন্ত রেলপথেরও উদ্ভোদন করেন। ওইদিন দুটি বিদ্যুৎচালিত ট্রেনের যাত্রার সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, একটি ট্রেন শ্রীনগর থেকে সাঙ্গলদান অভিমুখে এবং আরেকটি ট্রেন সাঙ্গলদান থেকে শ্রীনগর অভিমুখে রওনা হয়। 

বানিহাল থেকে বারামুল্লা পর্যন্ত রেলপথ আগেই ছিল, তাই এবার বানিহাল থেকে সাঙ্গলদান পর্যন্ত রেলপথ নির্মান করায় বারামুল্লা থেকে সরাসরি সাঙ্গলদান পর্যন্ত রেলপথ তৈরি হয়ে গেল। এর আগে প্রতিদিন চারটি ট্রেন বারামুল্লা থেকে বানিহাল এবং চারটি ট্রেন বানিহাল থেকে বারামুল্লা পর্যন্ত যাত্রা করতো। তবে এসব ট্রেনই ডিজেল শক্তি চালিত ছিল কিন্ত বারামুল্লা থেকে সাঙ্গলদান পর্যন্ত গোটা পথ বিদ্যুৎচালিত ট্রেন ব্যবহারের উপযোগী করা হয়েছে। এই পুরো প্রজেক্টে ২০২২ সাল পর্যন্ত খরচ ২৮০০০ কোটি টাকা ধরা হলেও সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী উধামপুর থেকে বারামুল্লা পর্যন্ত ২৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মান বা ইউবিআরএল প্রজেক্টে ৪১,০০০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। ২৭২ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ২০৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মানের কাজ শেষ, বাকী ৬৩ কিলোমিটার পথ মে মাসের মধ্যেই সম্পূর্ন হয়ে যাবে। এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হলে কাশ্মীর উপত্যকা ভারতের বাকী অংশের সাথে যুক্ত হয়ে যাবে, এতে কাশ্মীর উপত্যকাতে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে। যার কারনে গোটা কাশ্মীর উপত্যকার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আরও মজবুত হবে। 

জাতীয় সড়ক ৪৪ বন্ধ থাকলেও কাশ্মীরে পৌঁছাতে কোনও সমস্যা হবেনা এই ট্রেনলাইন নির্মানের কারনে। এছাড়া এই রেলপথ স্ট্রাটেজিক ভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। জম্মু থেকে এলসিতে অনেক সহজে ও দ্রুত সেনা, অস্ত্র, রসদ পাঠানো সম্ভব হবে জম্মু বারামুলা রেলপথের মাধ্যমে। জম্মু ও শ্রীনগরের মধ্যে দূরত্ব ছয় ঘন্টা থেকে অন্তত তিন ঘন্টায় নামিয়ে আনবে এই রেলপথ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *