অফবিট

তবে কী অচিরেই বন্ধ হতে চলেছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন সামুদ্রিক বানিজ্যপথ পানামা খাল?

আধুনিক বিজ্ঞানের এক অসাধারন স্থাপত্যকার্যের নিদর্শন হচ্ছে পানামা খাল যা প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। পানামা খালের মধ্যে দিয়ে প্রতিবছর কয়েক হাজার জাহাজ অনেক কম সময়ে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে যেতে পারে। ৮২ কিলোমিটার লম্বা এই খালের মাধ্যমে ড্রেক প্যাসেজ, ম্যাজেলান প্রনালীর মতো অশান্ত সামুদ্রিক এলাকাকে এড়িয়ে যায় জাহাজগুলি। আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বানিজ্যের ৬ শতাংশই এই পানামা খাল দিয়েই হয়। এই পানামা খাল থেকে প্রতিবছর পানামা সরকার  ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার পায় যা দেশটির মোট জিডিপির ৭ শতাংশ। পানামা খাল দক্ষিন আমেরিকাকে মধ্য আমেরিকার সাথেও সংযুক্ত করে। ১৮৮১ সালে সর্বপ্রথম ফ্রান্স পানামা খাল তৈরির চেষ্টা করেছিলো কিন্তু উপযুক্ত অর্থের সমস্যা এবং ইঞ্জিনিয়ারিংএ সমস্যার কারনে ফ্রান্স সেসময় এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন করতে পারেনি। এরপর ১৯০৪ সালে আমেরিকা পানামা খাল তৈরি শুরু করে এবং মাত্র দশ বছরের মধ্যে আমেরিকা এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন করে ফেলে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই এই খালে জাহাজ চলাচল শুরু হয়ে যায়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পানামা খালের দায়িত্ব আমেরিকার কাছেই ছিল। ১৯৭৮-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকা ও পানামা সরকার উভয়েই যৌথভাবে এই পানামা খাল পরিচালনা করতো। ২০০০ সাল থেকে পানামা সরকার একাই এই খাল পরিচালনা করছে। ১৯৪৬ সালে যেখানে পানামা খালের মাধ্যমে দক্ষিন আমেরিকা, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে মাত্র ২০ মিলিয়ন টন পন্য পরিবহন হত প্রতিবছর সেখানে বর্তমানে এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিন আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে প্রতিবছর ১৪,০০০ জাহাজ ৫০০ মিলিয়ন টন পন্য পরিবহন করছে। এই জন্য আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্যের ক্ষেত্রে সুয়েজ খালের পর পানামা খাল সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ন। কিন্তু বিগত কিছু বছর ধরে প্রাকৃতিক কারনে ও মনুষ্যসৃষ্ট কারনে পানামা খালের গুরুত্ব ক্রমশ কমে যাচ্ছে এবং অনেক জাহাজই পানামা খালকে এড়িয়ে চলছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় পর পানামা খাল বন্ধ হয়ে যাবে।

আজ পানামা খাল যেসব কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী দায়ী প্রকৃতি। যখন মানুষ উন্নয়নের নামে প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করে তখন প্রকৃতিও ভয়ানক প্রতিশোধ নেয়। ঠিক এটাই হচ্ছে পানামা খালের সাথে। বিগত কয়েকবছর ধরে গ্রীনহাউস গ্যাস ও কার্বন নির্গমনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ব উষ্ণয়নও বৃদ্ধি পেয়েছে যার জন্য কোথাও অতিরিক্ত বন্যা দেখা যাচ্ছে আবার কোথাও তীব্র খরা দেখা যাচ্ছে। পানামা খালকে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়েছে। এই খালের জল আসে পাশ্ববর্তী গাতুন লেক, মীরা ফ্লোরেস লেক, লেক আলাজুয়েলা এবং চ্যাগ্রেস নদী থেকে। প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের জলের স্তর সমান নয়। এজন্য পানামা খালে বিভিন্ন ব্লকে প্রয়োজন অনুযায়ী জলস্তর বৃদ্ধি করে অথবা কমিয়ে জাহাজকে পারাপার করা হয়। পানামা খালে একদিক থেকে অন্যদিকে যেতে প্রতি জাহাজ পীছু ৫০-৫২ মিলিয়ন গ্যালন জল ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি জাহাজ পারাপারের সাথে সাথে কয়েক গ্যালন জল সমুদ্রে চলে যায়। পানামা খালে যেসব লেক ও নদী থেকে জল আসে সেসব লেক ও নদী জলের জন্য বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল। বৃষ্টিপাত কম হলে পানামা খালেও জল কম আসবে। গত বছর জুন মাসে গাতুন লেক অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাতের কারনে পানামা সরকার পানামা খালে জাহাজ চলাচলের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এই জন্য ২০২২ সালে পানমা খাল দিয়ে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৪০টি করে জাহাজ চলাচল করতো সেখানে ২০২৩ সালে প্রতিদিন ৩২টি করে জাহাজ চলাচল করে পনামা খালে। পানামা খালে জল সংকটের আরও একটি বড় কারন হচ্ছে এল নিনো। এল নিনো এমন এক প্রাকৃতিক অবস্থা যার কারনে বর্ষাকালের সময় কমিয়ে দেয়। যদি কোনও অঞ্চলে স্বাভাবিক ভাবে তিনমাস বর্ষাকাল হয় তবে এল নিনোর কারনে বর্ষাকাল কমে এক মাসে চলে আসে। পানামা খালের এই সংকট জনক পরিস্থিতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে পানামা সরকার ও পন্যবাহী জাহাজ সংস্থাগুলোর উপর। জাহাজ কম আসার কারনে পানামা সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, ইতিমধ্যেই ২০২৪ সালে এখনও পর্যন্ত পানামা সরকারের ২০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতিসাধন হয়েছে। পানামা খাল ব্যবহার করতে না পারায় অনেক জাহাজকে বিকল্প পথে যেতে হচ্ছে যাতে পরিবহন খরচও বহুগুন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন ডেনমার্ক থেকে কোনও পন্যবাহী জাহাজকে যদি আর্জেন্টিনা আসতে হয় তবে পানামা খাল দিয়ে কয়েকদিনেই চলে আসতে পারে। কিন্তু পানামা খাল বন্ধ থাকলে সেই জাহাজকে ডেনমার্ক থেকে দক্ষিন আমেরিকার পূর্ব উপকূল দিয়ে ঘুরে ৮০০০ নটিক্যাল মাইল অতিরিক্ত পথ অতিক্রম করে আর্জেন্টিনা আসতে হয়। যার কারনে অতিরিক্ত ১৫-২০ দিন সময় বেশী লাগে। এই জন্য পন্যের দামও অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। এছাড়া পানামা খালের জলস্তর কমার কারনে স্থানীয় মানুষজনও সমস্যায় রয়েছে। যতবার লেক থেকে পানামা খালে জল যাওয়ার গেট খোলা হয় ততবার সমুদ্রের নোনা জল লেকে ঢুকে যায়। যার জন্য পানামা শহরের প্রায় পাঁচ লাখ বাসিন্দার পানীয় জলের সমস্যা তৈরি হয়েছে। এজন্য পানামা সরকারকে জনগন দাবী জানাচ্ছে সুয়েজ খালের মতো সমুদ্রের জলের বিশুদ্ধকরন কেন্দ্র তৈরি করতে। কিন্ত সুয়েজ খালের আশেপাশে বালির স্তর থাকায় সহজেই জল বিশুদ্ধকরন কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছে কিন্তু পানামা খালের আশেপাশে পাথুরে ভূমি থাকায় পানীয় জল বিশুদ্ধকরন কেন্দ্র তৈরিতে সমস্যা রয়েছে।

পানামা খালের জন্য সবচেয়ে বেশী লাভবান হত দক্ষিন আমেরিকান দেশগুলো। তবে পানামা খালের সংকটের কারনে দক্ষিন আমেরিকান দেশগুলো বিকল্প পথের জন্য কাজ শুরু করেছে। যার মধ্যে চারটি পথকে ভবিষ্যতে পানামা খালের বিকল্প বলা হচ্ছে।

১) দি বাই ওশিয়ানিক করিডর:—- এই প্রজেক্টে রেলপথ, সেতু ও হাইওয়ের মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরকে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর্জেন্টিনা, ব্রজিল, পেরু, উরুগুয়ে, চিলি, প্যারাগুয়ের মতোন গুরুত্বপূর্ন ল্যাটিন আমেরিকান দেশ এই প্রজেক্টে যুক্ত রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকেই এই প্রজেক্টে কাজ শুরু হয়েছে। এই করিডরের মাধ্যমে ইউরোপ থেকে আগত জাহাজ চিলির বন্দরে দাঁড়াবে এবং সেখান থেকে রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পন্য পরিবহন হবে। এই করিডরের মাধ্যমে পানামা খালের মতই সময়ে ইউরোপ থেকে দক্ষিন আমেরিকাতে পন্য পরিবহন হবে। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া এবং চিলিতে বিশ্বের অর্ধেকের বেশী লিথিয়াম পাওয় যায় যার জন্য এই তিনটি দেশকে একত্রে লিথিয়াম ত্রিভুজ অঞ্চল বলা হয়। আগামী দিনে ইলেকট্রিক গাড়িই ভবিষ্যৎ হতে চলেছে। সমস্ত ইলেকট্রনিক যন্ত্রের প্রধান উপাদানই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। এই জন্য এই অঞ্চলে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। যার ফলস্বরূপ দি বাই ওশিয়ানিক করিডরের গুরুত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২) ইন্টার ওশিয়ানিক ট্রেন নেটওয়ার্ক :—- কলম্বিয়া সরকার এই প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরকে ক্যারাবিয়ান সাগরের সাথে সংযুক্ত করার চেষ্টা করছে। কলম্বিয়ার সরকার দেশটির পশ্চিম উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত বন্দর থেকে দেশটির পূর্ব উপকূলে ক্যারাবিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত বন্দরে একটি ২০০ কিলোমিটার লম্বা রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করছে।

৩) নিকারাগুয়া খাল:—- পানামা খালের মতোই লেক নিকারাগুয়াকে ব্যবহার করে নিকারাগুয়ান সরকার ব্রিটো এবং পুন্টা গোরদার মাঝে একটি খাল নির্মানের প্রজেক্ট শুরু করবার চেষ্টা করেছিলো। চীনের একটি সংস্থা এই প্রজেক্টের টেন্ডারও জিতেছিলো কিন্তু অর্থাভাবে এই প্রজেক্ট আপাতত বন্ধ আছে৷ তবে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ এলেই এই প্রজেক্ট শুরু হতে পারে।

৪) মেক্সিকোর ইন্টার ওশিয়ানিক করিডর :—- পানামা খালের মতোই মেক্সিকোও তার ভূভাগের মাঝে একটি কৃত্রিম খাল তৈরির পরিকল্পনা শুরু করেছে। ১৯০৭ সালেই মেক্সিকো এই প্রজেক্টে কাজ শুরু করেছিল, কিন্তু ১৯১০ সালে মেক্সিকান বিপ্লবের কারনে এই প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৪ সালে পানামা খাল তৈরি হয়ে যাওয়ার পর মেক্সিকান সরকার এই প্রজেক্টে আর কখনও কাজ করেনি। কিন্তু ২০২০ মেক্সিকো পুনরায় তাদের এই প্রজেক্ট সামনে এনেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *