অফবিট

গ্রীনল্যান্ডের রহস্যময় লোহা পৃথিবীর নয়। তাহলে!

আটলান্টিক সাগর ও আর্কটিক সাগরের মাঝে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রীনল্যান্ড। উত্তর আমেরিকার অত্যন্ত সুন্দর এই অঞ্চলটিতে জনবসতির পরিমান মাত্র ৫৭,০০০. গ্রীনল্যান্ড নাম শুনে সবুজ প্রকৃতির প্রচুর উপস্থিতি মনে হলেও বাস্তবে ২.১৬৬ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই দ্বীপটির ৮০ শতাংশের বেশী এলাকাই তুষারাচ্ছন্ন। উত্তর আমেরিকার অংশ হলেও এখানকার অধিবাসীদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি সবই ইউরোপের মতো। গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্কের অধীনে থাকা স্বায়ত্তশাসিত দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রীনল্যান্ড কিনতে চেয়েছিল কিন্তু পরে আমেরিকা তার সিদ্ধান্ত বদলায়। ২৫ মে থেকে শুরু করে ২৫ জুলাই একটানা দুই মাস গ্রীনল্যান্ডে সূর্যাস্ত হয়না। অসাধারন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই দেশটিতে থাকা বরফের হিমবাহ গুলোতে চার থেকে আট লাখ পুরোনো বরফের স্তর আছে। 

আঠারো শতকে ইউরোপীয়ান অভিযাত্রীরা গ্রীনল্যান্ডর এই বরফের হিমবাহতে অতিমানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন এমন বিশেষ কিছু মানুষকে খুঁজে পায় যারা গ্রীনল্যান্ডের তীব্র ঠান্ডাতেও স্বাভাবিক ভাবেই বসবাস করছিলো। বলা হয় ওই সমস্ত মানুষদের এরকম স্বাভাবিক জীবনযাপনের কারন ছিল একটি রহস্যময় পাহাড় যা পুরো লোহার তৈরি ছিল। বিভিন্ন প্রাচীন ঘটনা অনুযায়ী ওই লোহার টুকরো মহাকাশ থেকে গ্রীনল্যান্ডে এসেছে। 

১৮৯৪ সালে রবার্ট পিয়েরি নামে এক আমেরিকান অভিযাত্রী ওই লোহার পাহাড়কে খুঁজে বের করে এবং তার একটি অংশ আমেরিকাতে নিয়ে আসে। কিন্তু এই পুরো অভিযানে তিনি এমন এক ভুল করেন যাতে ছয়জন মানুষের জীবন সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিল এবং শেষপর্যন্ত চারজন মানুষের মৃত্যু হয়। 

৯৮০ সালে আইসল্যান্ডের অধিবাসী এরিক দি রেড নামে এক ব্যাক্তিকে দেশ থেকে তিন বছরের জন্য বিতাড়িত করা হয় কারন এরিক তার প্রতিবেশীকে হত্যা করেছিল। আটলান্টিক সাগরে অবস্থিত আইসল্যান্ড দেশ থেকে কাউকে তাড়িয়ে দেওয়ার অর্থ খাদ্য ও জলের অভাবে তার মৃত্যু হওয়া। এরিকও ভেবেছিল তার মৃত্যু আসন্ন কিন্ত ভাগ্য তাকে আর্কটিক অঞ্চলের এক বিশাল ভূখন্ডে নিয়ে যায় যার নাম গ্রীনল্যান্ড। সেই থেকেই গ্রীনল্যান্ডের খোঁজ পাওয়া যায়। তীব্র ঠান্ডায় ও বরফাচ্ছাদিত এই অঞ্চলে বেঁচে থাকাই মুশকিল। কিন্তু ইউরোপীয়ান অভিযাত্রীরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করে এরকম কঠিন পরিবেশেও কিছু মানুষ বসবাস করছে। ইউরোপীয়ানরা এদের নাম দেয় ইনুইট। 

১৮১৮ সালে ইংল্যান্ডের অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জস রোস গ্রীনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে স্থানীয় ইনুইটদের সাথে সংযোগ করে। সেসময় তিনি লক্ষ্য করেন ইনুইটরা শিকারের জন্য একটি বিশেষ ছুরি ও বল্লম ব্যবহার করে যাদের অগ্রভাগে লোহার মতো শক্ত ধাতব উপাদান রয়েছে। ক্যাপ্টেন রোস প্রথমে ভেবেছিলেন গ্রীনল্যান্ডের উপকূলে ভেসে আসা কোনও পরিত্যক্ত জাহাজ থেকে এই ধাতু পেয়েছে ইনুইটরা। কিন্তু তার অনুমান ভুল ছিল, একজন স্থানীয় মানুষ তাকে জানায় গ্রীনল্যান্ডে একটি বিশেষ পাহাড় আছে যেখানে এধরনের ধাতু পাওয়া যায়, গ্রীনল্যান্ডের মানুষ বহুবছর ধরেই এই ধাতু ব্যবহার করে। স্থানীয় ভাষায় এই ধাতব উপাদানকে সেভিকসোহ বলা হত। ক্যাপ্টেন রোস এই কথা অবিশ্বাসও করতে পারছিলেন না, কারন তার চোখের সামনেই প্রমান ছিল। তিনি জানতেন এই বিশেষ লোহার পাহাড় খুঁজে পেলে তা আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক দামী হবে। তিনি গ্রীনল্যান্ডে এই পাহাড়ের খোঁজ শুরু করেন কিন্ত পাহাড় খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন তিনি। এদিকে ইউরোপে এই বিশেষ লোহার খবর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮১৮ সাল থেকে ব্রিটেন, সুইডেন ও ডেনমার্কের অভিযাত্রীরা বারবার গ্রীনল্যান্ডে অভিযান করেছিল কিন্ত কোনও পাহাড় খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রীনল্যান্ডে এই লোহার পাহাড় খুঁজে পেতে সক্ষম হয় শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি রবার্ট পিয়েরি। আমেরিকন নৌবাহিনীর সদস্য রবার্ট পিয়েরির জীবনের স্বপ্ন ছিল উত্তর মেরুতে প্রথম অভিযাত্রী হিসাবে পৌঁছানো। এর জন্য তিনি বহুদিন গ্রীনল্যান্ডে বসবাস করেছিলেন। স্থানীয় ইনুইটদের সাথে রবার্ট পিয়েরির বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি ইনুইটদের ভাষা ও সংস্কৃতি শিখেছিলেন। 

১৮৯৪ রবার্ট পিয়েরি ঠিক করে গ্রীনল্যান্ডে ওই বিশেষ লোহার পাহাড় খুঁজে বের করবে। তার এই অভিযানে সাহায্য করেছিল এক স্থানীয় ব্যক্তি অ্যালিকুয়েটশিক। ১৮৯৪ সালেই অ্যালিকুয়েটশিকের সহায়তায় রবার্ট পিয়েরি ওই লোহার পাহাড় খুঁজে পায় যা ওজন ছিল ৩০,৯০০ কিলোগ্রাম। রবার্ট পিয়েরি এই লোহার টুকরোটা দেখেই বুঝতে পেরে যান এটা পৃথিবীতে পাওয়া সাধারন খনিজ লোহা নয়। বাস্তবেও ওই লোহার টুকরোটা আসলে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে আসা উল্কাপিন্ডের অংশ যা প্রায় দশ হাজার বছর আগে গ্রীনল্যান্ডে এসে পড়েছিল। প্রকৃত উল্কাপিণ্ডের আয়তন আরও বড় ছিল কিন্তু ওই উল্কাপিন্ড পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার সময় কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং সবচেয়ে বড় টুকরোটি গ্রীনল্যান্ডে এসে পড়ে। রবার্ট পিয়েরি বুঝতে পারেন আমেরিকাতে এর দাম অনেক হবে। তাই তিনি সম্পূর্ন উল্কাপিণ্ডটিকে আমেরিকাতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্ত ৩০,৯০০ কেজি ওজনের বিশাল উল্কাপিণ্ডটিকে একস্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যওয়া সহজ ছিলনা, তারউপর উল্কাপিণ্ডটির অনেকাংশ ভূমির গভীরে ছিল। স্থানীয়দের সহয়তায় ওই উল্কাপিণ্ডটিকে নির্দিষ্ট স্থান থেকে উপকূলে রবার্ট পিয়েরির জাহাজ পর্যন্ত নিয়ে যেতে তিনবছর সময় লেগে যায়। এই উল্কাপিণ্ড আমেরিকায় ১৮৯৭ সালে চল্লিশ হাজার ডলারে বিক্রি করে রবার্ট পিয়েরি যা বর্তমান হিসাবে প্রায় ১.৪১ মিলিয়ন ডলার। 

আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি সেসময় রবার্ট পিয়েরিরকে ওই উল্কাপিন্ড ছাড়াও কিছু ইনুইটকে সাথে করে আমেরিকায় নিয়ে আসার কথা বলেছিল কারন বিজ্ঞানীরা ইনুইটদের শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা করতে চাইছিলো। সেইমতো রবার্ট পিয়েরি কুইসুক নামে এক ব্যক্তি, তার ছেলে মিনিক সহ মোট ছয়জন ইনুইটকে তার সাথে আমেরিকায় নিয়ে আসে। রবার্ট পিয়েরি ওই ছয়জন ইনুইটকে আশ্বাস দিয়েছিল সে নিজে একবছর পর তাদের গ্রীন ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। 

১৮৯৭ সালে আমেরিকার ব্রুকলিন শহরে যখন রবার্ট পৌঁছায় তখন ওই উল্কাপিণ্ড ও ইনুইটদের দেখবার জন্য হাজার হাজার লোক ভিড় জমিয়েছিল। রবার্ট পিয়েরি রীতিমতো টিকিট বিক্রি করে ওই উল্কাপিণ্ড ও ইনুইটের প্রদশর্ন করেছিল। অন্তত কুড়ি হাজার মানুষ টিকিট কেটেছিল দেখার জন্য যার থেকে মোটা অর্থ লাভ হয় রবার্ট পিয়েরির কিন্তু এর থেকে কোনও অর্থই ইনুইটদের দেওয়া হয়নি। এরপর ইনুইটদের আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির কাছে সঁপে দিয়ে রবার্ট পিয়েরি উত্তর মেরু অভিযানে বেড়িয়ে যায়। এখানে ইনুইটদের গরম পরিবেশে রাখা হয় পরীক্ষার জন্য। 

দীর্ঘকাল গ্রীনল্যান্ডের অত্যাধিক ঠান্ডা তাপমাত্রায় থাকা ইনুইটরা আমেরিকার গরম তাপমাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কুইসুক সহ চারজন ইনুইটের মৃত্যু হয় এবং একজন অসুস্থ ইনুইটকে ১৮৯৯ সালে জাহাজে করে গ্রীনল্যান্ডে রেখে আসা হয়, এরপর আমেরিকাতে শুধু একমাত্র মিনিকই ছিল। মিনিককে জানানো হয় তার বাবার অন্তেষ্টিক্রিয়া করা হয়ে গেছে কিন্তু বাস্তবে আমেরিকার ওই মিউজিয়ামে মৃত ইনুইটদের শরীরের উপর পরীক্ষা করা হচ্ছিল। কুইসুকের মাথা কেটে তা পরীক্ষা করা হয়, ১৯০১ সালে এক বৈজ্ঞানিক পত্রিকাতে এর ছবি বেড়িয়েছিল। মিনিক তখন অনেকটাই ছোট ছিল যার জন্য তাকে একটি পরিবারকে দিয়ে দেওয়া হয় এবং তার নতুন নাম রাখা হয় মেনে ওয়ালেজ। বড় হওয়ার সাথে সাথে মিনিক তার অতীত সম্পর্কে সমস্ত তথ্যই জানতে পারে, সে খবর পায় তার বাবার মাথার খুলি ও শরীর তখনও মিউজিয়ামে রয়েছে। 

১৯০৭ সালে মিউজিয়ামকে মিনিক অনুরোধ করে তার বাবার শরীর যেন তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় যাতে সে পূর্নভাবে অন্তেষ্টিক্রিয়া করতে পারে কিন্তু মিউজিয়াম তার অনুরোধ প্রত্যাখান করে। মিনিক রবার্ট পিয়েরিকে চিঠি লিখে অনুরোধ করে তাকে গ্রীনল্যান্ডে নিয়ে যেতে কিন্তু রবার্ট পিয়েরিও মিনিখের অনুরোধ প্রত্যাখান করে। মিনিখ এক আমেরিকান সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল সে কখনও রবার্ট পিয়েরিকে ক্ষমা করবেনা। ১৯০৯ সালে উত্তর মেরু অভিযান থেকে আমেরিকায় ফিরে আসার পর রবার্ট পিয়েরিকে গ্রীনল্যান্ডের বাসিন্দাদের সাথে করা অন্যায়ের জন্য যথেষ্ট সমালোচনা করা হয়। বাধ্য হয়ে রবার্ট পিয়েরি মিনিককে গ্রীনল্যান্ডে নিয়ে যায়। 

১৯১৬ সালে মিনিক পুনরায় আমেরিকা ফিরে আসে তার বাবার মৃতদেহ ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯১৮ সালে তার মৃত্যু হয়। ১৯৮৬ সালে কেন হার্পার মিনিকের জীবনের উপর একটি বই লিখেছেন যার নাম গিভ মি মাই ফাদার’স বডি। এই বই এতটাই বিখ্যাত হয়ে যায় যে ১৯৯৩ সালে আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি চাপে পড়ে মিনিকের বাবা ও বাকী ইনুইটদের মৃতদেহ গ্রীনল্যান্ড সরকারের হাতে তুলে দেয়। সেই উল্কাপিন্ড এখনও এই মিউজিয়ামে রাখা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *