মানব ইতিহাসে যে যুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রতিপক্ষ ছিল এক ঝাঁক পাখি
মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন কারনে যুদ্ধ হয়ে এসেছে। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিজ্ঞানের কালেও বিভিন্ন দেশের মধ্যে অথবা কোনও দেশের অভ্যন্তরেই যুদ্ধ হচ্ছে। তবে এসব যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে বিভিন্ন দেশ বা জাতির অস্ত্রধারী মানুষদের মধ্যে। কিন্তু ইতিহাসে এমন একটি যুদ্ধ হয়েছে যেখানে মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল পাখি। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও অস্ট্রেলিয়াতে একসময় মানুষ ও পাখির মধ্যে লড়াই হয়েছিল।
১৯৩০ সালে ইউরোপের রাজনীতিতে যখন ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছিল, ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল ঠিক সেসময় পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াতে ইমু পাখির ঝাঁকের সাথে অস্ট্রেলিয়ান সৈনিকদের রীতিমতো যুদ্ধ হয়েছিল। ইমু পাখি প্রধানত অস্ট্রেলিয়াতেই পাওয়া যায় এগুলো আকারে অনেকটাই বড় হয়। একটি পূর্নাঙ্গ মানুষের সমান উচ্চতা বিশিষ্ট ইমু পাখির ওজন ১০০ পাউন্ড পর্যন্ত হয়। অস্ট্রিচের পর ইমুকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ পাখি বলা হয়। অস্ট্রেলিয়াকে একরকম ইমু পাখির ঘরই বলা হয়। অস্ট্রিচের মতোই ইমু উড়তে সক্ষম নয়। দুটি শক্তিশালী পা বিশিষ্ট ইমু পাখির ল্যাটিন ভাষায় নাম ড্রোমিয়াস নোভেহোল্যান্ডিয়ে যার অস্ট্রেলিয়ান দৌড়বিদ। কারন ইমু পাখি ৫৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগে দৌড়াতে সক্ষম। এই ইমু পাখির সাথেই অস্ট্রেলিয়ান সেনাদের অদ্ভুত যুদ্ধ হয়েছিল।
১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া ৩,৩০,০০০ এর বেশী সেনা পাঠিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ান সেনারা যখন দেশে ফিরে আসে তখন অস্ট্রেলিয়ার সরকার সেনাদের বিনামূল্যে জমি দেওয়ার ঘোষনা করে। অস্ট্রেলিয়া সরকার নির্জন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াতে জনবসতি তৈরি করতে এবং সেনাদের পুনরায় নাগরিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে দক্ষিন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহর থেকে বেশ কিছুটা উত্তর পূর্বে দুই লাখ একর জায়গাতে ৪৮টি কৃষিক্ষেত্র তৈরি করে। এখানে গম চাষের একদম উপযুক্ত পরিবেশ ছিল যার জন্য এই অঞ্চলকে হুইট বেল্ট বলা হত। কিন্তু এই অঞ্চলের বেশীরভাগ এলাকাই জলমগ্ন ছিল যার জন্য প্রকৃত চাষযোগ্য জমির পরিমান কমই ছিল। অস্ট্রেলিয়া সরকার যখন সেনাদের এই জমি দেওয়ার কথা জানায় তখন অধিকাংশ সেনাই এই জমি নিতে অস্বীকার করে। কিন্তু পাঁচ হাজার সেনা সরকারের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে এখানে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু ১৯২০ আসতে আসতে হুইটবেল্ট থেকে এক তৃতীয়াংশ লোক ফিরে আসে প্রতিকূল পরিস্থিতির কারনে। বাকী লোকেরা হুইটফিল্ডে কৃষিকাজের পাশাপাশি ভেড়া প্রতিপালন শুরু করে। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার সাধারন নির্বাচনে লেবার দল জয়লাভ করে এবং জেমস স্কালিন প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু এর দুইদিন পরেই বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা শুরু হয়। ১৯৩০ সালে জেমস স্কালিন অস্ট্রেলিয়ার কৃষকদের বেশী করে গম উৎপাদনের কথা বলেন। তিনি কৃষকদের উপযুক্ত দাম দেওয়ার কথাও জানান। কিন্তু সেই বছর জুন মাস থেকে বিশ্বে আর্থিক মন্দার কারনে গমের দাম অস্বাভাবিক ভাবে কমে যায়। যার ফলে হুইটবেল্ট সহ সমস্ত অস্ট্রেলিয়ার কৃষকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার গমের জন্য তাদের যে মূল্য দেয় তা খুবই কম ছিল। প্রথমে কৃষকরা সরকারকে গম বিক্রি করতে না চাইলেও পরবর্তীকালে বাধ্য হয় কম দামেই গম বিক্রি করতে।
১৯৩২ সাল থেকে হুইটবেল্টের কৃষকরা নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিশালাকার ইমু পাখির ঝাঁক গম নষ্ট করতে শুরু করে। একেই আর্থিক মন্দার কারনে কৃষকরা দাম পাচ্ছিলনা, এরপর ইমু পাখির অত্যাচারে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষকরা। জমিতে কাঁটাতার লাগিয়েও কোনও লাভ হচ্ছিলনা। অস্ট্রেলিয়াতে বরাবরই ইমু পাখিরা কৃষকদের ফসল নষ্ট করত, যার জন্য ১৯২২ সালে অস্ট্রেলিয়ান সরকার ইমু পাখিকে চাষের জন্য ক্ষতিকর কীট হিসাবে ঘোষনা করেছিল এবং কৃষকদের ইমু শিকারেও কোনও নিষেধ ছিলনা। পর্যাপ্ত পানীয় জল ও গম পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াতে ইমুদের বেশী আকর্ষন করে। বাধ্য হয়ে কৃষকরা ইমু শিকারও করে অনেক কিন্তু কোনও লাভ হয়নি কারন ১৯৩০ এর দশকে প্রায় ২০,০০০ ইমু পাখির বিশাল দল একসাথে হুইটবেল্টের কৃষকদের জমিতে হামলা করেছিলো। বাধ্য হয়ে স্থানীয় কৃষকরা অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী স্যার জর্জ পিয়ারসকে চিঠি লিখে ইমুদের দমনে আধুনিক অস্ত্র বিশেষ করে মেশিনগানের দাবী করে। গমের কমদামের কারনে আন্দোলনরত কৃষকদের শান্ত করতে অস্ট্রেলিয়ান সরকার রাজি হয়ে যায়। অক্টোবর মাসে সরকার ইমু পাখিদের দমনে রীতিমতো সেনা অভিযানের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বর্ষাকালের জন্য এই অভিযান কিছুটা পিছিয়ে যায়। অবশেষে ১৯৩২ সালের ২ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনী ইমু পাখিদের দমনে অভিযান শুরু করে।
সেনাবাহিনী ইমুর ঝাঁক লক্ষ্য করে মেশিনগান নিয়ে গুলি করা শুরু করে। অস্ট্রেলিয়াতে এই অভিযানকে ইমু যুদ্ধ বা দি গ্রেট ইমু ওয়ার বলা হয়। কিন্তু ইমুরা যথেষ্ট চালাক ছিল তারা যুদ্ধের জন্য নিজেদের রননীতি তৈরি করেছিল। ইমুরা ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে তীব্রগতিতে পালিয়ে যেত যার জন্য তাদের নিশানা করা খুবই কঠিন ছিল। ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ২,৫০০ রূউন্ড গুলি চালিয়েও মাত্র ৫০টি ইমু হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনী। এটা অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য রীতিমতো অপমানজনক ছিল। সেসময় মিডিয়াতেও এই নিয়ে সেনাবাহিনীকে বিদ্রূপ করা হয়েছিল। বাধ্য হয়ে জর্জ পিয়ারস সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেয়। এভাবে প্রথম ধাপের যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছিল ইমুদের কাছে। সেনাবাহিনী ফিরে যেতেই কৃষকদের ক্ষেতে ইমুদের অত্যাচার পূর্বের তুলনায় আরও বেড়ে গিয়েছিল। যার জন্য ১২ নভেম্বর পুনরায় সেনাবাহিনী নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অভিযানে নামে। এবার আশ্চর্যজনক সাফল্য পাওয়া যায়। ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনী প্রায় দশ হাজার রাউন্ড গুলি চালায় যাতে ৯৮৬ ইমু মারা যায়, ২,৫০০ ইমু আহত হয়। কিন্তু এভাবে নির্বিচারে পাখি হত্যার জন্য বিশ্ব জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার সরকারের সমালোচনা শুরু হয় যার জন্য ১০ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার সরকার ইমুদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তারপরেও কৃষকদের ক্ষেতে ইমুর অত্যাচার কমেনি। কৃষকরা এরপর অস্ট্রেলিয়া সরকারকে বহুবার অনুরোধ করে মেশিনগানের বদলে আকাশ থেকে ইমুর ঝাঁকে হামলা করতে কিন্তু সরকার এই প্রস্তাব মানা করে দেয়। এর বদলে অস্ট্রেলিয়ার সরকার ইমুদের ধরা বা হত্যাকারীকে পুরস্কৃত করার ঘোষনা করে, এই পদ্ধতি ব্যাপক কার্যকর হয়।
১৯৩৪ সালে মাত্র ছয়মাসের মধ্যে প্রায় ৫৭,০০০ পুরস্কার দেওয়া হয় যার অর্থ সিংহভাগ ইমুকে সাধারন মানুষজনই হত্যা করে। অস্ট্রেলিয়াতে ইমু পাখিদের এতটাই নির্বিচারে হত্যা করা হয় যে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে ইমুকে একটি সংরক্ষিত পাখি প্রজাতি ঘোষনা করা হয়েছে, তবে ইমু পাখি যদি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতি করে তবে হত্যার অনুমতি রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়।