আমেরিকা, দক্ষিন কোরিয়া ও জপাানের মধ্যে ন্যাটোর মতো সামরিক জোট তৈরি হচ্ছে!
উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি অভিযোগ করেছে আমেরিকা তার বন্ধু দেশগুলোর সাথে যৌথভাবে এশিয়াতে একটি ন্যাটো জোটের মতো সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা করছে। এশিয়াতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকার জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্সের মতোন অনেক মিত্রদেশ রয়েছে, উত্তর কোরিয়া মূলত জাপান ও দক্ষিন কোরিয়ার বিরুদ্ধেই আমেরিকার সাথে জোট গঠনের অভিযোগ করেছে। ন্যাটো বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল তৈরি হয় আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। ন্যাটোতে ৩২টি দেশ রয়েছে যার মধ্যে ৩০টি ইউরোপীয়ান ও ২টি উত্তর আমেরিকান দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা শীতল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়ান দেশগুলো তাদের উপর সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্ভাব্য আক্রমনের কথা চিন্তা করে ন্যাটো জোট গঠন করে।কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে পনেরোটি স্বাধীন দেশ গঠনের সাথে সাথে ন্যাটের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু আজও ন্যাটোর অস্তিত্ব রয়েছে, এমনকী ন্যাটো ক্রমাগত তার সদস্য সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে। ন্যাটোকে নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেরই সমস্যা রয়েছে। এই মূহুর্তে বিশ্বে দুটি মেরু তৈরি হয়ে গেছে একদিকে রয়েছে আমেরিকার নেতৃত্বে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব এবং আরেকদিকে রয়েছে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়ার মতোন দেশ যাদের শয়তানের অক্ষ নাম দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের মতোন বড় বড় সংস্থাগুলো আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া ও চীন এতে খুশি নয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করেই ন্যাটোর কারনে। ইউক্রেন ন্যাটের সদস্য হতে চাইছিলো। রাশিয়া কখনওই চায়নি ন্যাটোর উপস্থিতি হোক তাদের সীমান্তে। রাশিয়া বহুবার ইউক্রেনকে নিষেধ করেছে ন্যাটোতে যোগ না দিতে কিন্তু ইউক্রেন না শোনায় রাশিয়া সরাসরি ইউক্রেন আক্রমন করে যার জন্য আজ দুইবছর ধরে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ চলছে। রাশিয়া জর্জিয়াকেও সতর্ক করেছে ন্যাটোয় যোগ দেবার চেষ্টা করলে জর্জিয়াও আক্রমন করবে।
কিছুদিন আগেই প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকা, দক্ষিন কোরিয়া ও জাপান একটি ত্রিদেশীয় সামরিক অনুশীলন ফ্রিডম এজ করে। এটাই ছিল এই তিনটি দেশের মধ্যে প্রথম ত্রিদেশীয় সামরিক অনুশীলন। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ও কোরিয়ান উপদ্বীপে শান্তি বজায় রাখার জন্য আমেরিকা, দক্ষিন কোরিয়া ও জাপানের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড নামে একটি সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনেই ত্রিদেশীয় অনুশীলনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ২ জুন সিঙ্গাপুরে সাংগ্রিলা বৈঠকে তিনদেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর প্রধান এই অনুশীলনের ঘোষনা করেন। দক্ষিন কোরিয়ার জেজু দ্বীপের দক্ষিনে আন্তর্জাতিক জলসীমায় এই সামরিক অনুশীলন হয়। আমেরিকার ইউএসএস থিওডোর রুজভেল্ট ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপ সহ তিন দেশের একাধিক ডেস্ট্রয়ার, যুদ্ধবিমান এই সামরিক অনুশীলনে অংশ নিয়েছিল। এরপরেই উত্তর কোরিয়া দাবী করে আমেরিকা, দক্ষিন কোরিয়া ও জপাান মিলিত ভাবে এশিয়াতে একটি ন্যাটে জোট গঠন করার চেষ্টা করছে। উত্তর কোরিয়া এইজন্য একাধিক ওয়ারহেড যুক্ত একটি মিসাইল পরীক্ষাও করে। কিন্ত উত্তর কোরিয়া মিসাইল পরীক্ষা সফল বলে দাবী করলেও দক্ষিন কোরিয়া জানিয়েছে এই মিসাইল পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। গত বুধবার সকাল ৫:৩০ নাগাদ উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ং থেকে পূর্ব সাগরে একটি মিসাইল লঞ্চ করা হয়। কিন্তু ১৫৫ মাইল ওড়ার পর পূর্ব সাগরের উপরেই মিসাইলটি বিস্ফোরিত হয়ে যায়। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল ভূরাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটি জায়গা। এই অঞ্চলে যদি অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকা, দক্ষিন কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ফিলিপিন্সের মধ্যে জোট গঠন হয় তাহলে সবচেয়ে বেশী সমস্যায় পড়বে চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া। চীনকে দক্ষিন চীন সগর হয়ে আন্তর্জাতিক জলসীমায় প্রবেশ করতে হলে ভারত মহাসাগরের মালাক্কা প্রনালী হয়ে যেতে হবে কিন্তু ওখানে ভারতীয় নৌবাহিনী প্রস্তত রয়েছে, আবার প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার জোট রয়েছে সুতরাং চীনের জন্য সমস্যা বিশাল। দক্ষিন কোরিয়া যত বেশী শক্তিশালী হবে তা উত্তর কোরিয়ার জন্যও সমস্যার কারন। আবার প্যাসিফিক অঞ্চলে এই জোট রাশিয়ার জন্যও অস্বস্তির কারন। আন্তর্জাতিক জলসীমায় প্রবেশের জন্য রাশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দুটি বন্দর ক্রিমিয়ার সেবাস্তিপোল এবং ভ্লাদিভসটক। সেবাস্তিপোল দিয়ে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে যেতে পারে কিন্তু ওখানে ন্যাটোর সদস্য তুর্কী রয়েছে। আবার ভ্লাদিবস্তক হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে আসতে গেলে যদি আমেরিকার জোট থাকে তাহলেও সমস্যা। তবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ভবিষ্যতে ন্যাটো জোট গঠন হবে কীনা তা নির্ভর করছে আমেরিকার নির্বাচনের উপর। এবছরই হওয়া আমেরিকার নির্বাচনে যদি জো বাইডেন জিতে যায় তবে আগামীদিনে যে এই জোট হতে চলেছে তা নিশ্চিত হয়ে যাবে কিন্তু যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প জেতে তবে পরিস্থিতি কীছুটা পরিবর্তন হবে কারন ডোনাল্ড ট্রাম্প এর আগে তার সময়ে কোনও যুদ্ধই করেনি বরং আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল।
উত্তর কোরিয়া ইতিমধ্যেই এই জোটের বিরুদ্ধে আক্রমনাত্মক নীতি নেওয়ার হুমকী দিয়েছে। উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি দক্ষিন কোরিয়ার কাছে দুটি ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষা করেছে, হাইড্রোজেন বোম্ব পরীক্ষাও করেছে উত্তর কোরিয়া। জাপান সাগরে প্রায়ই মিসাইল পরীক্ষা করে উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়া এমনই একটি দেশ যে আমেরিকাকেও পাত্তা দেয়না। উত্তর কোরিয়ার অভিযোগের পেছনে যথেষ্ট কারনও রয়েছে। আমেরিকা দক্ষিন কোরিয়াকে জানিয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা করতে। কিছু দিন আগেই রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন উত্তর কোরিয়া সফরে এসেছিল। এই সময় রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে একাধিক সামরিক চুক্তি হয়। রাশিয়াকে উত্তর কোরিয়া অস্ত্র বিক্রি করে। এজন্য আমেরিকা দক্ষিন কোরিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব বাড়াতে ইউক্রেনকে অস্ত্র দিতে। সেজন্য দক্ষিন কোরিয়া একপ্রকার ন্যাটোর সহযোগীই হতে চলেছে।