অফবিট

সমুদ্রে সুনামি তৈরি করার পরীক্ষা করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। কোন দেশ করেছিল?

১১ মার্চ, ২০১১, দুপুর ২:৪৬ নাগাদ জাপানের তোহোকুতে একটি ভূমিকম্প হয়, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৯, যার অর্থ এটি যথেষ্ট বিপদজনক ভূমিকম্প ছিল। কিন্তু জাপানকে বলা হয় ভূমিকম্পের দেশ, জাপানে এরকম ভূমিকম্প প্রায়ই হয় সেজন্য জাপানিরা এই ভূমিকম্পকে নিয়ে কিছু মনে করেনি তেমন। ১১ মার্চের আগেই স্থানীয় মানুষজন সতর্কবার্তা পেয়ে গিয়েছিল এই ভূমিকম্পের ব্যাপারে যার কারনে ১১ মার্চ তোহোকুতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কম হয়। সেদিন জাপানে ভূমিকম্প ছাড়াও সুনামির ব্যাপারেও সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু জাপান একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ায় জাপানিরা ভূমিকম্পের পাশপাশি সুনামিতেও অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু তোহোকুতে ভূমিকম্পের কিছুসময় পর সেইদিন জাপানে যে সুনামি আসে তা অন্যান্যদিনের মতো ছিলনা।

২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানে যে সুনামি আসে তাতে জলস্তরের উচ্চতা ছিল একশো ফুটের থেকেও বেশী, যা দিল্লিতে থাকা ইন্ডিয়া গেটের উচ্চতার থেকেও বেশী ছিল। জাপানের উপকূল থেকে দশ কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্রের জল চলে গিয়েছিল। ভয়াবহ এই সুনামিতে জাপানে প্রায় কুড়ি হাজারের বেশী মানুষের মৃত্যু হয়, ছয় হাজারের বেশী মানুষ আহত হয়ে পড়ে, বহু মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুনামিতে জাপানের দশ লাখ বাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং পাঁচ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। পরে হিসেব করে দেখা যায় এই সুনামির কারনে জাপানের ৩৬০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছিল। ২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানে হওয়া এই ভয়াবহ সুনামিকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা হয়। ২০১১ সালে জাপান যথেষ্ট উন্নত ছিল তাসত্বেও এত বেশী ক্ষতি হয় কিন্ত যদি এধরনের সুনামি আরও কয়েকবছর আগে আসত তাহলে জাপানের আরও বেশী ক্ষতি হত। ঠিক এটাই হতে চলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সেসময় যুদ্ধে জাপানকে পরাজিত করবার জন্য কিছু বিজ্ঞানি সুনামিকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল জাপানের বিরুদ্ধে।

সময়টা তখন ১৯৪৪ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে আমেরিকার লড়াই চলছিলো। প্রশান্ত মহাসাগরের জাপানি আধিপত্য ঠকাতে রীতিমতো সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল আমেরিকা। জাপানকে আটকাতে আমেরিকা নিত্য প্রচেষ্টা করে চলেছিল। এরকম সময়ে আমেরিকার নৌবাহিনীর এক অফিসার ই এ গিবসনের মাথায় এক অদ্ভুত অস্ত্র তৈরির কথা মাথায় আসে। ই এ গিবসন লক্ষ্য করেছিল যখন যুদ্ধজাহাজ উপকূলবর্তী এলকায় যেত তখন সমুদ্রের নীচে থাকা প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস করার জন্য বিস্ফোরন করা হত এবং এই বিস্ফোরনে ছোট ছোট জলের ঢেউ উৎপন্ন হত। গিবসন ভাবে জাপানের কাছে সমুদ্রে তীব্র বিস্ফোরন করলে যদি বিশাল জলের ঢেউ উৎপন্ন হয় তাহলে তা সরাসরি জাপানকে আঘাত করবে এবং জাপান আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হবে।

১৯৪৪ সালের জানুয়ারী মাসে গিবসন তার এই পরিকল্পনার কথা তার এক উচ্চপদস্থ অফিসার প্যাটিককে এই পরিকল্পনার কথা জানায়। প্যাটিকের এই পরিকল্পনা এতটা পচ্ছন্দ হয় যে তিনি এই পরিকল্পনা পুরো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকান নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল হলসিকে। হলসিরও এই পরিকল্পনা এত পচ্ছন্দ হয় যে তিনি একটি দল গঠন করেন এই প্রজেক্টের জন্য। নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড ও নিউ ক্যালেডোনিয়া শহরের উপকূলের ওয়াঙ্গাপাড়াও এলকাতে ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এই প্রজেক্টে কাজ শুরু হয়। এই প্রজেক্টে আমেরিকা ছাড়াও ও নিউজিল্যান্ডের সামরিক বাহিনী যুক্ত ছিল। অতি গোপনীয় এই প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয় প্রজেক্ট সীল, একে সুনামি বোম্বও বলা হয় পরবর্তী কালে। আমেরিকা ও ব্রিটিশরা এই প্রজেক্টকে পরমানু বোম্ব তৈরির প্রজেক্টের মতোই গুরুত্ব দিত কারন এই প্রজেক্ট উপকূলবর্তী শহরগুলোতে মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ করতে সক্ষম ছিল। এই প্রজেক্টের প্রধান বিজ্ঞানী ছিল অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ থমাস লীচ। ফেব্রুয়ারী মাস থেকে পরবর্তী সাত মাস পর্যন্ত প্রায় ৩,৭০০ পরীক্ষা করা হয় এই প্রজেক্টের। তবে এই প্রজেক্টের সবচেয়ে বেশী পরীক্ষা করা হয় ৬ জুন, ১৯৪৪ সাল থেকে। জলের নীচে ছয় পাউন্ড থেকে ছয়শো পাউন্ডের বিস্ফোরন করে পরীক্ষা করা হয়। এইসব পরীক্ষায় দেখা যায় শুধুমাত্র একবার বিস্ফোরনে বিশাল জলোচ্ছ্বাস তৈরি করা সম্ভব নয় বরং উপকূলের আট কিলোমিটারের মধ্যে কুড়ি লাখ কিলোগ্রাম বিস্ফোরন ঘটালে একটি বিশাল সুনামি তৈরি করা সম্ভব। প্রজেক্ট সীলের সর্বশেষ পরীক্ষা করার জন্য নিউজিল্যান্ডের উপকূলে দুই হাজার টিএনটি নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু পরীক্ষা শুরু করার ঠিক আগের মূহুর্তে খবর আসে আমেরিকা প্রজেক্ট সীলকে বাতিল করে দিয়েছে। প্রজেক্ট সীল বাতিল হয়ে যাওয়ার দুটি প্রধান কারন ছিল, প্রথমত অ্যাডমিরাল হলসির পদোন্নতি ঘটেছিল এবং নতুন আসা কম্যান্ডার এই প্রজেক্ট ততটা আগ্রহী ছিলনা, দ্বিতীয়ত আমেরিকা ততদিনে পরমানু বোম্ব তৈরির প্রজেক্টে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল এবং আমেরিকান সরকার মনে করেছিল প্রজেক্ট সীলের থেকে পরমানু বোম্ব বেশী কার্যকরী। এই কারনে প্রজেক্ট সীল বাতিল করে দেওয়া হয়।

১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমানু বিস্ফোরন করে যারপর ১৫ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পন করে আমেরিকার কাছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। ১৯৯৯ সালে প্রজেক্ট সীলের তথ্য খবর সামনে আনে আমেরিকার বিদেশমন্ত্রক। নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে এবং ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগোর স্ক্রিপ ওশিয়োনোগ্রাফি সংস্থায় প্রজেক্ট সীল সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য রয়েছে। ১৯৯৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয় প্রজেক্ট সীল সম্পর্কে বিশ্লেষনের পর জানায় প্রজেক্টটি কার্যকর হত। ২০০৬ সালে মিশরের এক সংবাদমাধ্যম আক ওসাবা এটা জানিয়েছিল যে ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে যে সুনামি হয়েছিল সেটা পরমানু বোম্ব পরীক্ষার কারনেই হয়েছিল।

তবে জলের নীচে বোম্ব বিস্ফোরনে তীব্র সুনামি হয় কীনা তা পরীক্ষা করার জন্য আমেরিকা ১৯৪৬ সালে মার্শাল দ্বীপে সমুদ্রে পরমানু বিস্ফোরন ঘটায় আমেরিকা কিন্তু যতটা আশা করা হয়েছিল ততটা জলোচ্ছ্বাস হয়নি। এরপর ১৯৫৮ সালে আরও দুটো পরমানু পরীক্ষা করে সমুদ্রে আমেরিকা যাদের নাম ছিল উয়াহু ও আম্ব্রেলা, এই দুই বিস্ফোরনে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল কিন্তু সুনামি হয়নি। পরবর্তীকালে আমেরিকা ছাড়াও বিভিন্ন দেশ জলের নীচে বিস্ফোরনে সুনামি হয় কীনা তা পরীক্ষা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেমন ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিখ্যাত পদার্থবিদ আন্দ্রেই শাখারোভ একশো মেগাটন পরমানু বিস্ফোরক যুক্ত টর্পেডো তৈরির পরামর্শ দিয়েছিল যা সমুদ্রের নীচে বিস্ফোরনে তীব্র সুনামি তৈরি করবে যদিও এমন কোনও টর্পেডো কখনও তৈরি করেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন। ২০১৮ সালে রাশিয়া ২০ থেকে ১০০ মেগাটন সুনামি বোম্ব তৈরি করবার ঘোষনা করেছিল। অর্থাৎ হিরোশিমা ও নগাসাকিতে আমেরিকা যে পরমানু বিস্ফোরন ঘটিয়েছিল তার থেকেও কয়েক হাজার গুন বেশী ক্ষমতা সম্পন্ন এই বোম্ব। এর নাম দেওয়া হয়েছিল স্ট্যাটাস ৬. রাশিয়ার বিখ্যাত কিলো ক্লাস সাবমেরিন তৈরি সংস্থা রুবিন ডিজাইন ব্যুরো এটি তৈরির দায়িত্বে ছিল। স্ট্যাটাস ৬ মূলত কুড়ি মিটার দৈর্ঘ্যের পরমানু শক্তিচালিত এবং পরমানু বিস্ফোরক বা কনভেনশনাল ওয়ারহেড উভয়ই বহনে সক্ষম একটি ড্রোন টর্পেডোর মতোন যা একটি সাবমেরিন থেকে লঞ্চ করা হয়, এটি সমুদ্রের নীচে এক হাজার মিটার পর্যন্ত যেতে সক্ষম।

২০২৩ সালে এটি তৈরি করেছে রুবিন ডিজাইন সংস্থা। রাশিয়া এই ড্রোন টর্পেডোতে গ্লোন্যাস স্যাটেলাইট নির্দেশ ও এআই সিস্টেম যুক্ত করেছে। ২০২৩ সালে উত্তরকোরিয়া সমুদ্রের নীচে একটি ড্রোন বিস্ফোরন পরীক্ষা করেছে যার নাম হেইল। এটি সমুদ্রের ৮০ থেকে ১৫০ মিটার গভীরতায় গিয়ে বিস্ফোরন ঘটাতে সক্ষম যাতে অনেক উচ্চ জলচ্ছাস তৈরি হয়। তবে প্রকৃতির ক্ষমতার কাছে মানুষের ক্ষমতা কিছুই নয়, ২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানে যে সুনামি এসেছিল তাতে শক্তি ছিল ৯.৩ মিলিয়ন মেগাটন কিন্ত আজ পর্যন্ত মানব ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী যে পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করা হয়েছে তা হল রাশিয়ার করা জার বোম্বা এতে ২০১১ সালে জাপানের সুনামির তুলনায় দেড় লাখ গুন শক্তি কম ছিল। এর থেকে প্রমানিত হয় যে মানুষ যত শক্তিশালী পরমানু বোম্ব তৈরিই করুক তাতে যে শক্তি তৈরি হবে তা একটি প্রাকৃতিক সুনামির তুলনায় অনেক কম হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রজেক্ট সীলের পাশাপাশি বাউন্সিং বোম্বও তৈরি করা হয়েছিল যার লক্ষ্য ছিল জার্মান ড্যামগুলোকে আঘাত করে ধ্বংস করে দেওয়া যাতে জার্মানিতে বিশাল বন্যা হয় এবং জার্মানির শিল্পাঞ্চলগুলি ধ্বংস হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *