অফবিট

ইহুদীদের বিশেষ টার্গেট

দিনটা ১৮ অক্টোবর, ১৯৭৭ সাল, বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক দেশ সোমালিয়ার মোগাদিশু বিমানবন্দরের রানওয়েতে দাড়িয়ে আছে লুফথানসার বিমান ১৮১। গোটা বিশ্বের নজর তখন সোমালিয়ার দিকে কারন ওই লুফথানসা ১৮১ বিমানটি হাইজ্যাক করা হয়েছিল, বিমানে থাকা ৮৬ জন যাত্রী ও পাঁচজন ক্রু সদস্যের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র ধরে দাঁড়িয়েছিল চরজন সন্ত্রাসী যারা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও এর সদস্য। এই বিমানের ৯১ জন মানুষকে উদ্ধারের দায়িত্ব ছিল পশ্চিম জার্মানির উপর। পাঁচ বছর আগে ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকের স্মৃতি তখনও ভুলতে পারেনি পশ্চিম জার্মানি। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলি খেলোয়াড়ের বন্দী বানায় পিএলও কিন্তু তাদের উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় পশ্চিম জার্মানি ফলত ১১ জন ইসরায়েলি খেলোয়াড় ও পাঁচজন আরব নাগরিকের মৃত্যু হয়। ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অলিম্পিক ছিল মিউনিখ অলিম্পিক যা মিউনিখ ম্যাসাকার নামে কুখ্যাত। 

পাঁচ বছর পর আবারও পশ্চিম জার্মানিকে সমস্যায় ফেলে পিএলও। ১৩ অক্টোবর স্পেন থেকে লুফথানসা ১৮১কে হাইজ্যাক করে রোম, লার্নাকা, বাহরিন, দুবাই, এডেন হয়ে মোগাদিশু নিয়ে আসে সন্ত্রাসীরা। পশ্চিম জার্মানি ওই নাগরিকদের উদ্ধারের দায়িত্ব দেয় তাদের সন্ত্রাসী দমন সংগঠন জিএসজি ৯কে। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে জিএসজি ৯ তৈরি করা হয়েছিল। রক্তাক্ত মিউনিখ অলিম্পিকের পর এরকম ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না হয় তার জন্য এই বিশেষ সংগঠন তৈরি করেছিল পশ্চিম জার্মানি। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বিদেশের মাটিতে প্রথম এরকম বিপদজনক মিশনের দায়িত্ব পায় জিএসজি ৯. এধরনের কোনও মিশনের অভিজ্ঞতা না থাকায় জিএসজির জন্যেও এই মিশন ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ন।

১৯৭৭ সালের ১৩ অক্টোবর স্পেনের পালমা বিমানবন্দর থেকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার জন্য তৈরি হয় লুফথানসা ১৮১। সকাল এগারোটা নাগাদ পালমা বিমানবন্দর থেকে উড়ান শুরু করে লুফথানসা ১৮১, সাড়ে এগারোটা নাগাদ চারজন যাত্রী হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে এবং হাতে বন্দুক নিয়ে হাইজ্যাক বলে চেঁচিয়ে ওঠে। ওই চারজন ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে কম্যান্ডো মার্টিয়ার হালিমা বলে ডাকছিলো। ব্রিগেট খুলমানের সম্মানে তারা এই নামে ডাকছিলো। এই ব্রিগেট খুলমান ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে এয়ারফ্রান্সের বিমান ১৩৯কে হাইজ্যাক করেছিল। বিমান ১৩৯কে উগান্ডার অ্যান্টেবে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওই বিমানে ইসরায়েলি যাত্রীই বেশী ছিল। ইসরায়েলি যাত্রীদের নিরাপদে উদ্ধার করে মোসাদ অপারেশন থান্ডারবোল্টের মাধ্যমে। যে চারজন ব্যাক্তি লুফথানসা ১৮১কে হাইজ্যাক করেছিল তাদের মধ্যে দুজন ফিলিস্তিন এবং দুইজন লেবাননের নাগরিক ছিল। জোহাইর আকাচে বা মাহমুদ, সুহাইলা শাহে, ওয়াবিল হার্ব এবং হিন্দ আলামে নামক এই চারজন লুফথানসা ১৮১কে হাইজ্যাক করেছিল যাদের প্রত্যেকের বয়স বাইস থেকে চব্বিশ বছরের মধ্যে ছিল। মাহমুদ বিমানের পাইলটকে নির্দেশ দেয় সাইপ্রাসের লার্নাকা বিমানবন্দরে অবতরন করার। কিন্তু বিমানে জ্বালানি কম থাকায় বিকেল ৩:৪৫ নাগাদ রোমের ফিউমিশিনো বিমানবন্দরে অবতরন করে বিমানটি। রোমে পৌঁছেই ওই চারজন হাইজ্যাকাররা তাদের প্রথম দাবী জানায় যে পশ্চিম জার্মানির জেলে বন্দী থাকা রেড আর্মি ফ্যাকশন দলের মুক্তি। এই রেড আর্মি দল পাঁচ সপ্তাহ আগেই পশ্চিম জার্মানির শিল্পপতি হানস মার্টিনকে অপহরন করে তিনটি দাবী রেখেছিল, পশ্চিম জার্মানির স্ট্যামহেন জেলে থাকা দশজন রেড আর্মি ফ্যাকশন সদস্যের মুক্তি, তুরস্কের জেল থেকে দুজন প্যালেস্টাইনের মুক্তি এবং পনেরো মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। 

পশ্চিম জার্মানি ইতালিকে নির্দেশ দেয় বিমানের টায়ারে গুলি করতে যাতে বিমান উড়তে না পারে কিন্তু ইতালি এই সমস্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখে। বিকেল ৫:৪৫ নাগাদ এগারো টন জ্বালানি সহ লুফথানসা ১৮১ সাইপ্রাসের লানার্কা বিমানবন্দরে উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। লানার্কা বিমানবন্দরে কিছুক্ষন থাকার পর মাহমুদ পাইলটকে নির্দেশ দেয় বিমান মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নিয়ে যেতে। বেইরুট, দামাস্কাস, কুয়েত, বাগদাদ সহ মধ্যপ্রাচ্যের সমস্ত বড় বড় বিমানবন্দর লুফথানসা ১৮১কে অবতরনের অনুমতি দেয়নি, এদিকে বিমানে জ্বালানিও কমে আসছিলো, বাধ্য হয়ে বাহরিনের উদ্দেশ্যে রওনা হয় বিমানটি। বাহরিনের বিমানবন্দরেও লুফথানসা ১৮১কে নামবার অনুমতি দেওয়া হয়নি কিন্তু বিমানের জ্বালানি অতিরিক্ত কমে আসায় জোর করে বাহরিন বিমানবন্দরে অবতরন করায় পাইলট। বাহরিন থেকে জ্বালানি ভরে ১৪ অক্টোবর দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয় লুফথানসা ১৮১। দুবাই বিমানবন্দরেও বিমান ১৮১কে অবতরনের অনুমতি দেওয়া হয়নি কিন্তু জ্বালানি কম থাকায় এবারও বাধ্য হয়ে পাইলট বিমানকে অবতরন করায়। দুবাই বিমানবন্দরে মাহমুদ বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেয় বিমান পরিষ্কার করার, জ্বালানি ভরে দেওয়ার জন্য এবং খাদ্য, জল পাঠাতে। বিমানে সেসময় কিছু কারিগরী সমস্যা ছিল যা ঠিক করা হয় এবং দুবাই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসীদের সমস্ত দাবী মেনে নেয়। ১৬ অক্টোবর ১২:১৯ নাগাদ লুফথানসা ১৮১ ওমানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, কিন্তু ওমান কর্তৃপক্ষ বিমানকে নামার অনুমতি দেয়নি, বাধ্য হয়ে সৌদি আরবের রিয়াদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে বিমান কিন্তু সেখানেও নামার অনুমতি দেওয়া হয়নি বাধ্য হয়ে ইয়ামেনের এডেন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানটিকে জরুরী অবতরন করায় পাইলট। এখানেই বিমানের একজন পাইলট শুম্যানকে হত্যা করে মাহমুদ এবং জ্বালানি ভরে যাত্রা শুরু করে সোমালিয়ার উদ্দেশ্যে, ১৭ অক্টোবর সকাল ৬:৩৪ নাগাদ সোমালিয়ার মোগাদিশু বিমানবন্দরে অবতরন করে লুফথানসা ১৮১ বিমানটি। সন্ত্রাসীরা সোমালিয়ার সরকারের কাছে খাদ্য, জলের দাবী করে। সোমালিয়ার সরকার সন্ত্রাসীদের অনুরোধ করে মহিলা ও বাচ্ছাদের মুক্তি দিতে। মাহমুদ বিকেল চারটে পর্যন্ত পশ্চিম জার্মানিকে সময় দেয় রেড আর্মি ফ্যাকশনের সদস্যদের মুক্তি দেওয়ার জন্য নাহলে প্রত্যেক যাত্রীকে হত্যা করবার হুমকী দেয়। পশ্চিম জার্মানির সরকার মাহমুদকে অনুরোধ ১৮ অক্টোবর বেলা ২:৩০ পর্যন্ত সময় দেওয়া হোক, তার মধ্যেই সমস্ত বন্দীকে মোগাদিশু পৌঁছে দেওয়া হবে। ততদিনে জার্মানির জিএসজি ৯ উদ্ধারকার্যের জন্য যথেষ্ট প্রস্ততি নিয়ে ফেলেছিল। জিএসজি ৯ একটি ডামি বিমানে উদ্ধারকার্যের জন্য ৪৫ ঘন্টা অপারেশন প্রশিক্ষন করে। ১৭ অক্টোবর জিএসজি ৯ এর প্রধান কম্যান্ডার উলরিখ ওয়েগনার সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে মোগাদিশু এসে পৌঁছায়। পশ্চিম জার্মানি থেকে জিএসজি ৯ এর ৩০ জন কম্যান্ডো প্রথমে জীবুতি যায়, সেখান থেকে ইথিওপিয়া হয়ে রাত আটটার সময় মোগাদিশু গিয়ে পৌঁছায়। উলরিখ ওয়েগনার পরিকল্পনা তৈরি করে রাত দুটোর সময় বিমানে অভিযান শুরু করা হবে এবং সমস্ত দল ছয়টি ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন ফিউয়েরজাওবের বা অপারেশন ম্যাজিক ফায়ার। 

রাত দুটোর সময় মাহমুদকে জানানো হয় পশ্চিম জার্মানি বন্দীদের একটি বিমানে করে মোগাদিশু পাঠিয়ে দিয়েছে এবং বিমানটি কায়রোতে জ্বালানি ভরছে। এদিকে রাত দুটোর সময় জিএসজি ৯ এর কম্যান্ডোরা ছয়টি দলে বিভক্ত হয়ে মই নিয়ে বিমানের দিকে এগোতে শুরু করে। সন্ত্রাসীদের মোনোযোগ আকর্ষনের জন্য সোমালিয়ার সেনাবাহিনী বিমান থেকে ষাট মিটার দূরে একটি গাড়িতে বিস্ফোরন ঘটায়। এই ঘটনায় তিনজন সন্ত্রাসী বিমানের ককপিটে চলে আসে কি হচ্ছে দেখতে। এই সুযোগে জিএসজি ৯ এর একটি দল বিমানের দরজায় বিস্ফোরন ঘটিয়ে দরজা খোলে। মেজর উলরিখ ওয়েগনার তার দলের সাথে বিমানের ভিতর ঢোকে, বিমানের জরুরী দরজা দিয়েও আরও দুটি জিএসজি ৯ দল বিমানের ভিতর ঢোকে। জিএসজি ৯ দল জার্মান ভাষায় বিমানের সমস্ত যাত্রীকে নীচে ঝুঁকতে নির্দেশ দেয় এবং কয়েক মহূর্তের মধ্যে বিমানের ভিতরেই উভয়পক্ষের মধ্যে গুলির লড়াই শুরু হয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুরো অপারেশন শেষ হয়, তিনজন সন্ত্রাসী মারা যায় এবং সুহাইলা শাহেকে গ্রেফতার করা হয়। মাহমুদ গুলির আঘাতে চার ঘন্টা পর মারা যায়। এই অপারেশনে তিনজন যাত্রী ও একজন বিমান কর্মী আহত হয়। বিমানের ভিতর থেকে জিএসজি ৯ কম্যান্ডোর বাইরে থাকা দলের উদ্দেশ্যে বলে স্প্রিংটাইম, স্প্রিংটাইম। এই সাংকেতিক শব্দের অর্থ অভিযান সফল হয়েছে। এই ঘটনার কয়েকঘন্টা পর অন্য একটি বিমানে করে যাত্রীদের পশ্চিম জার্মানি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জিএসজি ৯ এর কম্যান্ডোরা অসাধারন দক্ষতায় পুরো অপারেশন সম্পন্ন করেছিল যাতে কোনও সাধারন যাত্রীর প্রানহানি হয়নি।

অপারেশন ফিউয়েরজাওবেরের সফলতা পশ্চিম জার্মানিকে মিউনিখ অলিম্পিকের কলঙ্ক থেকে কিছুটা মুক্তি দেয়, সেইসাথে পিএলওকেও কড়া জবাব দেওয়া হয়। সোমালিয়া এই ঘটনায় পশ্চিম জার্মানিকে ব্যাপক সহায়তা করেছিল। 

এই ঘটনার পর সোমালিয়া ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যে একটি মজবুত কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। পশ্চিম জার্মানির সরকার এরপর সোমালিয়াকে ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে, কৃষিকাজে অনেক সহায়তা করেছিল। জিএসজি ৯ বর্তমানে বিশ্বের দশটি সেরা বিশেষ সেনাদলের একটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *