চীনের তিব্বত দখলের সাত দশক পর হঠাৎই বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার চাপ
১৯৫০ এর দশকে চীন যখন বলপূর্বক তিব্বত দখল করে নেয় তখন তিব্বতের দলাই লামা ভারতে এসে আশ্রয় নেয়। সেসময় গোটা বিশ্ব তিব্বত নিয়ে তেমন কোনও প্রতিবাদ করেনি চীনের বিরুদ্ধে। কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎই তিব্বত যেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ন অংশ হয়ে উঠেছে। বিশ্বস্তরে মুক্ত তিব্বত আওয়াজ ওঠা শুরু হয়েছে। ভারত তিব্বতীয় শরনার্থীদের একসময় আশ্রয় দিয়েছিল। তিব্বতীয় বৌদ্ধ শরনার্থীরা ভারতে তাদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে হিমাচল প্রদেশের ধরমশালাতে তিব্বতীয় সংস্কৃতি যথেষ্ট পরিমানে লক্ষ্য করা যায়। চীনের তিব্বত দখল করার সাত দশক পরে হঠাৎই পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তিব্বত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
হিমালয় পর্বতমালার উত্তরে ৪,৫০০-৫০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত তিব্বত মালভূমি ২.৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। অত্যাধিক শীতল এই অঞ্চলের জনসংখ্যা খুবই কম। এখানে বিভিন্ন তিব্বতীয় উপজাতি সম্প্রদায় রয়েছে তবে তিব্বতে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মেরই আধিক্য রয়েছে। দলাই লামা তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান। তিব্বতের তেরোতম দলাইলামা থুবটেন গেয়াতসো তিব্বতকে স্বাধীন ঘোষনা করে ১৯১৩ সালে। তিব্বত ও ভারতের সীমান্ত রয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই, চীন এখানে কোথাও ছিলইনা। ১৯১২ সাল থেকে ১৯৪৯ সালে চীন তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিব্বতে চীনের কোনও প্রভাবই ছিলনা। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত দলাই লামার সরকারই তিব্বতের সরকারে ছিল। কিন্তু ১৯৫১ সালে মাও জেডং এর নেতৃত্বে চীনের সেনাবাহিনী তিব্বত আক্রমন করে সেখানে গনহত্যা চালায়, স্থানীয়দের বন্দী করে এবং তিব্বতীয় সরকারকে বাধ্য করে চীনের সাথে সতেরো পয়েন্টের চুক্তি করতে। এই চুক্তিতে চীন জানায় তিব্বতে স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়া হবে, তার ধর্মীয় অধিকারের স্বাধীনতা দেওয়া হবে কিন্তু তিব্বতের বিদেশনীতি, সামরিক নিরাপত্তা চীনের দায়িত্বে থাকবে। অদ্ভুত ব্যাপার হল সেসময় ভারত সরকারও তিব্বতকে চীনের অংশ হিসাবে মেনে নেয়। সেসময় ভারতের বিদেশনীতি অদ্ভুত ছিল হিন্দি চীনি ভাই ভাই তত্বে বিশ্বাসী ছিল ভারত। ১৯৫০ এর দশকে ভারত আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনও পক্ষেই না গিয়ে জোট নিরপেক্ষ ছিল। ১৯৫৯ সালে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতে আন্দোলন শুরু হয়। চীন এতটাই নির্মম ভাবে এই আন্দোলন দমন করে যে দলাই লামা সহ বহু তিব্বতীয় মানুষ ভারতে পালিয়ে আসে। ভারত সরকার তিব্বতীয় শরনার্থীদের ধরমশালাতে আশ্রয় দেয়। সেখানে তিব্বতীয়রা নির্বাসিত সরকার গঠন করে। ১৯৫৯ সাল থেকে চীন তিব্বতের সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করে নিজেদের সংস্কৃতি আরোপিত করে দেয়। গনহত্যা, সাধারন মানুষের উধাও হয়ে যাওয়া, তিব্বতীয় জনসংখ্যা কমানোর ব্যবস্থা করার মতোন তিব্বতে অসংখ্য অত্যাচার করেছে সেসময় চীন। ঠিক তিব্বতের মতোই শিনজিয়াং প্রদেশেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমননীতি চালায় চীন। তিব্বত ও শিনজিয়াং প্রদেশকে এভাবেই চীন জোর করে ধরে রেখেছে। তিব্বত দখল করেই চীন ভারত ও তিব্বতের পুরোনো সীমান্ত মানতে অস্বীকার করে। ১৯১৪ সালে সিমলা চুক্তি অনুযায়ী ম্যাকমোহন লাইনকে ভারত ও তিব্বতের মধ্যে সীমানা মানা হয়। কিন্তু চীন তিব্বত দখলকরে জানায় তারা তিব্বতকে স্বাধীন দেশ হিসাবে কোনওদিন মানেইনি সুতরাং নতুনকরে সীমানা নির্ধারন করা হবে। ভারত চীনকে তিব্বত নিয়ে প্রথমদিকে কীছু বলেনি কারন সেসময় ভারত মনে করেছিলো চীনকে তারা তিব্বত নিয়ে কিছু বলবেনা তাহলে চীনও কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করবেনা। কিন্তু ১৯৬২ সালের ভারত চীন যুদ্ধের পর থেকে চীনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায় ভারতের। চীন দলাই লামা, অরুনাচল প্রদেশ নিয়ে এতটাই সংবেদনশীল যে যদি দলাই লামার সাথে কোনও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা বিদেশী কুটনীতিবিদরা দেখা করতে যায় কিংবা অরুনাচল প্রদেশে ভরতের প্রধানমন্ত্রী যায় তাহলে চীন প্রতিবাদ করে।
তবে সম্প্রতি তিব্বতের নতুন দলাই লামা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভূরাজনীতিতে বড় সমস্যা দেখা দিতে চলেছে। আমেরিকার কংগ্রেস ইতিমধ্যেই তিব্বত নিয়ে একটি বিল পাস করিয়েছে যাতে শুধু রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের স্বাক্ষর বাকী আছে। ২০০২ সালে ও ২০২০ সালে আমেরিকা তিব্বত নিয়ে বিল পাস করিয়েছিলো, তবে এবারের বিল কিছুটা আলাদা। আমেরিকা জানিয়েছে তিব্বতের ইতিহাস, তিব্বতীয় মানুষজন ও দলাই লামা সম্পর্কে চীনের মিথ্যাচার রুখতে তারা অর্থায়ন করবে। চীন জো বাইডেনকে এই বিলে সই না করতে প্রতিবাদ করেছে। তবে চীন তিব্বতকে কখনওই স্বাধীনতা দেবেনা এট বুঝতে পেরেই ধরমশালাতে থাকা দলাই লামা এখন আর তিব্বতের স্বাধীনতার দাবী করছেন না তিনি চাইছেন চীন সরকার যেন তাদের স্বায়ত্ত্বশাসন দেয় এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়। আমেরিকা ইতিমধ্যেই তাদের এক প্রতিনিধি দলকে ধরমশালা পাঠিয়েছে তিব্বতীয়দের সাথে কথা বলতে। এই দলের নেতা ন্যান্সি পেলোসি ধরমশালা থেকে চীনের সরকারকের সমালোচনা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তিব্বতে চীনের মানবতাবিরেধী কার্যকলাপের সমালোচনা করেছে। আমেরিকা এই মূহুর্তে চীনকে আটকাতে বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন তিনি বাংলাদেশে আমেরিকার একটি ঘাঁটি তৈরির প্রস্তাব পেয়েছিলেন। আমেরিকা ভারত, বাংলাদেশ কিংবা মায়নামারে একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরিতে ব্যাপক আগ্রহী কারন আমেরিকা দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতেও চীনকে প্রতিরোধ করতে চাইছে। ইতিমধ্যেই দক্ষিন চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু দেশ তাদের নৌবাহিনী মোতায়েন রেখেছে। এবার দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে চীনকে কাউন্টার করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমেরিকা জানে চীনকে আগামী দশ পনেরো বছরের মধ্যে নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে চীন সারা বিশ্বের জন্যই হুমকী হয়ে উঠবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময় থেকে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে বানিজ্য যুদ্ধ চলছে। চীন থেকে সমস্ত আমেরিকান সংস্থা তাদের উৎপাদন কেন্দ্র সরিয়ে নিচ্ছে। চীনের বহু সংস্থার উপর প্রযুক্তি চুরির অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমেরিকা। বর্তমানে বিশ্বে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি জোট গঠন হয়েছে। ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে রাশিয়াকে ব্যাপক অস্ত্র, প্রযুক্তি সরবরাহ করছে চীন। সেজন্য ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়াকে আটকে দিয়েছে আমেরিকা। ইউক্রেনকে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো নির্দেশ দিয়েছে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমন করতে যাতে রাশিয়া ব্যস্ত থাকে। চীনকে আরও শক্তভাবে প্রতিরোধ করতে আমেরিকা এবার তিব্বতের দিকে নজর দিয়েছে। ভারতও আমেরিকার এই পদক্ষেপে আমেরিকার সাথে রয়েছে। চীন এতদিন যা করেছে, ভারত এবার চীনকে চীনের ভাষাতেই জবাব দেওয়া শুরু করেছে। চীন অতীতে বহুবার অরুনাচল প্রদেশের নাম বদলে দিয়েছে, এবার ভারতও তিব্বতের বহু জায়গার নাম বদলে দিয়েছে। চীন ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সহায়তা করছে। ভারতও এবার চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে সহায়তা করছে। সুতরাং তিব্বতকে কেন্দ্র করে দক্ষিন এশিয়ায় বর্তমানে ব্যাপক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে।