৫ কোটি মানুষের মৃত্যু। বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক মহামারী
২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে চীনের উহান শহর থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে যাতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্ত করোনা মহামারীর থেকেও বিপদজনক আরও একটি মহামারী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে।
১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে এই ভয়ানক মহামারী স্প্যানিশ ফ্লুর কারনে বিশ্বজুড়ে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক রোগ বলা হয় এই স্প্যানিশ ফ্লু। এই রোগে তৎকালীন বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষ আক্রান্ত ছিল। এই মহামারীর কবলে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলা হলেও বেশ কিছু চিকিৎসাবিদদের দাবী প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশী ছিল, অন্তত দশ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই রোগে। এই মহামারীতে মৃত্যুর হার ছিল দশ শতাংশ অর্থাৎ যত লোক আক্রান্ত হত তার দশ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় এই মহামারীতে। স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল যার দশ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ মিলিয়ন বা পাঁচ কোটি লোক মারা যায়। করোনা ভাইরাসে যেমন ৬০ বছরের বেশী বয়সের লোকেদের বেশী বিপদের আশঙ্কা ছিল কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লুতে কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর বয়সী মানুষ বেশী আক্রান্ত হয়েছিল, এটাই ছিল স্প্যানিশ ফ্লুর বিশেষত্ব।
জানুয়ারি, ১৯১৮ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক মহামারী স্প্যানিশ ফ্লু এবং ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে এই মহামারীর প্রকোপ কমতে শুরু করে। স্প্যানিশ ফ্লুর পেছনে প্রধান কারন ছিল এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। এই এইচ১এন১ ভাইরাসই ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়েছিল। এই ভাইরাসের উৎস নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, অনেক বিজ্ঞানীদের দাবী মধ্য আমেরিকার বন্য ষাঁড়ের মাংস থেকে এই এইচ১এন১ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। ১৯১৭ সালে আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। বলা হয় ১৯১৭ সালে যেসব আমেরিকান সেনা ইউরোপে পৌঁছেছিল তাদের মাধ্যমেই এই ভাইরাস ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার চলছিলো অর্থাৎ মিত্রশক্তি বা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সেনাবাহিনী এবং জার্মানির সেনাবাহিনী উভয় উভয়ের বিরুদ্ধে কয়েকশো কিলোমিটার লম্বা পরিখা খনন করে তার মধ্যে যুদ্ধ করছিল। চার বছর ধরে পরিখার ভিতরেই যুদ্ধ চলছিল। পরিখার ভিতর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেনারা দীর্ঘদিন যুদ্ধ করায় এই ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বাকী সেনাদের মধ্যে। যেসব ব্যক্তি এই ভাইরাসে খুব বেশী আক্রান্ত হত তাদের হসপিটাল বা নিজের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হত। ওইসব আক্রান্ত ব্যক্তিরা যখন নিজের শহর, দেশে যেত তখন তাদের শরীর থেকে এই ভাইরাস স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তো। এভাবে স্প্যানিশ ফ্লু সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরিখার ভিতর যুদ্ধ মূলত চলছিল ফ্রান্স ও জার্মানির সীমান্তে মার্নে নামক অঞ্চলে, এখান থেকেই স্প্যানিশ ফ্লু সেনা সদস্যদের মাধ্যমে ভারত সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই মহামারীর সূত্রপাত আমেরিকা থেকে শুরু হলেও এর নাম স্প্যানিশ ফ্লুর হওয়ার পেছনে ব্রিটিশ মিডিয়া দায়ী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে স্পেন নিরপেক্ষ দেশ ছিল, স্পেন মিত্রশক্তি বা সেন্ট্রাল পাওয়ার কোনওপক্ষেই যোগ দেয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশগুলো নিজেদের মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রন করতো যার কারনে এই মহামারীর খবর দেশগুলো প্রথমে প্রকাশ করেনি। কিন্তু স্পেন নিরপেক্ষ থাকায় এই মহামারীর খবর স্পেন প্রথম প্রকাশ করে, এরপর থেকেই ব্রিটিশ মিডিয়া এই মহামারীর নাম দেয় স্প্যানিশ ফ্লু। সেসময় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি কোনও দেশ থেকেই এই মহামারীর ব্যাপারে কোনও প্রচারই করা হতনা, শুধু স্পেন থেকেই সঠিক খবর পাওয়া যেত। স্পেনের রাজা ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা পর্যন্ত স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল, যার কারনে ব্রিটিশ ও আমেরিকান মিডিয়া একে স্প্যানিশ ফ্লু নাম দেয়। স্প্যানিশ ফ্লুকে ভুলে যাওয়া মহামারীও বলা হয় কারন এই ভাইরাস সম্পর্কে পরবর্তী কালে তেমন কোনও গবেষনা হয়নি। তাছাড়া উনবিংশ শতাব্দীর দিকে প্রচুর লোক ডিপথেরিয়া, কলেরা, ম্যালেরিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেত যার জন্য এধরনের ভাইরাসে তখনকার দিনে মানুষ অভ্যস্ত ছিল। ২০০৫ সালে স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে যখন গবেষনা হয় তখন জানা যায় ১৯১৮ সালে যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ছিল সেটি ইনফ্লুয়েঞ্জার সমস্ত প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক ছিল।
১৯১৮ সালের প্রথম দিকে এইচ১এন১ ভাইরাস ততটা বিপদজনক ছিলনা কিন্তু সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাস আসতে আসতে এই ভাইরাস ভয়ানক মহামারীর রূপ ধারন করে এবং মৃত্যুহার প্রচুর পরিমানে বৃদ্ধি পায়। এই ভাইরাসে এত বেশী লোকের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান হচ্ছে সেসময় সঠিক কোনও অ্যান্টিবায়োটিক ছিলনা। এই ভাইরাসে আক্রন্ত হওয়ার পর বেশীরভাগ মানুষ নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হত। বর্তমান সময়ের আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৌলতে যেমন নিউমোনিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে কিন্তু সেসময় নিউমোনিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক ছিলনা। এছাড়া এই ভাইরাসে আক্রন্ত ব্যক্তি শ্বাসজনিত অসুখের পাশাপাশি আরও অনেক ধরনের রোগে আক্রান্ত হত যাতে মৃত্যুহার বেড়ে যায়। সেসময় ইন্টারনেট এবং হু এর মতোন কোনও সংস্থা না থাকায় মানুষ এই রোগ থেকে সচেতন থাকার ব্যাপারে তেমন কিছু জানতেও পারেনি যার কারনে এই রোগ আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এই স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ন্ত্রনের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে দুই তিন বছর আগে যেমন লকডাউন করা হয়েছিল, ভ্রমন বাতিল করা হয়েছিল, স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল সহ সমস্ত গন পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই ১৯১৮ সালে আমেরিকার অনেক শহরে লকডাউন করা হয়, ভ্রমন বাতিল করা হয়, সমস্ত স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়, এমনকী আমেরিকার শহরগুলোতে প্রকাশ্য রাস্তায় থুতু ফেললে এবং কাশলে জরিমানা করা হত। সেসময় আমেরিকার বেশ কিছু সেনাবেসকে অস্থায়ী হসপিটালে পরিনত করে চিকিৎসা করা হতে থাকে সাধারন মানুষের।
রেড ক্রশের মতোন আন্তর্জাতিক সংস্থা সেসময় সাধারন মানুষকে চিকিৎসার প্রশিক্ষন দিয়ে আক্রান্ত মানুষের সেবায় নিয়োগ করেছিল। স্প্যানিশ ফ্লুর সময় আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরে একটি অদ্ভুত ঘটনা হয়। ১৯১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান সেনাবাহিনীর সম্মানে ফিলাডেলফিয়া শহরের জ্যামড ব্রড সরনীতে প্রায় দুই লাখ মানুষের উপস্থিতিতে একটি বিশাল প্যারেডের আয়োজন করা হয়। এত মানুষের উপস্থিতিতে স্প্যানিশ ফ্লু ব্যাপক ভাবে ফিলাডেলফিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। প্যারেডের একসপ্তাহের মধ্যে ফিলাডেলফিয়াতে ২,৬০০ লোকের মৃত্যু হয় এবং ৩১ টি হসপিটাল পুরো আক্রান্ত রোগীতে ভর্তি হয়ে যায়। মধ্যযুগে একটি ভয়ানক রোগ ছিল ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ মহামারী। কিন্ত প্লেগ মহামারী একশো বছরে যত মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল তার থেকে বেশী মানুষের মাত্র একবছরে মৃত্যু হয় স্প্যানিশ ফ্লুতে। এইডস রোগ ২৪ বছরে যত মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল তার থেকে বেশী মানুষ ২৪ সপ্তাহে স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা গিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চার কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লুতে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। আমেরিকাতে স্প্যানিশ ফ্লু এর কারনে ৬,৭৫,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল যা আমেরিকার মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ ছিল। আমেরিকার জনসংখ্যার উপর স্প্যানিশ ফ্লু এর প্রভাব এত বেশী ছিল যে ১৯১৭ সালে যেখানে আমেরিকার মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫১ বছর সেখানে মাত্র একবছরে গড় আয়ু ১২ বছর কমে হয় ৩৯ বছর। স্প্যানিশ ফ্লুকে ভারতে ১৯১৮ সালে বোম্বে ফিভার নাম দেওয়া হয়। এর প্রভাবে সেসময় ভারতেও এক থেকে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ভারতে বোম্বে বন্দর দিয়ে এই মহামারী ভারতে প্রবেশ করেছিল। সেসময় ভারতে ব্রিটিশ শাসন ছিল, সাধারন ভারতবাসীর স্বাস্থ্যে কোনও নজর দেয়নি ব্রিটিশ সরকার যার কারনে এত বেশী ভারতীয়র মৃত্যু হয়েছিল। ১৯১৮ সালের সময় চিকিৎসা বিজ্ঞান এতটা আধুনিক ছিলনা, অ্যান্টিবায়োটিক ছিলনা, ১৯৩০ সালের আগে মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে ভাইরাস পর্যবেক্ষন করার ব্যবস্থাও ছিলনা, যার ফলে কোনও ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি সেসময়। যার জন্য বিশ্বজুড়ে এত বিশাল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯১৮ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৮০ কোটি তারমধ্যেই পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়, এরমধ্যে ভারতেই প্রায় দুই কোটি মানুষ মারা যায় অর্থাৎ স্প্যানিশ ফ্লু এর প্রভাবে যত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই ভারতীয় ছিল।