রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে হওয়া গুরুত্বপূর্ন চুক্তি
বিশ্ব রাজনীতিতে খুব দ্রুত আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিপক্ষে একটি সমীকরন তৈরি হচ্ছে যার নেতৃত্বে রয়েছে রাশিয়া। সম্প্রতি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের উত্তর কোরিয়া সফরে নজর রয়েছে সারা বিশ্বের। এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন কারন দীর্ঘ ২৪ বছর পর উত্তর কোরিয়া সফরে গেছেন কোনও রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি। উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ংএ ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের বৈঠকে উভয়দেশের মধ্যে একাধিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে প্রতিরক্ষা চুক্তি। উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে বর্তমানে একটি অঘোষিত জোট তৈরি হয়েছে। এই জোটকে বলা হচ্ছে অ্যাক্ষিস অফ ইভেলস বা শয়তান অক্ষ। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়ার উত্তর কোরিয়াকে প্রয়োজন এবং উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে অস্ত্র দিচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা করছে এবং রাশিয়ার উপর বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমেরিকা যতদিন সাহায্য করবে ততদিন ইউক্রেন যুদ্ধে হারবেনা। এই জন্য রাশিয়া ক্রমশ পশ্চিমা বলয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে হওয়া গুরুত্বপূর্ন চুক্তি :-
** একে অন্যের ভূমিতে আক্রমন করবেনা, উভয়দেশই উভয়ের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেনা। উত্তর কোরিয়া দেশটি তৈরিই হয়েছে রাশিয়ার জন্য। ১৯৫০-১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হওয়া কোরিয়ান যুদ্ধে উত্তর কোরিয়াকে সহায়তা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং দক্ষিন কোরিয়াকে সহায়তা করে আমেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ রাশিয়া। সুতরাং উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার কুটনৈতিক সম্পর্ক বহু পুরোনো।
** পরিবর্তনশীল বিশ্বরাজনীতিতে উভয়দেশই নিজেদের মধ্যে স্ট্রাটেজিক সহায়তার জন্য চুক্তি করেছে। এই চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ন। সাধারনত দুটি দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চুক্তি হয়। কিন্তু যদি দুটি দেশের মধ্যে স্ট্রাটেজিক চুক্তি হয় তাহলে সেই চুক্তির গুরুত্ব বহুংশে বেড়ে যায়। এই চুক্তির অর্থ প্রয়োজনে উভয়দেশে উভয়দেশকে তৃতীয় কোনও দেশের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় সহায়তা করবে। যেমন রাশিয়া বর্তমানে উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র কিনছে। আবার প্রয়োজনে উত্তর কোরিয়াকেও অস্ত্র বিক্রি করবে রাশিয়া ভবিষ্যতে। বহুদিন ধরেই উত্তর কোরিয়া তার বায়ুসেনার জন্য রাশিয়ার সুখোই ৩৫ এর মতো আধুনিক যুদ্ধবিমান কিনতে চাইছিলো, এই চুক্তির মাধ্যমে সেই পথ প্রশস্থ হল।
** যদি দুই দেশের মধ্যে কোনও দেশের উপর তৃতীয় কোনওদেশ আক্রমন করে তাহলে অপরদেশটি তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে এবং সামরিক সহায়তা করবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কখনও উত্তর কোরিয়ার উপর আমেরিকা আক্রমন করলে রাশিয়া তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। এটা অনেকটা ন্যাটোর মতোন ব্যপাার। ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি চুক্তি আছে যদি কখনও একটি ন্যাটো দেশকে কোনওদেশ আক্রমন করে তাহলে সমস্ত সদস্য দেশ আক্রমনকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এরকম গোপন চুক্তি ছিল।
** দুই দেশ কখনওই তৃতীয় কোনও দেশের সাথে এমন চুক্তি করবেনা যে চুক্তির ফলে অপরপক্ষের ক্ষতি হবে। যেমন যদি ভবিষ্যতে আমেরিকা উত্তর কোরিয়ার সাথে এমন কোনও চুক্তি করতে চায় যেখানে রাশিয়ার ক্ষতি হবে তাহলে উত্তর কোরিয়া কখনওই সেই চুক্তি করবেনা।
** জাতিসংঘ সহ সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাতে একে অপরকে সহায়তা করবে।
** প্রতিরক্ষাক্ষেত্রেও দুই দেশ একসাথে কাজ করবে। অর্থাৎ রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া একসাথে বিভিন্ন অস্ত্র নির্মান প্রজেক্টে কাজ করবে। দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত সামরিক অনুশীলনও হবে।
** খাদ্য, শক্তি, সংযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, তথ্য প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তনে উভয়দেশ একসাথে কাজ করবে।
** উভয়দেশই নিজেদের মধ্যে বানিজ্যিক সম্পর্ক আরও মজবুত করবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উত্তর কোরিয়া গঠনের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন উত্তর কোরিয়াকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা করে আসছে। এমনকী উত্তর কোরিয়ার কাছে যে ৫০টি পরমানু অস্ত্র আছে সেই পরমানু প্রযুক্তিও রাশিয়া এবং চীনই দিয়েছে উত্তর কোরিয়াকে। ১৯৬১ সালে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে বন্ধুত্ব চুক্তি হয়েছিল, এই চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশই একে অপরকে বিভিন্ন খাতে সহায়তা করে। তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে এই চুক্তিও ভেঙে যায়। ১৯৯১ সালের পর থেকে রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কুটনৈতিক সম্পর্ক ততটা মজবুত ছিলনা। কিন্তু ২০২২ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার সাথে উত্তর কোরিয়ার কুটনৈতিক সম্পর্ক আবারও মজবুত হতে শুরু করে। উত্তর কোরিয়ার আশেপাশে দক্ষিন কোরিয়া, জাপানের মতোন শক্তিশালী দেশ রয়েছে, আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ার উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে। আমেরিকা এর আগে ভিয়েতনামে, ইরাক, আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে কিন্ত আমেরিকা উত্তর কোরিয়াতে কখনও সেনাবাহিনী পাঠায়নি। কারন উত্তর কোরিয়ার পেছনে রাশিয়া ও চীন রয়েছে। যার জন্য উত্তর কোরিয়া প্রায়ই আমেরিকাকে পরমানু হামলার হুমকী দেয়। উত্তর কোরিয়ার কাছে পরমানু মিসাইল থাকলেও তার সঠিক গাইডেন্স সিস্টেম নেই। রাশিয়া এবার উত্তর কোরিয়াকে গাইডেন্স সিস্টেমের মতোন সংবেদনশীল প্রযুক্তিও দেবে যার কারনে উত্তর কোরিয়ার মিসাইল সিস্টেম আরও শক্তিশালী হয়ে যাবে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার যেটা প্রধান সমস্যা হয় তাহল সেনাবাহিনীর ঘাটতি। রাশিয়ার সেনাসংখ্যা যথেষ্ট কম। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সাথে চুক্তির কারনে কিম জং উন ভবিষ্যতে কোরিয়ান সেনা রাশিয়ায় পাঠাতে পারে। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার এই চুক্তি সবচেয়ে বেশী চিন্তার কারন দক্ষিন কোরিয়া ও জাপানের জন্য। এই দুই দেশই এবার আমেরিকার সাথে আরও গভীর কুটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করবে। যার জন্য খুব শীঘ্রই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল পুনরায় উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।