দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত জাপান ২৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীর তৃতীয় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ কিভাবে হয়ে উঠল?
দিনটা ৬ আগস্ট, ১৯৪৫ সাল, মারিয়ানা দ্বীপ থেকে আমেরিকার বিমানবাহিনীর একটি বি ২৯ বোম্বার বিমান জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষের পর্যায়, জার্মানি, ইতালি আত্মসমর্পন করেছে শুধু অক্ষ শক্তির মধ্যে জাপানই রয়েছে যে তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। জাপানকে আত্মসমর্পন করাতে ও পার্ল হারবার বন্দর ধ্বংসের প্রতিশোধ নিতে আমেরিকা জাপানে পরমানু বোম্ব ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। যার কারনে মারিয়ানা দ্বীপ থেকে ৬ আগস্ট সকালে বি ২৯ বিমান পরমানু বোম্ব নিয়ে জাপানের হোনসু দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ৮:১৬ নাগাদ হোনসু দ্বীপের হিরোশিমা শহরের উপর এসে বি ২৯ বিমান পরমানু বোম্ব ফেলে। এই বোম্বের বিস্ফোরনে সাথে সাথে প্রায় সত্তর থেকে আশি হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আমেরিকা শুধু এখানেই থেমে থাকেনি, তিনদিন পর ৯ আগস্ট জাপানের নাগাসাকি শহরের উপর আরও একটি পরমানু বোম্ব ফেলে আমেরিকা, এখানেও সত্তর হাজারের বেশী মানুষের মৃত্যু হয়। আমেরিকার তৈরি লিটলবয় ও ফ্যাটম্যান নামে দুটি পরমানু বোম্বের বিস্ফোরনে জাপানে ঘটনাস্থলেই প্রায় দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। পরমানু বোম্বের তেজস্ক্রিয়তায় পরে আরও অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। আজও এই দুই শহরে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি দুটি শহর সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, জাপানের রাজধানী টোকিওর অবস্থাও খারাপ ছিল। মিত্রশক্তি জাপানের সমস্ত সাম্রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল। সেসময় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত, ভঙ্গুর অর্থনীতির এশিয়ার এই দেশটি একবিংশ শতাব্দীতে এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপানের শাসক হিরোহিটো সরকারি ভাবে আত্মসমর্পন করে এবং ২ সেপ্টেম্বর তিনি মিত্রশক্তির কাছে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করে। এরপরেই শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানের পরাজয়ের তার সাম্রাজ্য দখল করে নেয় মিত্রশক্তি। সেসময় জাপানের পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেয় আমেরিকা যার নেতৃত্বে ছিল জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থার। প্রথম তিন বছর আমেরিকার লক্ষ্য ছিল যাতে ভবিষ্যতে জাপান কখনও যুদ্ধ শুরু করতে না পারে কারন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরজয় থেকে আমেরিকা শিক্ষা নিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হওয়ার পরেও কুড়ি বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে জার্মানি। সেই একই ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেকারনে আমেরিকা জাপানে একটি গনতান্ত্রিক সংবিধান শুরু করে যাতে জাপানকে কোনও সেনাবাহিনী গঠনের অধিকার দেওয়া হয়নি। জাপানে সংসদ ভবন বা ডায়েটের প্রতিষ্ঠা করে আমেরিকা। জাপানের রাজা হিরোহিটোকে জপানের শাসক হিসাবে রাখা হয় কিন্তু তার কাছে কোনও ক্ষমতা ছিলনা। জপানের সমস্ত জাতীয়তাবাদী দলকে নিষিদ্ধ করা হয়, জাপানের সমস্ত সামরিক অস্ত্র তৈরির কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিডেকি তোজো সহ আরও ছয়জন যুদ্ধ অপরাধীকে ফাঁসি দেওয়া হয়, এছাড়াও ষোলো জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রথম তিনবছর আমেরিকা জাপানের প্রশাসনিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটায় কিন্তু এইসময় জাপানের অর্থনীতির উন্নয়নে তেমন কোনও পদক্ষেপই নেয়নি আমেরিকা। কিন্ত ১৯৪৮ সাল থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয়। এই সময় বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ন পরিবর্তন হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষে থাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করে যাতে আস্তে আস্তে গোটা বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়, ইতিহাসে এই ঘটনা শীতল যুদ্ধ নামে পরিচিত। আবার ১৯৪৯ সালে চীনে মাও জেদং এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসে।
কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের বিরুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে একটি শক্তিশালী বন্ধু দেশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এক্ষেত্রে জাপানের থেকে উপযুক্ত কেউ ছিলনা। আমেরিকা বুঝে যায় দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে কমিউনিজমকে প্রতিরোধ করতে পারে একমাত্র জাপানই। তাই আমেরিকা জাপানের আর্থিক বিকাশে মনোযোগ দেয়। আমেরিকার সাহায্যে ১৯৫৩ সালের মধ্যে জাপানের শিল্প কারখানা ১৯৩৭ সালের মতোন উৎপাদন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। জাপানের আর্থিক উন্নয়নের জন্য আমেরিকা প্রথমেই জাপানের ভূমিনীতির পরিবর্তন করে। জাপানে সেসময় অর্ধেকের বেশী কৃষিজমি ধনী ব্যক্তিদের হাতে ছিল যারা শহরে থাকতো। এসব ব্যক্তিরা গ্রামে কৃষকদের অল্প মূল্যে চাষ করিয়ে অধিক লভ্যাংশ ভোগ করতো। আমেরিকা এই নীতির পরিবর্তন করে ধনী ব্যক্তিদের থেকে অধিকাংশ জমি স্বল্প মূল্যে কৃষকদের বিক্রি করে যাতে জাপানে কৃষকদের একটি বড় সম্প্রদায় উপকৃত হয় এবং জাপানের আর্থিক উন্নয়ন হয়। এসময় জাপানের শিল্প কারখানা ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রন করা কিছু বিশেষ ব্যক্তি বা জাইবাতসুদের নিষিদ্ধ করে আমেরিকা যাতে জাপানি অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আসে। এই জাইবাতসুদের জাপানের রাজনীতিতেও প্রভাব ছিল যা আমেরিকার কারনে বন্ধ হয়। আমেরিকা জাপানের শিল্প কারখানা ও অর্থনীতিতে এমন ব্যবস্থা তৈরি করে যাতে কোনও একটি নির্দিষ্ট সংস্থার আধিপত্য বা মোনোপলি তৈরি না হয়। এছাড়া জাপানের আর্থিক বিকাশে আমেরিকা একাধিক পদক্ষেপ নেয়। যেমন জাপানি পন্যকে স্বল্প করে আমেরিকার বাজারে আনা হয়।
আমেরিকা জাপানকে ১.৯ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয় যার ৫৯ শতাংশ খাদ্যে, ১৫ শতাংশ শিল্পের কাঁচামাল, ১২ শতাংশ পরিবহনে খরচ করা হয়। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪ অবধি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিল সিগেরু ইওশিদা। তিনি আমেরিকার সাথে জাপানের কুটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিলেন। যার কারনে ১৯৪৮ সাল থেকেই একাধিক বিদেশী সংস্থার সাথে আন্তর্জাতিক স্তরে জপানের বানিজ্য বৃদ্ধি পায়। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল অবধি চলা কোরিয়ার যুদ্ধও জাপানের অর্থনীতিকে মজবুত করতে সাহায্য করেছিল। কোরিয়ার যুদ্ধের সময় জাতিসংঘের সেনাবাহিনী জাপানকে তার বেস হিসাবে ব্যবহার করে। এই সময় জাপানি সংস্থাগুলো তাদের পন্য জাতিসংঘকে বিক্রি করে যাতে জাপানের উৎপাদন খাতে গতি আসে। কোরিয়ার যুদ্ধের পর জাপান আন্তর্জাতিক বানিজ্যে বেশী জোর দেয়৷ জপানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরো আমেরিকার দায়িত্বে ছিল যার জন্য জাপান সেনাবাহিনী তৈরি ও সামরিক অস্ত্র তৈরির বদলে সেই অর্থ শিল্পোন্নয়নে ব্যবহার করে। জাপান তাদের যেকোনও পন্য উৎপাদনে গুনমানের উপর বেশী জোর দেয়। এইকারনে ১৯৬২ সালের পর থেকে ১৫ শতাংশ হারে জাপানের বানিজ্য বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২ সালের পর পশ্চিম জার্মানিকে ছাড়িয়ে জাপান বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হয়ে ওঠে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ মাত্র ২৫ বছরে বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনীতির দেশ হিসবে আত্মপ্রকাশ করে।
জাপানের তৈরি টিভি, রেডিও, সাইকেল, জাহাজ, স্টিলের জিনিস সহ একাধিক পন্য গুনমানের কারনে বিশ্ববাজারে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। জাপানের উন্নয়নের পেছনে রাজনৈতিক দল এলডিপি বা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির বড় ভূমিকা আছে। জাপানে ১৯৫২ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এলডিপি ক্ষমতায় ছিল, জাপানের কৃষক সংগঠনের পূর্ন সমর্থন ছিল এলডিপির উপর। এই এলডিপির কারনেই জাপানে কোনও বামপন্থী দল ক্ষমতায় আসতে পারেনি। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বিশেষ করে আমেরিকার সহযোগীতায় জাপানে প্রযুক্তিগত ভাবেও উন্নয়ন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অধিকাংশ কলকারখানা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় আমেরিকার সাহায্যে জাপানে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত শিল্প কারখানা তৈরি হয় যাতে উৎপাদন খাতে গতি আসে।
১৯৬৩ সাল থেকে জাপানের জিডিপি ৯ শতাংশ, উৎপাদন ১৩ শতাংশ, নির্মান বিভাগ ১১ শতাংশ এবং পরিকাঠামো বিভাগ ১২ শতাংশ হারে বাড়তে শুরু করে। খুব শীঘ্রই জাপান অটোমোবাইল, যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিকস, জাহাজ নির্মানে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর তালিকায় প্রবেশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সেনাবাহিনীর বড় অংশ কৃষিকাজ ও শিল্প কারখানায় যোগ দেয় যার কারনে জাপানে একটি শিক্ষিত, নিয়মনিষ্ঠ কাজের মানুষের শ্রেনী তৈরি হয় যারা জাপানের উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত পরিশ্রম করে।
১৯৮০ এর দশকে জাপানের অর্থনীতি ও বানিজ্য এতটাই মজবুত হয়ে যায় যে জাপান অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋন দিতে শুরু করে। যে জাপান ১৯৪৫ সালে নিজেই আমেরিকার থেকে সাহায্য নিয়ে চলছিলো সেই জাপান পরিশ্রমের জোরে মাত্র ৩৫ বছরে এতটাই উন্নত হয়ে যায় যে অন্য দেশকেও ঋন দেওয়া শুরু করে। এইসময় জাপানের মুদ্রাস্ফীতি ছিল মাত্র তিন শতাংশ এবং বেকারত্বের হার ছিল তিন শতাংশেরও কম। বানিজ্য, শিল্প, প্রযুক্তির পাশাপাশি কারিগরি ক্ষেত্রেও জাপান উন্নতি করেছিলো। জাপানের কারিগরি খাতে উন্নয়নের সবচেয়ে বড় নির্দেশন হল ৫৪ কিলোমিটার লম্বা একটি টানেল যা হোনসু দ্বীপকে হোকাইডু দ্বীপের সাথে সংযুক্ত করে, এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হতে ২১ বছর সময় লাগে। সেসময় এটি বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা টানেল ছিল। ১৯৬৪ সালে জাপানে টোকিও অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় যার কারনে আন্তজার্তিক স্তরে জাপানের গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মাত্র চার দশকে জাপানের এই অবিশ্বাস্য উত্থান ঠিক যেন ছাইয়ের ভিতর থেকে পুনর্জন্ম লাভ করা গ্রীক রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতোন। বর্তমানে ৪.২৩ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি যুক্ত জাপান বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। একটি জাতি সঠিক অনুশাসন ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে কতটা উন্নত হতে পারে তার সবচেয়ে বড় উদাহারন জাপান।