জানেনকী ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল তৎকালীন সময়ের বহু ভারতীয় ব্যবসায়ীদের!
দুইশো বছর ধরে ভারতবর্ষে শাসন করেছিল ব্রিটিশরা। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন, ভারতীয় শাসকদের মধ্যে লড়াই এবং শক্তিশালী ব্রিটিশ নৌবাহিনী ও ব্রিটিশ রননীতির কারনে ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়েছিল। তবে সম্প্রতি কিছু ঐতিহাসিকগন তৎকালীন ভারতের কিছু ব্যাবসায়ী ও ব্যাঙ্ককে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনার অন্যতম প্রধান কারন দাবী করেছে।
সময়টা তখন ১৬০০ সাল, ইংল্যান্ডের মহারানি এলিজাবেথের রাজকীয় আদেশ নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত মহাসাগরে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে রওনা হয়। সেসময় ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে নতুন দেশ আবিষ্কার ও উপনিবেশ বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। ইউরোপীয়ান দেশ গুলো শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য নিজেদের মধ্যেই অনেক সময় লড়াই করতো। ঠিক এই কারনেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ডাচ ও পর্তুগীজদের সাথে লড়াইয়ের পর ১৬০৮ সালের ২৪ আগস্ট ভারতের পশ্চিম উপকূলে সুরাটে এসে উপস্থিত হয়। বিদেশী ব্যবসায়ী হিসাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুরাট ও অন্ধ্রপ্রদেশের মৌসিলিপট্টনমে তাদের কারখানা তৈরি করে। ধীরে ধীরে প্রায় সমগ্র ভারতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারখানা ছড়িয়ে পড়ে। চেন্নাইয়ের সেন্ট জর্জ ফোর্ট, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম এবং বোম্বের বোম্বে ক্যাসেল ছিল ব্রিটিশদের অন্যতম প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমনের প্রায় দেড়শো বছর পর ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে সিরাজ উদ দৌলার পতনের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনে ভীত রচনা হয়। সিরাজ উদ দৌলা মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলা, বিহার, ওড়িশা নিয়ন্ত্রন করতো। সিরাজ উদ দৌলার দেওয়া বানিজ্যিক অনুমতির অপব্যবহার করছিলো ব্রিটিশরা উপরন্তু ফোর্ট উইলিয়ামকে সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করে ব্রিটিশরা। সেজন্য সিরাজ উদ দৌলা ব্রিটিশদের আক্রমন করে তাদের পরাজিত করে। ব্রিটিশরা অভিযোগ করে সিরাজ একটি ছোট অন্ধকার ঘরে অনেক ব্রিটিশদের হত্যা করেছে। ইতিহাসে এই ঘটনা অন্ধকূপ হত্যাকান্ড নামে পরিচিত। সেসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান ছিল রবার্ট ক্লাইভ। রবার্ট ক্লাইভ সিরাজের সেনাপতি মীরজাফরের মাধ্যমে পলাশির যুদ্ধে সিরাজ উদ দৌলাকে পরাজিত করে। পরবর্তীকালে মীরজাফর ও মীরকাশেমকে ব্রিটিশরা তাদের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে সিংহাসনে বসায়। কিন্তু মীরকাশেম পরবর্তীকালে বিদ্রোহ ঘোষনা করে। অয়োধের নবাব ও মুঘল সম্রাটের সাথে মীরকাশেম ১৭৬৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর আক্রমন করে যা ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত। কিন্ত বক্সারের যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জিতে যায় এবং বাংলা, বিহার ও ওড়িশার রাজস্ব আদায়ের অধিকার পেয়ে যায় ব্রিটিশরা। বক্সারের যুদ্ধের পর থেকেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার শুরু হয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা সমগ্র ভারতের শাসকে পরিনত হয়।
তবে পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয়ের জন্য বেশ কিছু ছোট ছোট কারন আছে। যেমন ঐতিহাসিকরা বলেছেন মুর্শিদাবাদের ব্যাঙ্কারদের জন্যই ব্রিটিশদের পলাশির যুদ্ধে জয় হয়েছিল। বলা হয় এসব ব্যাঙ্কাররা সিরাজ উদ দৌলার আর্থিক নীতির সাথে সহমত ছিলনা সেজন্য তারা ব্রিটিশদের সাথে যৌথভাবে সিরাজকে হারানোর পরিকল্পনা করে। এসব ব্যাঙ্কারদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল জগৎ শেঠ। মাত্র ২০ বছর বয়সে সিংহাসনে বসা সিরাজ উদ দৌলার অর্থনীতি সম্পর্কে তেমন কোনও জ্ঞান ছিলন। সে নিজের ইচ্ছেমতো শাসনকার্য করতো। সিরাজ উদ দৌলা জগৎ শেঠকেও হুমকী দিয়েছিল। জগৎ শেঠ সিরাজ উদ দৌলার বদলে ব্রিটিশদের প্রতি দুটি কারনে প্রভাবিত হয়েছিল।
প্রথমত ব্রিটিশরা মৌখিক চুক্তির বদলে নির্দিষ্ট লিখিত নিয়মে ব্যবসা করতো যা ব্যাঙ্কারদের নিরাপত্তা দিত। দ্বিতীয়তা ব্রিটিশরা তাদের অঞ্চল রক্ষা করাা ও প্রতিশোধ নিতে পারদর্শী ছিল অর্থাৎ শক্তিশালী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কারনে ব্যাঙ্কাররা নিরাপত্তা পেত। এসব কারনেই জগৎ শেঠ ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিল। এছাড়া ঐতিহাসিকরা আমিন চান্দ নামেও এক ব্যবসায়ীর কথা বলেছেন যে রবার্ট ক্লাইভ ও মীরজাফরের মধ্যে চুক্তি করতে সাহায্য করেছিল। এর বদলে আমিন চান্দ ৩০ লাখ টাকা পেয়েছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল জগৎ শেঠ কারন তিনিই সিরাজ উদ দৌলা, তারপর মীরজাফর এবং মীরকাশেমের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রন করতো। সেসময় জগৎ শেঠ নবাবদের এতটাই ঋন দিয়েছিল যে প্রতি চার টাকা রাজস্বের মধ্যে তিন টাকাই যেত জগৎ শেঠের কাছে। মীরজাফর সিরাজ উদ দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার আগে জগৎ শেঠই রবার্ট ক্লাইভ ও মীরজাফরের মধ্যে অন্তিম চুক্তি করিয়েছিল। মীরজাফর ব্রিটিশদের ১৬ কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু মীরজাফরের কাছে এতটাকা ছিলনা সেজন্য জগৎ শেঠই এই অর্থের ব্যবস্থা করে। জগৎ শেঠের প্রভাব মুঘল সভাতেও ছিল। জগৎ শেঠই মুঘল সম্রাট আলমগীর দ্বিতীয়কে ব্রিটিশদের জয় এবং মীরজাফরকে নতুন নবাব হিসাবে মেনে নিতে রাজি করায়।
জগৎ শেঠ পরবর্তীকালে মীর কাশেমের উপরেও ক্ষুব্ধ ছিল কারন মীর কাশেমের ফরাসী ভাড়াটে সেনা জগৎ শেঠের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছিল। এজন্য বক্সারের যুদ্ধে জগৎ শেঠ ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিল। বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলার শাসনে মুর্শিদাবাদের গুরুত্ব কমে যায় এবং কলকাতার উত্থান হয়। তবে ঐতিহাসিকরা আরও বলেছেন ১৭৫৭ সালে জগৎ শেঠের ইংরেজদের সমর্থনের আরও একটি বড় কারন ছিল পশ্চিম ভারতের বোম্বেতে ব্রিটিশদের নেতৃত্বে হওয়া ব্যবসা। বোম্বের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে প্রভাবিত হয়েছিল জগৎ শেঠ।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে বানিজ্যের অনুমতি দিয়ে দেয় যার কারনে ১৬১৩ সালে সুরাটে কারখানা তৈরি করে ব্রিটিশরা। অনেক ঐতিহাসিকগন দাবী করেন সতেরো শতকে সম্ভবত সুরাট ভারতের একমাত্র বড় শহর ছিল যেখানে হিন্দু ও জৈন ব্যাঙ্কাররা ও ব্যাবসায়ীরা প্রভাবশালী ছিল। সেসময় সুরাটের প্রসিদ্ধ ব্যাবসায়ী ছিল ভির্জি ভোরা। বাংলার জগৎ শেঠের মতোন ভির্জি ভোরাও ব্রিটিশদের আর্থিক সহয়তা করতো কারন মুঘল আর্থিক নীতি পচ্ছন্দ ছিলনা তার। ভির্জি ভোরা সুরাটে এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে তাকে জেলে বন্দী করায় ১৬৩৮ সালে সুরাটের গভর্নরকেই পদচ্যুত করেছিল মুঘল সম্রাট শাহজাহান।
১৬৬৯ সালে সুরাটের কাজী ধর্মীয় নীতি প্রচলন করে, এই নীতি অনুযায়ী অনেক অমুসলিম ব্যাবসায়ীদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। এইজন্য প্রায় ৮০০০ অমুসলিম ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার সুরাট ছেড়ে বোম্বে ও ভারুচ চলে যায়। যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই এসব ব্যবসায়ী ব্রিটিশদের সমর্থন করে। ভির্জি ভোরার মৃত্যুর পর সুরাটের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যাঙ্কার ছিল ভিমজি পারিখ। তিনি বোম্বেতে প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন। সুরাট থেকে বোম্বে চলে আসা অমুসলিম ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কারদের ব্রিটিশরা বিনামূল্যে জমি ও ব্যবসার অধিকার দেয়। এভাবেই শুরু হয় সুরাটের পতন ও বোম্বের উত্থান। এভাবেই সতরো শতকে মুর্শিদাবাদ ও সুরাটের গুরুত্ব কমে যায় এবং কলকাতা ও বোম্বের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এই ঘটনায় ব্রিটিশদের প্রতি প্রভাবিত হয়ে তাদের সমর্থন দেওয়া শুরু করে জগৎ শেঠ। রবার্ট ক্লাইভকে ঐতিহাসিকরা ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের রূপকার বললেও ভারতীয়দের সমর্থন ছাড়া ক্লাইভ এটা কোনওদিনও পারতোনা। এই ঘটনা প্রমান করে ব্যাঙ্কাররা ও ব্যবসায়ীরা চাইলে কোনও বড় সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটাতে সক্ষম।