অফবিট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি নিজেদের সেনাদের ভারী মেশিনগানের সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতো? কি এমন কারন ছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনীর কাছে এক বিশেষ মেশিনগান ছিল, এই মেশিনগানের সাথে জড়িত একটি কুখ্যাত ঘটনা রয়েছে যা সম্পর্কে আজও কথা হয়। তবে এই ঘটনা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে, কিছু মানুষ মনে করে এরকম ঘটনা কখনও হয়নি আবার অনেকেই মনে করে এরকম নৃশংস ঘটনা সত্যিই হয়েছে। আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে এমন অনেক ঘটনার কথাই শোনা যায় যার সত্যতা সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়েছিল তখন জার্মানি দুই দিকে যুদ্ধ করছিলো। পূর্বদিকে রাশিয়ার সাথে এবং পশ্চিম দিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে লড়াই চলছিলো জার্মানির। ১৯১৪ সালে জুলাই মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রথমদিকে জার্মান সেনাবাহিনী পূর্ব ফ্রান্সের দিকে ব্যাপক আক্রমন শুরু করেছিলো। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্সের সীমান্তে মার্নের কাছে ফ্রান্স জার্মান সেনাবাহিনীকে আটকে দেয়। মার্নের যুদ্ধে উভয় সেনাবাহিনীর মধ্যে চার বছর যুদ্ধ চলেছিল কিন্ত তবুও জার্মান সেনাবাহিনী ফ্রান্সের দিকে এগোতে পারেনি। জার্মানির লক্ষ্য ছিল ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস পৌঁছানো কিন্তু তা করতে পারেনি জার্মান সেনাবাহিনী। এই জন্য মার্নের যুদ্ধকে ফ্রান্সের বিজয় হিসাবে ধরা হয়। মার্নের যুদ্ধে মূলত ট্রেঞ্চ ওয়াররফেয়ার হয়েছিল। এই যুদ্ধে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সেনাবাহিনী এবং জার্মান সেনাবাহিনী উভয় উভয়ের বিরুদ্ধে কয়েকশো কিলোমিটার লম্বা ট্রেঞ্চ বা পরিখা খনন করে। পরিখাগুলো এতটাই গভীর ছিল যে একজন মানুষ নীচে দাঁড়ালেও তার কয়েক ইঞ্চি উপরে ভূমি ছিল। পূর্বদিকে সুইজারল্যান্ডের সীমানা পর্যন্ত উভয়পক্ষ প্রায় ৩০০ কিলোমিটার লম্বা পরিখা খনন করেছিল। এই পরিখার মধ্যেই দুইপক্ষের সেনাবাহিনী প্রায় চার বছর ধরে যুদ্ধ করে সমগ্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। একপক্ষ অন্যপক্ষের পরিখাতে আক্রমন করার জন্য অনেক সময় প্রচুর পরিমানে সেনা পাঠাতো কারন শত্রু গুলি করলেও একসঙ্গে এত সেনাকে মারা সম্ভব ছিলনা। এরকম আত্মঘাতী নীতিতে উভয়পক্ষেরই প্রচুর সেনা নিহত হয়েছিল।

১৯১৬ সালে ফ্রান্সের সোম নদীর তীরে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত পরিখাতে মুখোমুখি ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও জার্মান সেনাবাহিনী। একদিন ব্রিটিশ নেতৃত্ব ঠিক করে প্রচুর ব্রিটিশ সেনা একসাথে জার্মান পরিখাতে হামলা করবে। ইতিহাসে এই ঘটনা সোমের যুদ্ধ নামে পরিচিত। কিন্তু আগে থেকেই মেশিনগান নিয়ে প্রস্তত ছিল জার্মান সেনাবাহিনী। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এতটাই ক্ষয়ক্ষতি হয় যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ বলা হয় সোমের যুদ্ধকে। এই যুদ্ধে প্রথম দিনে ২০,০০০ ব্রিটিশ সেনার মৃত্যু হয়েছিল! অবশিষ্ট ব্রিটিশ সেনা যখন জার্মান পরিখাতে পৌঁছায় তারা দেখে পরিখাতে একজন জার্মান সেনা রয়েছে তার শরীরে চেন দিয়ে মেশিনগান আটকানো রয়েছে এবং সেনাটি মারা গেছে। সবাইভাবে নিজের দেশের জন্য হয়ত শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করবার জন্য হয়ত ওই জার্মান সেনা নিজেকে মেশিনগানের সাথে আটকে রেখেছিল। এই ঘটনা পুরো ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ব্রিটিশ শীর্ষ নেতৃত্ব এই ঘটনার সমালোচনা করে প্রচার করে জার্মান নেতৃত্ব এতটাই নির্দয়ী যে যুদ্ধের জন্য সেনাদের জোর করে মেশিনগানের সাথে বেঁধে দিয়েছে। তবে কোনটা সঠিক তা কোনওদিন কেউ বলতে পারনবে না কারন জার্মানি এই ঘটনা নিয়ে কোনওদিন কিছু বলেনি। সোমের যুদ্ধের একশো বছর পরেও ওই জার্মান সেনা ও মেশিনগান নিয়ে আলোচনা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে সত্যিই কী ওই জার্মান সেনা নিজের ইচ্ছেয় দেশের হয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিল! নাকী পরাজয় আসন্ন জেনে জার্মান নেতৃত্ব সেনার ইছের বিরুদ্ধে তাকে মেশিনগানের সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল যাতে সে পালাতে না পারে।!

সোয়ামের যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কি হয়েছিল তা কোনওদিনই জানা যাবেনা তবে মেশিনগানের সাথে কোনও সেনাকে শিকল দিয়ে বেঁধে না রাখার সাপেক্ষে বেশ কয়েকটি মতবাদ রয়েছে :—-

** প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত জার্মান মেশিনগান গুলো এতটাই ভারী ছিল যে এগুলো একস্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যেত তিনজন করে লোক লাগতো। এজন্য মেশিনগানের তিনদিকে শিকল থাকতো এটি বহনের জন্য। সেজন্য অনেকে দাবী করে গুলি যুদ্ধের সময় মেশিনগান অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয় ওই সেনা এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার সেজন্য মেশিনগানের শিকলের সাথে আটকেই ছিল সে।

** অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞগন দাবী করেন যদি সত্যিই জার্মান নেতৃত্ব মেচিনগানের শিকলের সাথে জার্মান সেনাদের বেঁধে রাখতো তাহলে এরকম ঘটনার আরও উদাহারন পাওয়া যেত কিন্তু আর এরকম কোনও ঘটনা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া যদি সত্যিই এমন হয়ে থাকতো তবে জার্মান সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ হত।

** বলা হয় যদি এরকম ঘটনা হয়েও থাকতো তাহলে কোনও সেনা যাকে মেশিনগানের সাথে আটকে রাখা হত সে যদি বুঝতে পারতো তার মৃত্যু আসন্ন তাহলে সে গুলি না চালিয়ে আত্মসমর্পন করতো। তাহলে অচিরে জার্মানিরই ক্ষতি হত।

আসলে যুদ্ধে উভয়পক্ষই প্রোপোগান্ডা বা অপপ্রচার চালায় বিপক্ষকে ঘিরে কারন এর ফলে দেশের সেনার ও জনগনের মোনোবল বৃদ্ধি পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা বর্তমানে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধেও অপপ্রচার চলে মিডিয়াতে। যেমন পশ্চিমা মিডিয়া গুলোকে দেখানো হচ্ছে রাশিয়া ক্রমশ হেরে যাচ্ছে, মানুষের সাথে খারাপ ব্যাবহার করছে। আবার রাশিয়ান মিডিয়াতে দেখানো হচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেনের অনেক অঞ্চলে জিতে গেছে এবং সেখানকার স্থানীয়দের সাথে রাশিয়ান সেনাবাহিনী ভালো ব্যবহার করছে। সুতরাং মিডিয়াতে অপপ্রচার যুদ্ধেরই একটি অঙ্গ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এরকম আরও একটি অপপ্রচারের ঘটনা রয়েছে। সেসময় একজন আমেরিকান জেনারেল ব্যালার্ড তার ডায়রিতে লিখেছিল সে তার দল যখন ইউরোপে গিয়েছিল যুদ্ধের জন্য তখন তাদের আগে থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল জার্মানির সমস্ত কিছুকে ঘৃনা করতে হবে কারন জার্মানরাও আমেরিকানদের ঘৃনা করে। কিন্তু যখন কিছু আমেরিকান সেনা ইউরোপে জার্মানির সেনাবহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বন্দী হয় তখন জার্মানরা তাদের সাথে রীতিমতো ভালো ব্যবহার করে যেটা তারা আশাও করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছিল যা শুনে মনে হবে এরকম ঘটনা কোনওদিন হয়নি। যেমন ১৯১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ক্রিস্টমাসের আগের দিন ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও জার্মান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা একটি সিদ্ধান্ত নেয় পরের দিন ক্রিস্টমাস সেজন্য কোনও লড়াই হবেনা৷ সেইদিন ও তার পরেরদিন তিন দেশের সেনারা পরিখার কাছেই একসাথে আনন্দ করে, ফুটবল ম্যাচ পর্যন্ত খেলা হয়। এই ঘটনা যখন তিনদেশের মিলিটারির শীর্ষ নেতৃত্ব জানতে পারে তখন তারা ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং এই ঘটনায় জড়িত থাকা সেনাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল যাতে ভবিষ্যতে কোনও সেনা তার বিপক্ষের সাথে বন্ধুত্ব না করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *