পা, জননাঙ্গ, হাত, স্তন ফুলে যায়। গোদ রোগ সম্পর্কে জানা আছে!
‘লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস’ বা ‘এলিফ্যান্টিয়াসিস’ বা গোদরোগ আফ্রিকা, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকা, ভারত, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। এই রোগের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হল শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যাওয়া। এছাড়াও আরও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের। কিন্তু কিভাবে ছড়ায় এই রোগটি? কোন কোন দেশের এই রোগের প্রভাব বেশি? কি কি লক্ষন থাকে এবং কিভাবে এই রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব?
গোদরোগ কী?
এই রোগটি হল একটি কৃমিসংক্রান্ত রোগ। কৃমি দেহের ভিতর প্রবেশ করার পর লসিকাগ্রন্থিতে গিয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে সেখানেই অবস্থান করে। লসিকাগ্রন্থি আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে। সেই জন্য এটি আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লসিকাগ্রন্থিতে এই কৃমিগুলো অবস্থান করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে যায় আমাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধক ব্যবস্থা।
যেভাবে ছড়ায়
এই রোগটি মূলত মশা একটি মানুষের থেকে অন্য মানুষের মধ্যে ছড়ায়। যখন একজন গোদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশা কামড়ায় সেই সময় ওই ব্যক্তির থেকে মশার শরীরে কিছু পরিমাণ আণুবীক্ষণিক কৃমি ঢুকে যায়। এই কৃমির বৈজ্ঞানিক নাম হল Wuchereria bancrofti। তখন এই আণুবীক্ষণিক কৃমিকে মাইক্রোফাইলেরি বলা হয়।
মশার দেহে কৃমিগুলো প্রবেশ করার পর ধীরে ধীরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এরপর যখন ওই আক্রান্ত মশা কোনো সুস্থ মানুষকে কামড়ায় তখন ওই সুস্থ মানুষের শরীরের মধ্যে জীবাণু প্রবেশ করে। পরবর্তীতে এই জীবাণু রক্তস্রোতের মাধ্যমে লসিকাগ্রন্থিতে অবস্থান নেয়। এই জীবাণু প্রাপ্তবয়স্ক হতে ৬ মাস বা তারও বেশি সময় নিতে পারে। এরপর ওই প্রাপ্তবয়স্ক জীবাণু যৌন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বংশবিস্তার করে প্রচুর পরিমাণে আণুবীক্ষণিক জীবাণু রক্তে তৈরি করতে থাকে। এই রোগটি মূলত এশিয়ায় Aedes এবং Mansonia প্রজাতির মশা এবং বাংলাদেশে কিউলেক্স প্রজাতির স্ত্রী মশারা ছড়ায়।
লক্ষণসমূহ
অনেক রোগীর মধ্যে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এই রোগের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যাওয়া, যেমন- পা, জননাঙ্গ, হাত, স্তন ইত্যাদি।
তবে সবচেয়ে বেশি পায়ে ঘটে থাকে। ফুলে যাওয়া ও বড় হয়ে যাওয়ার ফলে আক্রান্ত স্থানে প্রচন্ড ব্যথা হতে থাকে, এমনকি নড়াচড়া করানো যায় না। পুরুষদের ক্ষেত্রে অন্ডকোষ ফুলে যেতে পারে। একে বলা হয় হাইড্রোসেলি। আবার লসিকাগ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। একে বলা হয় লিম্ফোএডেমা।
এছাড়া কি কি লক্ষণ ত্বকে দেখা দিতে পারে?
- শুষ্ক হয়ে যেতে পারে ত্বক ,
- ত্বক পুরু হয়ে যেতে পারে ,
- ত্বকে ঘা হতে পারে,
- ত্বক কালচে আকার ধারণ করা ইত্যাদি।
অনেকের আবার জ্বরও হতে পারে। এই রোগে যেকোনো বয়সের মানুষই আক্রান্ত হতে পারেন। দীর্ঘদিন সুপ্তাবস্থায় গোদরোগের জীবাণু থাকতে পারে। ৫-৭ বছর পর্যন্ত একটি প্রাপ্তবয়স্ক জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে। ছোটবেলায় যদি এই রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় লক্ষণ হিসেবে হাত কিংবা পা ফুলে যেতে পারে। তবে যদি এই রোগের চিকিৎসা না করানো হয় তাহলে বড় হলে আক্রান্ত হাত কিংবা পা পুরোপুরি অকেজো হয়ে যেতে পারে।
আক্রান্ত জায়গার তীব্রতার ধরন অনুযায়ী ৩টি ভাগে ভাগ করা যায় এই রোগটিকে –
- অ্যাকিউট অ্যাটাক,
- লিম্ফোএডেমা, এবং
- হাইড্রোসেলি।
গোদরোগ যেহেতু শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আক্রান্ত করে তাই সেক্ষেত্রে গোদরোগে আক্রান্ত হওয়ার মানুষটি অন্য কোনো রোগও ধরা পড়তে পারে। একে বলা হয় সেকেন্ডারি ইনফেকশন। এইরকমই একটি রোগের নাম হল ট্রপিক্যাল পালমোনারি ইওসিনোফিলিয়া সিনড্রোম।
শরীরের বিশেষ শ্বেত রক্তকণিকা কোনো কারণে ইওসিনোফিল শরীরে বেড়ে গেলে তাকে ইওসিনোফিলিস বলা হয়। যার ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যেমন – রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা, কফ, বুকে ব্যথা করা, রক্তে ইওসিনোফিলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শরীরের তরল জাতীয় পদার্থের সাথে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
রোগ নির্ণয়
নিচের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ নির্ণয় করা যায়-
- রক্ত পরীক্ষা করা,
- লিম্ফ নোড পরীক্ষা করা,
- এক্স-রে, এবং
- আলট্রাসাউন্ড।
রিস্ক ফ্যাক্টর
গোটা বিশ্বে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি এবং গোদ রোগের আক্রান্ত মানুষ প্রায় ৭২টি দেশে পাওয়া গেছে। যেসমস্ত জায়গায় গোদ রোগের রোগী সবথেকে বেশি পাওয়া যায়। সেগুলি হল –
- আফ্রিকা,
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া,
- ভারত,
- ল্যাটিন আমেরিকা, এবং
- ক্যারিবিয়ান।
সাধারণ রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি মধ্যে অন্যতম হলো-
- দীর্ঘ সময় ধরে ট্রপিক্যাল বা সাব-ট্রপিক্যাল এলাকায় বসবাস করার ফলে।
- মশা দ্বারা আক্রান্ত হলে।
- এছাড়াও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার ফলে
যেভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে
আপনি যদি এমন কোনো এলাকায় বসবাস করেন অথবা ভ্রমণ করতে যান যেখানে গোদ রোগের প্রাদুর্ভাব আছে তাহলে অবশ্যই আপনাদের নিচের এই বিষয়গুলো মেনে চলা উচিৎ।
- মশারির মধ্যে ঘুমানো।
- ফুলহাতা কাপড় পরা।
- ট্রাউজার পরিধান করা।
- সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত শরীরের যেসমস্ত স্থানে খোলা থাকে সেখানে মশারোধী ওষুধ ব্যবহার।
- বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখা।
- বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
- খাল-ডোবা-ড্রেন পরিষ্কার রাখা।
- এছাড়াও নিয়মিত মশা মারার ওষুধ দেওয়া।
চিকিৎসা
রোগ ধরা পড়লে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। এছাড়া সাধারণ কিছু নিয়মকানুন আছে যেগুলো মেনে চলা জরুরি। যেমন-
সবার প্রথমে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন এবং সেই পরামর্শ অনুযায়ী চলা উচিৎ। এছাড়াও আরো কিছু নিয়ম আছে যেগুলো মেনে চলা উচিত। এগুলি হল –
- সাবান জল দিয়ে যত্নসহকারে ফোলা স্থান ধুয়ে ফেলা এবং শুকনো রাখা।
- দিনে ও রাতে ফুলে যাওয়া হাত অথবা পা উঠাতে হবে যেন জমে যাওয়া তরল চলাচল করতে পারে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম করতে হবে। এর ফলে শরীরে তরল চলাচল বৃদ্ধি পায় এবং লসিকাগ্রন্থির উন্নতি ঘটতে পারে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে, ক্ষতস্থান অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বা অ্যান্টি-ফাংগাল ক্রিম দিয়ে পরিচর্যা করা।
- এছাড়াও পায়ে আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য পরিমিত সাইজের জুতা পরিধান করা।
তবে গুরুতর ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় আক্রান্ত স্থানে রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারি করার প্রয়োজন হয়, আবার আক্রান্ত লসিকাগ্রন্থিকে তুলে ফেলার জন্যও শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।