১৭৬০ সালেই ভারতবর্ষ স্বাধীন হত! তাহলে?
আঠারো শতকের প্রথমদিকে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনটি প্রধান শক্তির উদ্ভব ঘটে মারাঠা, মুঘল ও ব্রিটিশ। মারাঠারা এই সময় ভারতে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করছিল, অন্যদিকে মুঘলরা তাদের সাম্রাজ্য রক্ষা করার চেষ্টা করছিল এবং ইংরেজরা ভারতে তাদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছিল। অর্থাৎ ভারতীয় রাজনীতিতে এক ত্রিশঙ্কু অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বিজয় হয় একমাত্র মারাঠাদের। এই সময় সর্বশ্রেষ্ঠ মারাঠা পেশোয়া হিসাবে উত্থান হয় প্রথম বাজিরাও এর। মাত্র উনিশ বছর বয়সে পেশোয়া পদের দায়িত্ব পাবার পর প্রথম বাজিরাও একের পর যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। হায়দ্রাবাদের নিজাম যে মুঘলদের থেকে আলাদা ভাবে নিজের একটি সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল সেই নিজামকেও পরাস্ত করেছিল প্রথম বাজিরাও।
মুঘলদের পরাস্ত করে। প্রথম বাজিরাও তার জীবনে সব যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। প্রথম বাজিরাও এর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দুটি যুদ্ধের একটি ছিল পালখিডের যুদ্ধ যেখানে হায়াদ্রাবাদের নিজামকে পরাস্ত করেন তিনি।
মারাঠা সাম্রাজ্যে দুটি প্রধান পদ ছিল একটি হচ্ছে ছত্রপতি মানে যে মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রধান এবং দ্বিতীয় হচ্ছে পেশোয়া। ১৬৭৪ সালে পেশোয়া পদ তৈরি করা হয়। ছত্রপতি উপাধি শুরু করেন শিবাজি মহারাজ। ছত্রপতি পদের পরে মরাঠা সাম্রাজ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী পদ ছিল পেশোয়া। মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিল এই পেশোয়ারা। মারাঠাদের সবচেয়ে শক্তিশালী পেশোয়া ছিল এই প্রথম বাজিরাও যার শাসনকাল ছিল ১৭২০ থেকে ১৭৪০ পর্যন্ত।
১৭২০ সাল থেকে পঞ্চম মারাঠা ছত্রপতি শাহু মহারাজের পেশোয়া ছিলেন তিনি। তিনি জানতেন মুঘলরা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং মুঘল সাম্রাজ্যকে আক্রমন করার সেটাই সঠিক সময় এবং তিনি তাই করেন। বলিউডে বিখ্যাত বাজিরাও মস্তানি সিনেমা এই পেশোয়া প্রথম বাজিরাও এর জীবনের উপরই তৈরি করা হয়েছে। যেখানে রনবীর সিং প্রথম বাজিরাও এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রথম বাজিরাও তাঁর জীবনে ৪১ টি যুদ্ধ করেছিলেন যার প্রত্যেকটিতে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। ওনার বাবা বালাজী বিশ্বনাথও মারাঠা পেশোয়া ছিলেন। বাজিরাও প্রথম বাজিরাও বল্লাল নামেও খ্যাত।
১৭২০ সালে তাঁর বাবা বালাজী বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর ছত্রপতি শাহু মহারাজ তাঁকে পেশোয়া নিযুক্ত করেন। এদিকে সেইসময় মুঘল সাম্রাজ্যেও শাসনভার নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। ১৭০৭ সালে ঔরাঙ্গজেবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার নিয়ে তাঁর ছেলেদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়, শেষপর্যন্ত জয়ী হয় বাহাদুর শাহ ওয়ান। মাত্র পাঁচ বছর রাজত্ব করার পরই তার মৃত্যু হয়। এরই মধ্যে ১৭০১ সাল থেকে মুঘল সাম্রাজ্যে সইদ ভাইদ্বয়ের প্রভাব শুরু হয়। মুঘল সম্রাট যেই হোক না কেন প্রভাব থাকে সইদ ভাইদের।
১৭১২ সালে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তার ছেলে জাহান্দর শাহ শাসক হয় কিন্তু সাইদ ভাইরা তাকেও হত্যা করে। এরপর নতুন শাসক হয় জাহান্দর সাহের ভাইপো ফারুখ শিয়ার ১৭১৩ সালে। ১৭১৩ থেকে ১৭১৯ এই ছয় বছরের রাজত্বে ফারুখ শিয়ার নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ পর্যায় অতিক্রম করে ফেলেছিল। এই সময় পাঞ্জাবে মুঘলদের পরাস্ত করেছিল শিখরা। এই শিখেদের নেতা ছিল বান্দা সিং বাহাদুর। ছাপ্পাড় ছিড়ির যুদ্ধে বান্দা বাহাদুর সিং মুঘল সেনাকে পরাস্ত করে। বাদা বাহাদুর সিং দশটি যুদ্ধে জয়লাভ করে। এরপর ফারুখ শিয়ার বিশাল সেনা গঠন করে যুদ্ধ শুরু করে। বান্দা বাহাদুর সিংকে বন্দি করা হয় এবং আরও ৭৮০ শিখকে দিল্লি নিয়ে আসা হয়। সাতদিন ধরে প্রতিদিন গড়ে একশোর বেশী শিখ যোদ্ধাকে জনসমক্ষে হত্যা করা হয়। বান্দা বাহাদুর সিং এর চার বছরের ছেলে অজয় সিংকে হত্যা করে তার হৃদপিন্ড কেটে বার করে দেওয়া হয়। বান্দা বাহাদুর সিংকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়, তার চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছিল, গায়ের চামড়া তুলে নিয়ে হয়েছিল। ফারুখ শিয়ারকে ১৭১৯ সালে অন্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। এর পেছনেও ছিল সইদ ভাইরা। এরপর মুঘল সম্রাট হয় সতেরো বছর বয়সী মহম্মদ শাহ যে ১৭৪৮ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট ছিল। এই সময় মারাঠাদের ক্ষমতা দেখে বাধ্য হয়ে মুঘলরা মারঠাদের চৌথ এবং সরদেশমুখী নামক দুটি করের দাবি মেনে নেয়। মারাঠাদের দুটি প্রধান কর চৌথ যেখানে ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে এবং সরদেশমুখী মানে রাজাকে ১০ শতাংশ কর দিতে হবে উপহার হিসাবে অর্থাৎ মোট ৩৫ শতাংশ কর। মুঘলরা ডেকানের ছয়টি প্রদেশে খান্দেশ, বেরার, ঔরাঙ্গাবাদ, বিদার, বিজাপুর এবং হায়দ্রাবাদে মারাঠাদের কর আদায় করতে দিতে বাধ্য হয়। এই সময় ডেকান প্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয় আসাফ জাহকে। এই আসাফ জাহ মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহকে সইদ ভাইদেরকে সরাতে সাহায্য করেছিল সেজন্য পুরস্কার স্বরূপ ডেকানের দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়। কিন্তু ডেকানের দায়িত্ব পেয়েই সে সেখানে নিজেকে নিজাম হিসাবে ঘোষনা করে রাজত্ব শুরু করে এবং মারাঠাদের কর দিতে অসম্মতি জানায়। মহম্মদ শাহের সাথে সেসময় মারাঠাদের ভালো সম্পর্ক ছিল।বাজিরাও প্রথম যখন মহম্মদ শাহকে আসাফ জাহের ব্যাপারে জানায় তখন মহম্মদ শাহ আসাফ জাহকে কর দেবার আদেশ দেয়। কিন্তু আসাফ জাহ মুঘল সাম্রাজ্যের বিরোধীতা করে হায়দ্রাবাদের স্বাধীন শাসক হিসাবে নিজেকে দাবি করে আসফ জাহি রাজবংশের সূচনা করে। এদিকে সেসময় মারাঠা সাম্রাজ্যেের ছত্রপতি ছিল শাহু মহারাজ কিন্তু তার সাথে বিরোধীতা ছিল কোলহাপুরের শাম্ভাজির। এই সুযোগে নিজাম শাম্ভাজির সাথে জোট করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পরে শাম্ভাজি জানায় সে বাজিরাও প্রথমের বিরুদ্ধে যাবেনা। এরপর বাজিরাও প্রথম ও নিজামের মধ্যে যুদ্ধ শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র ছিল। বাজিরাও প্রথম ১৭২৭ সালের মে মাসে দক্ষিনে কর্নাটকে থাকা সমস্ত মারাঠা সেনাকে একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য এবং ছত্রপতি শাহু মহারাজকে অনুরোধ করেন নিজাম আসাফ জাহর সাথে সমস্ত ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে। এরপর তার সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করে। এখানে বাজিরাও প্রথমের রননীতি অসাধারন ছিল। নিজামের সেনা বাজিরাও প্রথম এর সেনার অপেক্ষা করছিল কিন্তু মারাঠা সেনা উত্তর খান্দেশ হয়ে পশ্চিমে গুজরাট অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। নিজামের সেনা বাজিরাও সেনাবাহিনীর পীছু নিতে পারেনি। কারন নিজামের সেনার গতি কম ছিল। নিজাম যেখানে যুদ্ধ করতে যেত সেখানে তার সাথে খাবার, জল সহ সমস্ত ব্যাবস্থা নিয়ে যেত, এতে বিশাল বড় জনবহর হত যার কারনে সেনার গতি কমে যেত। অন্যদিকে মারাঠা সেনা এত কিছু আনত না সাথে, তারা শত্রুর ঘাঁটিতে ঝটিকা আক্রমন করে যা পেত নিয়ে যেত যার কারনে মারাঠা সেনার গতি বেশী ছিল।
বাজিরাও প্রথম তাঁর পুরো মারাঠা সেনা ডেকানে প্রবেশ করে বুরহানপুর, খান্দেশ সহ এলাকা জয় করতে শুরু করে। অন্যদিকে নিজাম ছত্রপতি শাহু মহারাজের এলাকা উদয়পুর, আভাসারি, পাবাল, খেদ এবং নারায়নগড় দখল করে পুনে দখল করে নেয়। এরপর নিজাম সুপা, পাতাস এবং বারামতি দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বারামতিতেই নিজাম খবর পায় মারাঠা সেনা ঔরাঙ্গাবাদ অভিমুখে যাচ্ছে। নিজাম ও সাথে সাথে ঔরাঙ্গাবাদ যেতে শুরু করে। এদিকে কোলহাপুরের রাজা শাম্ভাজী দ্বিতীয় বাজিরাও প্রথমের বিরুদ্ধে নিজামকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। ১৭২৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী ঔরাঙ্গাবাদের কাছে একটি ছোট গ্রাম পালখিডে নিজামের সেনাকে পুরো ঘিরে ফেলে মারাঠা সেনা এনং যুদ্ধে পরাজিত হয় নিজাম।
১৭২৮ সালের ৬ মার্চ মুঙ্গি পাইঠান নামক গ্রামে নিজাম মারাঠাদের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। চুক্তি অনুযায়ী মারাঠাদের কর দিতে বাধ্য হয় নিজাম, ছত্রপতি শাহু মহারাজকে মারাঠা সম্রাট হিসাবে মেনে নেয় নিজাম। এভাবে ডেকানে মারাঠা প্রভাব শুরু হয়। তবে বাজিরাও প্রথম এখানেই থেমে থাকেননি তিনি ১৭৩৫ সালে মুঘলদের উপর আক্রমন করে তাদের পরাজিত করেন। এরপর তিনি পর্তুগালিদেরও আক্রমন করেন। ২৮ এপ্রিল, ১৭৪০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। বাজিরাও প্রথম বেঁচে থাকলে হয়তো ১৭৬০ সালের দিকে ভারতকেও স্বাধীন করে দিতেন বলে মনে করেন একদল বিশেষজ্ঞ।