আজকের উন্নত টিউবলাইট কিভাবে তৈরি হয়? কে তৈরি করেছিলেন?
সেই পুরনো দিনের ইতিহাসে যদি ফিরে যাওয়া হয় তাহলে মনে পড়বে যে আদিমকালে মানুষের রাতের অন্ধকার কাটানোর জন্য আগুনের ব্যবহার করত। তবে আদিমকালের কথা নয় কয়েকশো বছর আগের কথাই যখন বিদ্যুতের সরবরাহ সেভাবে ছিল না, ওই সময় সূর্যাস্তের পর অন্ধকার দূর করার জন্য মানুষের কাছে ছিল বাতি। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে মানুষেরা তাদের ঘরে জ্বালিয়ে দিত বাতি গুলি। কিন্তু এই চিত্র এখন অতীত। বর্তমানে বৈজ্ঞানিকদের অভিনব আবিষ্কার আমাদের জীবনকে সহজতর করে দিয়েছে। আর এই আধুনিক জীবনে প্রযুক্তির অসংখ্য অবদানের মধ্যে বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কার হল অন্যতম।
আমাদের বাড়ি থেকে শুরু করে চারপাশে প্রায় সমস্ত জায়গায় যে টিউবলাইট বা এনার্জি লাইট ব্যবহার করে থাকি আসলে সেটি হচ্ছে ফ্লোরোসেন্ট লাইট। এই লাইটগুলি অনেক উন্নত আর সাশ্রয়ী হলুদ বাল্ব (ইনক্যান্ডেসেন্ট লাইট) এর থেকে। ১৯০১ সালে পিটার কুপার পারদ বাষ্প ল্যাম্প উদ্ভাবন করেছিলেন। সময় পরিবর্তের সাথে সাথে পিটার কুপারে উদ্ভাবন করা পারদ বাষ্প ল্যাম্প বর্তমান উন্নত হয়ে পরিণত হয়েছে ফ্লোরোসেন্ট লাইটে। প্রশ্ন হল যে ফ্লরোসেন্ট লাইট কি ?
তবে এই প্রশ্নের উত্তর জানার পূর্বে আমরা কিভাবে আলোর সাহায্য দেখি। তার সাথে ফ্লোরোসেন্স প্রক্রিয়ার সম্পর্কে জানতে হবে। এর মাধ্যমে আলো নিঃসৃত হয় টিউবলাইট থেকে।
ইতিহাস
ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী আলেকজান্দ্রে বেকরেল ১৮৫৭ সালে ফ্লোরোসেন্স এবং ফসফরেসেন্স প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ওই সময় তিনি হঠাৎ একদিন কাজের সময় তার মাথায় আসে ফ্লোরোসেন্ট টিউব তৈরির করা কথা। বৈদ্যুতিক টিউবের মধ্যে লুমিনিসেন্ট উপকরণ নিয়ে তিনি পরীক্ষা করেছিলেন। পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উন্নত করা হয়েছিল ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্পকে।
১৯০১ সালে পিটার কুপার হেউইট যিনি ছিলেন আমেরিকার প্রকৌশলী তিনি প্রথম পারদীয় বাষ্প ল্যাম্পটি পেটেন্ট করেছিলেন। পিটার কুপারের নির্মিত পারদ ল্যাম্পটিকে বর্তমানদিনের আধুনিক ফ্লোরোসেন্ট লাইটের প্রথম প্রোটোটাইপ বলা হয়। এক প্রকার বৈদ্যুতিক ল্যাম্প হচ্ছে এই ফ্লোরোসেন্ট লাইট যা পারদীয় বাষ্পকে উত্তেজিত করে আলো বিকিরণ করে।
স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের মত অনুসারে, কুপারের ল্যাম্পটি জার্মান পদার্থবিদ জুলিয়াস প্লাকার এবং গ্লাসব্লোয়ার হেইনরিকের কাজ থেকে নির্মিত। জার্মান পদার্থবিদ জুলিয়াস প্লাকার এবং গ্লাসব্লোয়ার হেইনরিক খুব অল্প পরিমাণ গ্যাসযুক্ত কাচের টিউবের মধ্যে বৈদ্যুতিক প্রবাহ দিয়ে আলো বিকিরণ করতে সক্ষম হয়।
১৮৯০ দশকের শেষভাগে কুপার পারদপূর্ণ গ্যাস টিউব নিয়ে কাজ করতে থাকেন এবং সেই সময় দেখেন প্রচু্র নীল-সবুজ আলো উৎপন্ন হচ্ছে। কুপার ভেবেছিলেন যে নীল-সবুজ আলোযুক্ত বাতি মানুষের তাদের বাড়িতে জ্বালাবে না। সেই জন্যে তিনি এই টিউবটি কীভাবে ফটোগ্রাফিক স্টুডিও এবং অন্যান্য শিল্পে ব্যবহার করা যায় সেটা সন্ধান করতে থাকেন। এরপর তিনি জর্জ ওয়েস্টিং হাউসের সাথে একত্রে গঠন করে কুপার হেউইট ইলেক্ট্রিক কোম্পানি, যা গঠন করার পিছনে কারন ছিল প্রথম বাণিজ্যিক পারদ ল্যাম্প উৎপাদন করা।
মার্টি গুডম্যান তার হিস্ট্রি অফ ইলেকট্রিক লাইটিং-এ ১৯০১ সালে কুপার ধাতব বাষ্প ব্যবহার করে প্রথম বাতি আবিষ্কার করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। কুপারের নির্মিত এই বাতি ছিল একটি নিম্নচাপের পারদ বাতি।
১৯৩৪ সালে, একটি উচ্চচাপীয় ল্যাম্প তৈরি করেন এডমন্ড জার্মার। এই ল্যাম্পটি একটি ছোট জায়গায় আরও অনেক বেশি শক্তি পরিচালনা করতে পারে। কুপারের নির্মিত নিম্নচাপের পারদ বাতিটি উৎপন্ন করত প্রচুর পরিমাণে অতিবেগুনী আলো। কিন্তু জার্মার এবং অন্যান্যরা একটি ফ্লরোসেন্ট আবরণ আলোর বাল্বের অভ্যন্তরে দেয় যা অতিবেগুনী আলোকে শোষণ করে এবং ওই শক্তিকে দৃশ্যমান আলো হিসেবে আবার বিকিরণ করে। এভাবে, এটি একটি দক্ষ আলোর উৎস হয়ে ওঠে।
ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্প এবং পারদ বাষ্প ল্যাম্প এর থেকে এডমন্ড জার্মারের উচ্চচাপীয় বাষ্প ল্যাম্পটি কম তাপে আরো বেশি আলো দিতে সক্ষম হয়। জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন এডমন্ড জার্মার এবং আলোক প্রযুক্তি বিষয়ে ডক্টরেট অর্জন করেছিলেন । ১৯২৭ সালে এডমন্ড জার্মার ফ্রিডরিক মেয়ার এবং হান্স স্প্যানারের সাথে একটি পরীক্ষামূলক ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্পের পেটেন্ট করেছিলেন।
কিছু ইতিহাসবিদ প্রথম ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্পের উদ্ভাবক হিসেবে কৃতিত্ব দিয়েছিলেন এডমন্ড জার্মারকে। তবে যাইহোক না কেন, জার্মারের পূর্বে এক দীর্ঘ ইতিহাস প্রচলিত ছিল ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্প আবিষ্কারের বিষয়ে।
জর্জ ইনম্যান জেনারেল ইলেক্ট্রিক কোম্পানির বিজ্ঞানীদের একটি দল তৈরি করেছিলেন উন্নত এবং ব্যবহারযোগ্য ফ্লরোসেন্ট বাতি নিয়ে গবেষণা করার জন্য। এই দলটিকে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার চাপ সহ্য করতে হয়েছিল। সেই সমস্ত চাপ অতিক্রম করে প্রথম ব্যবহারিক এবং টেকসই ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্প ডিজাইন করেছিল এই দলটি এবং এই ল্যাম্প প্রথম ১৯৩৮ সালে বিক্রি হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে এডমন্ড জার্মারের আগের পেটেন্টির অধিকার জেনারেল ইলেকট্রিক কিনে নিয়েছিল।
জি.ই (জেনারেল ইলেকট্রিক) ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্প পাইওনিয়ার্সের মত অনুসারে, ১৯৪১ সালে ১৪ ই অক্টোবর মার্কিন পেটেন্ট নং ২,২৫৯,০৪০ জারি করা হয়েছিল জর্জ ইনম্যানকে। সাধারণত এটিকে ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্পের ফাউন্ডেশন পেটেন্ট হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
ওই একই সময় এবং এই বিষয়ে জি.ই-র সাথে কিছু সংস্থা কাজ করছিল এবং ইতিমধ্যে কিছু ব্যক্তি পেটেন্টের জন্য আবেদনও করে ফেলে। যখন ইনমানের পূর্বে জি.ই একটি জার্মান পেটেন্ট কিনেছিল, ওই সময় তাদের অবস্থান আরও শক্ত হয়। জি.ই ফ্রিডরিক মেয়ার, হান্স জে. স্প্যানার এবং এডমন্ড জার্মারকে জারি করা মার্কিন পেটেন্টের জন্য ১,৮০,০০০ ডলার দিয়েছিল তাদেরকে। তবে ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্পের আসল উদ্ভাবক কে এই নিয়ে অনেকেই তর্ক করতে পারে, কিন্তু এটি স্পষ্ট যে প্রথম জি.ই এটিকে বাজারে নিয়ে এসেছিল।
ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্পের পেটেন্ট টমাস এডিসন সহ আরো বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী করেছিলেন। এডিসন ৯ই মে ১৮৯৬ সালে একটি পেটেন্ট এমন ফ্লোরোসেন্ট ল্যাম্পের জন্য আবেদন করেন যা কখনো বিক্রি হয়নি। তিনি পারদীয় বাষ্প ব্যবহার না করে এক্স-রে ব্যবহার করেছিলেন ফসফরকে উত্তেজিত করার জন্য।
বর্তমান দিনে অনেক উন্নত প্রযুক্তির টিউবলাইট বাজারে এসেছে। আর এই উন্নত প্রযুক্তির টিউবলাইটের মধ্যে অন্যতম হল স্মার্ট এল.ই.ডি টিউবলাইট। এ ধরনের লাইটে রয়েছে একাধিক অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় যেমন ধরনের লাইটে ভয়েস কন্ট্রোল, ফিংগারপ্রিন্ট সেন্সরের সাথে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং ইত্যাদি। এর ফলে এখন লাইটকে মুখের সাহায্যে কিংবা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে।
টিউবলাইট দেখতে একটি সাধারণ কাচের টিউব হলেও এটি তৈরি করতে লেগেছে গবেষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, সাধনা এবং প্রচেষ্টা।