টাইটানিকের সঙ্গীত ও কি অপয়া!
১৩ জানুয়ারি, ২০১২, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিলাসবহুল জাহাজ কোস্টা কনকরডিয়া সাতদিনের ইউরোপ সফরে যাত্রা শুরু করে। ইতালিয়ান কোস্টা কনকরডিয়া ক্রুজ বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজের থেকেও আয়তনে বড় ছিল যার কারনে এর যাত্রী সংখ্যাও টাইটানিকের থেকেও অনেক বেশী ছিল। বিলাসবহুল ক্রুজ হওয়ার কারনে এই জাহাজে প্রোমোদ ভ্রমনের সমস্ত আধুনিক উপকরন ছিল। ১৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭:১৫ নাগাদ রোমের সিভিটাভেক্কিয়া বন্দর থেকে জাহাজটি তার প্রথম গন্তব্য ইতালির সাভোনা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যাত্রা শুরু করার মাত্র আড়াই ঘন্টার মধ্যে অর্থাৎ রাত ৯:৪৫ নাগাদ জাহাজে থাকা যাত্রীরা একটি বিশাল শব্দে কেঁপে ওঠে, জাহাজের সমস্ত লাইট হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। ৯:৪৫ নাগাদ অনেক যাত্রীই শুয়ে পড়েছিলেন আবার কেউ কেউ রাতের খাওয়ার খাচ্ছিলেন, হঠাৎই বড় ধাক্কায় সবাই ভীত হয়ে পড়ে। জাহাজের ক্যাপ্টেন ঘোষনা করে জাহাজে যান্ত্রিক গোলোযোগ হয়েছে কিন্তু আসলে জাহাজের ইঞ্জিনই খারাপ হয়ে গিয়েছিল এবং জাহাজ পাথরে ধাক্কা খেয়েছিল যা ক্যাপ্টেন জানায়নি যাত্রীদের যাতে সবাই আতঙ্কিত হয়ে না পড়ে। কিছুক্ষনের মধ্যেই জাহাজ একদিকে ক্রমশ হেলে যেতে শুরু করে, তখন যাত্রীরা বুঝে যায় জাহাজে কোন বড় সমস্যা হয়েছে, এটা কোনও যান্ত্রিক গোলোযোগ নয়। আরও কিছুক্ষন পর জাহাজ এতটা হেলে যায় যে জাহাজের নীচের তলায় জল ঢুকতে শুরু করে দেয় তখন সবাই বুঝে যায় জাহাজ ডুবতে শুরু করেছে। কোস্টা কনকরডিয়া ডুবে যাবার ঠিক একশো বছর আগে ১৯১২ সালে ঐতিহাসিক টাইটানিক জাহাজও ডুবে গিয়েছিল বরফের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে। কাকতালীয় ভাবে যখন কোস্টা কনকরডিয়া পাথরে ধাক্কা খায় তখন জাহাজটির ডাইনিং রুমে হলিউডের বিখ্যাত টাইটানিক সিনেমার মাই হার্ট উইল গো অন গান বাজছিল।
ইতালিয়ান সংস্থা কোস্টা ক্রোসিয়ারে নামক সংস্থা এই কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজ চালাতো। প্রথমে সংস্থাটি পন্যবাহী জাহাজ চালাতো পরে যাত্রীবাহী ক্রুজের ব্যবসাও শুরু করে তারা। ২০০০ সালের দিকে কার্নিভাল কর্পোরেশন নামক একটি সংস্থা কোস্টা ক্রোসিয়ারে সংস্থাটিকে কিনে নেয়। এই কার্নিভাল কর্পোরেশনই ২০০৪ সালে কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজের অর্ডার দেয়। ইতালির জেনোয়াতে সেস্ট্রি পোনেনতে জাহাজ নির্মান সংস্থা এই জাহাজ তৈরির কাজ শুরু করে। ২০০৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর কোস্টা কনকরডিয়াকে লঞ্চ করা হয়। তবে সমুদ্রে প্রথম পরীক্ষার সময়েই জাহাজটিতে কিছু সমস্যা দেখা যায়, সাধারনত এই ধরনের ঘটনাকে সমুদ্রযাত্রার ক্ষেত্রে অশুভ মানা হয়। ২০০৬ সালের ৩০ জুন জাহাজটিকে কার্নিভাল কর্পোরেশনকে দেওয়া হয়। সেইসময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রুজ জাহাজ ছিল এই কোস্টা কনকরডিয়া যা তৈরি হতে খরচ হয় ৫৭০ মিলিয়ন ডলার। কনকরডিয়া শব্দের অর্থ ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি, শান্তি ও ঐক্য বজায় রাখা। প্রায় ২৯১ মিটার লম্বা কোস্টা কনকরডিয়া জাহজটির সর্বোচ্চ গতি ছিল ১৯.৬ কিলো নটস বা ৩৬ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। কিন্ত সমুদ্রে পরীক্ষার সময় জাহাজটি ২৩ কিলো নটস বা ৪৩ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতি তুলতে সক্ষম হয়েছিল। চোদ্দ তলা কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজটির প্রতিতলার নাম একটি ইউরোপীয়ান দেশের নামে রাখা হয়। বিলাসবহুল রনতরী কোস্টা কনকরডিয়াতে ১,৫০০ কেবিন, ৫৮ স্যুট, স্পা, রেস্টুরেন্ট, জিম, সুইমিং পুল, সিনেমা হল, বার, ভিডিও গেম সেন্টার, বাস্কেট বল খেলার জায়গা, ইন্টারনেট ক্যাফে এমনকী ফর্মুলা ওয়ান সিমুলেটর পর্যন্ত ছিল।
২০০৮ সালের ২২ নভেম্বর পালেরমোর সিশিলিয়ান শহরে কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজটি তীব্র হাওয়ায় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডিসেম্বর মাসেই জাহাজটিকে ঠিক করা হয় কিন্তু তখনও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দাগ বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ২০১১ সালে জাহাজটিকে পরিপূর্ন ভাবে ঠিক করা হয়। ১৩ জানুয়ারি, ২০১২ ইতালির সিভিটাভেক্কিয়া বন্দর থেকে ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিসকো শেট্টিনোর নেতৃত্বে রওনা হয়। সাভোনা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর জাহাজটি দুই ঘন্টা পর নিজের আসল পথ পরিবর্তন করে আইসোলা ডেল গিগলিও দ্বীপের কাছ দিয়ে যাওয়া শুরু করে। ফ্রান্সিসকো শেট্টিনো ইচ্ছে করেই এই দ্বীপের কাছ দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাচ্ছিল কারন ফ্রান্সিসকো শেট্টিনো মারিও পালোম্বো নামে এক নাবিকের অধীনে বহুকাল কাজ করেছিলেন, ওই মারিও পালোম্বো আইসোলা ডেল গিগলিও দ্বীপেই থাকতো তাই মারিওকে সম্মান জানাতে জাহাজটিকে গিগলিও দ্বীপের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ফ্রান্সিসকো শেট্টিনো মারিও পালোম্বোকে ৯:৪০ নাগাদ এই বিষয়ে জানাতে ফোন করে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন পালাম্বো গিগলিও দ্বীপে ছিলনা। দ্বীপের কাছ দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাওয়া যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ন ছিল কারন সাধারনত দ্বীপের আশেপাশে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে প্রচুর পাথুরে জায়গা থাকে। মারিও পালোম্বোকে ফোন করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে এমনই একটি পাথুরে জায়গায় তীব্র ধাক্কা খায় কোস্টা কনকরডিয়া। রোম থেকে একশো কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে গিগলিও দ্বীপের পাঁচশো মিটার দূরত্বে এই দুর্ঘটনা ঘটে। পাথরের ধাক্কায় জাহাজের নীচে গুরুত্বপূর্ন অংশে ৫৩ মিটার লম্বা গর্ত হয়ে যায় এবং জাহাজের নীচের অংশে ইঞ্জিন রুমের তিনটি বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় যাতে জাহাজের ইলেকট্রিক সিস্টেম ও ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়।
রাত ১০:১২ মিনিটে ইতালিয়ান উপকূল রক্ষা বিভাগ জাহাজের ক্যাপ্টেন শেট্টিনোকে ফোন করে কিন্ত শেট্টিনো উপকূল রক্ষীদের তখনও সত্যি কথা না জানিয়ে বলে যান্ত্রিক গোলোযোগ হয়েছে৷ কিন্তু ১০:২২ মিনিট নাগাদ অবশেষে শেট্টিনো জাহাজে ঘোষনা করে ধাক্কা খাওয়ার কথা এবং ১০:৫৪ নাগাদ তিনি নির্দেশ দেন জাহাজ খালি করার, সব যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিসকো শেট্টিনোর নির্দেশ দেওয়ার দশ মিনিট আগেই লাইফ বোটে করে যাত্রীদের গিগলিও দ্বীপে পাঠানো শুরু হয়ে যায়।
কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজে মোট ৪,২২৯ জন যাত্রী ছিল যার মধ্যে ৩,২০৬ সাধারন যাত্রী এবং ১,০২৩ ক্রু সদস্য ছিল। ইতালির গিগলিও দ্বীপ একটি ছোট দ্বীপ যার জনসংখ্যা মাত্র সাতশো জন ছিল। তবে সেই রাতে গিগলিও দ্বীপের অনেক মানুষ, দ্বীপের মেয়র নিজে উদ্ধারকার্যে অংশ নেয়। ইতালির উপকূল রক্ষী বিভাগ এগিয়ে আসে উদ্ধারকার্যে। জাহাজের এরকম পরিস্থিতিতে সবার আগে জাহাজ থেকে পালিয়ে যায় ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিসকো শেট্টিনো। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী দুর্ঘটনাগ্রস্থ জাহাজ খালি করার আদেশ দেওয়ার ত্রিশ মিনিটের মধ্যে জাহাজ ছেড়ে দেওয়া দরকার কিন্তু কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজ থেকে সমস্ত যাত্রীদের সরাতে ছয় ঘন্টার বেশী সময় লেগে যায়। তবে কিছু যাত্রী তখনও জাহাজে আটকে ছিল যাদের উদ্ধার করতে আরও কিছুদিন লেগে যায়। কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজ দূর্ঘটনায় ৩২ জনের মৃত্যু হয়। সেই রাতে কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজে একজন ভারতীয় ক্রু রাসেল রেবেলো ছিলেন, তিনি অন্য যাত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে নিজে মারা যান। ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়৷ উদ্ধারকার্য শেষ হওয়ার পর শুরু হয় জাহাজ থেকে তেল বের করার অভিযান। যেহেতু কোস্টা কনকরডিয়া যাত্রা শুরু করার মাত্র আড়াই ঘন্টার মধ্যে দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয় তাই জাহাজটিতে তেল ভর্তি ছিল পুরো। জাহাজটিতে প্রায় ২,৩৮০ টন বা উনিশ লাখ লিটার তেল ছিল। ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২ তেল উদ্ধার করা শুরু হয় যা সম্পূর্ন হতে এক মাসের বেশী সময় লেগে যায়। ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রায় দেড় বছরের বেশী চেষ্টার পর জাহাজটিকে সোজা করা হয়। এই দেড় বছরে পুরো মিশনে ৭৯৯ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যায়। এরপর কোস্টা কনকরডিয়াকে অন্য জাহাজ দ্বারা টেনে নিয়ে বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে জাহাজটিকে ভেঙে তার যান্ত্রাংশ বিক্রি করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ হয় ২০১৭ সালের ৭ জুলাই। দূর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে এবং প্রত্যেক যাত্রীদের মোটা অর্থ ক্ষতিপূরন দেওয়া হয়। কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজের দুর্ঘটনায় জাহাজ সংস্থার ২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। এই পুরো ঘটনার জন্য শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিই দায়ী ছিল সে হল জাহাজের ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিসকো শেট্টিনো, তাকে ২০১৭ সালে বিচারে ১৬ বছরের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়, এছাড়া কোস্টা কনকরডিয়া জাহাজের আরও পাঁচজন অফিসারকে দুই বছরের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়।