ভারত, আমেরিকা এবং চীনের তিনটি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের মধ্যে কোনটি সেরা?
১৯৯৭ সালে বলিউডের তৈরি বর্ডার সিনেমায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া লংগেওলা যুদ্ধকে খুব সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের বিপক্ষে অসাধারন বীরত্ব দেখিয়েছিল। এই যুদ্ধে ভারতের ১২০ জন সেনা ও কিছু বিএসএফ পাকিস্তানের তিন থেকে চার হাজার সেনা ও ৪০ টি ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে লংগেওলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লংগেওলা রাজস্থানের জয়শলমীর জেলার থর মরুভূমিতে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকা। ৪-৭ ডিসেম্বর হওয়া এই যুদ্ধে মেজর কুলদীপ সিং চাঁদপুরী ও তার সেনারা যেমন অসাধারন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তেমন ভারতীয় বায়ুসেনাও অসাধারন পরাক্রম দেখিয়েছিল। জয়শলমীর থেকে ভারতীয় বায়ুসেনার চারটি হান্টার যুদ্ধবিমান কয়েক মিনিটে লংগেওয়লা পৌঁছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ত্রিশটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে দেয়।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৭৬ বছরে ভারতীয় বায়ুসেনা একাধিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, প্রতিক্ষেত্রে আধুনিক যুদ্ধবিমান ও দক্ষতার কারনে শত্রু পরাজিত হয়েছে। যেমন ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী ভারতীয় বায়ুসেনার মিরাজ ২০০০ যুদ্ধবিমান পাকিস্তানে ঢুকে জঙ্গি সংগঠন জইশ ই মহম্মদের ঘাঁটিতে ইসরায়েলের তৈরি স্পাইস ২০০০ বোম্ব ফেলে। বর্তমানে ভারতীয় বায়ুসেনায় সুখোই ৩০ এমকেআই, তেজস মার্ক ১ এর মতোন আধুনিক যুদ্ধবিমান রয়েছে, এছাড়া মিগ ২১(ইতিমধ্যে অবসর করানো শুরু হয়ে গেছে), জাগুয়ার ও মিরাজ ২০০০ এর মতোন কিছু পুরোনো যুদ্ধবিমানও রয়েছে যা খুব শীঘ্রই অবসরে যাবে। তবে এসব যুদ্ধবিমানের মধ্যে এই মহূর্তে ভারতীয় বায়ুসেনায় সবচেয়ে ঘাতক যুদ্ধবিমান বলা হয় রাফায়েলকে। বিশ্বে ৪.৫ + জেনারেশনের সবচেয়ে ঘাতক যুদ্ধবিমান বলা হয় ফ্রান্সের ড্যাসল্ট অ্যাভিয়েশন সংস্থার তৈরি রাফায়েলকে। ভারতীয় বায়ুসেনার কাছে বর্তমানে ৩৬ টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান রয়েছে। চীন ও পাকিস্তানের মতোন প্রতিবেশী থাকায় ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সবসময় প্রস্তত থাকতে হয়। শত্রুর বিরুদ্ধে জিততে গেলে সবসময় তার শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে হয়। ভারতীয় বায়ুসেনার যেমন সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমান রাফায়েল, ঠিক তেমন পাকিস্তান বায়ুসেনার সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমান আমেরিকার এফ ১৬ এবং চীনের বায়ুসেনার সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমান জে ২০।
আধুনিক বিশ্বে কোন দেশ কতটা শক্তিশালী তা দেশটির সেনাবাহিনীর সংখ্যার উপর নির্ভর করেনা তা নির্ভর করে দেশটির কাছে আধুনিক সমরাস্ত্র, প্রযুক্তির উপর এবং দেশটির গবষেনায় ব্যায়ের উপরে। এই মহূর্তে বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ ভারত। রাশিয়া, ফ্রান্স থেকে যুদ্ধবিমান কেনার পাশাপাশি ভারত দেশেও নিজস্ব প্রযুক্তিতে যুদ্ধবিমান তৈরি করছে। তেজস যুদ্ধবিমান হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড বা হ্যাল দেশেই তৈরি করছে। তবে তেজসের থেকেও অনেক বেশী শক্তিশালী যুদ্ধবিমান রাফায়েল। ফ্রান্সের সাথে ২০১৬ সালে ভারতের ৩৬ টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান তৈরির চুক্তি হয়। যেকোনও যুদ্ধবিমানের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সেন্সর এবং আক্রমনাত্মক ক্ষমতা অর্থাৎ যুদ্ধবিমান কতক্ষন আকাশে থাকতে সক্ষম এবং বিমানটিতে থাকা সর্বাধুনিক অস্ত্রের উপর বিমানটি কতটা শক্তিশালী নির্নয় করা হয়। যদি কখনও ভারত, চীন এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয় তাহলে আকাশ যুদ্ধে কে জিতবে এটা নির্ভর করে তিনটি দেশের বায়ুসেনায় থাকা যুদ্ধবিমানের উপরই।
যদি রাফায়েল, এফ ১৬ এবং জে ২০ এর মধ্যে তুলনা করা হয় :—
১) রাফায়েল ফ্রান্সের ড্যাসল্ট অ্যাভিয়েশনের তৈরি দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, এফ ১৬ আমেরিকার লকহিড মার্টিনের তৈরি এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এবং জে ২০ বা চেংদু জে ২০ চীনের চেংদু এরোস্পেস কর্পোরেশনের তৈরি ভারতের রাফায়েলের মতোই দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। জে ২০ যুদ্ধবিমানের প্রকৃত তথ্য সম্পর্কে বিতর্ক আছে। চেংদু কর্পোরেশন জানিয়েছে জে ২০ পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কিন্তু চীনের সরকারি মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমস জে ২০ কে চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বলেছে সুতরাং বিতর্ক রয়েই গেছে। ইঞ্জিনের দিক দিয়ে রাফায়েল ও জে ২০ পাকিস্তানের এফ ১৬ এর তুলনায় এগিয়ে কারন দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমানের তুলনায় বেশী নির্ভরযোগ্য এবং গতিও বেশী। তবে এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমানের খরচ কম।
২) রাফায়েলের উইংস্প্যান ১০.৯০ মিটার এবং পেলোড সমেত রাফায়েলের ওজন ২৪.৫ টন। এফ ১৬ এর উইংস্প্যান ৯.৯৬ মিটার এবং পেলোড সমেত এফ ১৬ এর ওজন ১৩ টন। জে ২০ এর উইংস্প্যান ১৩.৫ মিটার এবং পেলোড সমেত ৩৭ টন। অর্থাৎ রাফায়েল এফ ১৬ এর তুলনায় অনেক বেশী অস্ত্র বহন করতে পারে কিন্তু জে ২০ রাফায়েলের থেকেও বেশী অস্ত্র বহন করতে পারে।
৩) রাফায়েল ৫০,০০০ ফুট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম, রাফায়েলের কমব্যাট রেঞ্জ ৩৭০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা এবং রাফায়েলের সর্বোচ্চ গতি ২১৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। এছাড়াও রাফায়েল ৩০০ মিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে ভার্টিক্যালি উপরে উঠতে সক্ষম। এফ ১৬ এর কমব্যাট রেঞ্জ প্রায় ৪২০০ কিলোমিটার, এফ ১৬ ও রাফায়েলের মতো ৫০,০০০ ফুট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। এফ ১৬ এর সর্বোচ্চ গতি ২৪১৪ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। এফ ১৬ ২৫৪ মিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে ভার্টিক্যালি উপরে উঠতে সক্ষম। জে ২০ এর কমব্যাট রেঞ্জ ৫৯২৬ কিলোমিটার, জে ২০ ৬৬,০০০ ফুট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। জে ২০ এর সর্বোচ্চ গতি ২৯৬৪ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। জে ২০ ৩০৪ মিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে ভার্টিক্যালি উপরে উঠতে সক্ষম। অর্থাৎ রেঞ্জ এবং গতির দিক দিয়ে রাফায়েল তার দুই প্রতিপক্ষের থেকে একটু পিছিয়ে বিশেষ করে জে ২০ এই ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে।
৪) রাফায়েল ১০.২৪ টন জ্বালানি বহন করতে সক্ষম, যেখানে এফ ১৬ ৪.৩৯ টন এবং জে ২০ এর জ্বালানি বহন ক্ষমতা ততটা জানা যায়নি তবে বাকী দুই প্রতিপক্ষের থেকে অনেক বেশী।
৫) রাফায়েলে চোদ্দটি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে। রাফায়েল মিটিওর ও মিকা বিভিআর বা বিয়ন্ড ভিসুয়্যাল রেঞ্জ মিসাইল বহন করে। মিটিওর বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিভিআর যার রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটারের বেশী এবং এর নো এস্কেপ জোন ৬০ কিলোমিটার। অর্থাৎ রাফায়েলের ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও বিমান এলে তা ধ্বংস হবেই। এছাড়া রাফায়েলে স্ক্যাল্প এয়ার টু সারফেস মিসাইল, এইম৩৯ এক্সোয়েট অ্যান্টিশিপ মিসাইল ও বেশ কিছু লেজার গাইডেড বোম্ব বহন করে। তাছাড়া রাফায়েলে ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি অস্ত্র মিসাইল এবং স্মার্ট অ্যান্টি এয়ারফিল্ড ওয়েপন ইনস্টল করা যাবে।
এফ ১৬ এ নয়টি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে। এফ ১৬ এইম ৯ সাইডউইন্ডার শর্ট রেঞ্জ এয়ার টু এয়ার মিসাইল, এইম ১২০ আমরাম মিডিয়াম রেঞ্জ এয়ার টু এয়ার মিসাইল, এজিএম মাভেরিক এয়ার টু সারফেস মিসাইল বহন করে। রাফায়েলে ব্যবহৃত ৩০ এমএম ফায়ারিং ক্যানন এক মিনিটে ২৫০০ রাউন্ড ফায়ার করতে পারে যা এফ ১৬ এর ২০ এমএম ক্যাননের থেকে অনেক বেশী। অর্থাৎ রাফায়েল এফ ১৬ এর তুলনায় বেশী অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। তাছাড়া রাফায়েল এফ ১৬ এর তুলনায় অনেক আধুনিক জ্যামার, ডেকয় এবং ডিজিটাল অ্যাভিয়নিক্স রয়েছে।
জে ২০ ছয় ধরনের মিসাইল বহন করতে পারে। জে ২০ পিএল ১৫ বিভিআর বহন করে। চীন দাবি করছে পিএল ১৫ এর রেঞ্জ ৩০০ কিলোমিটার যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মিটিওর বিভিআর এর গতি চার ম্যাক যা আমরাম এবং পিএল ১৫ এর তুলনায় অনেক বেশী আধুনিক। রাফায়েলে ওয়েপনস সিস্টেম এফ ১৬ এবং জে ২০ এর তুলনায় অনেক বেশী আধুনিক।
৬) যেকোনও যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অংশ তার রেডার। এফ ১৬ যুদ্ধবিমানে এপিজি ৮৩ এসা রেডার ব্যবহার করা হয়েছে যা ১২০ কিলোমিটার রেঞ্জের মধ্যে ২০ টি টার্গেট শনাক্ত করতে সক্ষম রাফায়েলে আরবিই২ এএ এসা রেডার ব্যবহার করা হয়েছে যার রেঞ্জ ২০০ কিলোমিটার এবং এটি ১০০ কিলোমিটার রেঞ্জের মধ্যে ৪০ টি টার্গেট শনাক্ত করতে সক্ষম। রাফায়েলে স্পেক্টা ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম রয়েছে যা শত্রুর রেডারকে জ্যাম করতে সক্ষম, এছাড়া এই সিস্টেম রাফায়েলের দিকে আগত মিসাইল সম্পর্কে ওয়ার্নিং দেয় পাইলটকে এবং ডেকয় ব্যবহার করে মিসাইলকে ফাঁকি দিতেও সক্ষম এই সিস্টেম। ডেকয় সিস্টেম ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পালস তৈরি করে যা মিসাইলকে বিভ্রান্ত করে। চীন দাবি করে জে ২০ পঞ্চম প্রজন্মের যার কারনে এই বিমান স্টেলথ প্রযুক্তি যুক্ত। স্টেলথ এমন একটি প্রযুক্তি যা ব্যবহার করে কোন বিমান শত্রুর রেডারে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলে। চীন দাবি করে রাফায়েলের রেডার জে ২০ কে শনাক্ত করতে সক্ষম নয়। কিন্ত রাফায়েল ২০০৯ সালে ইউএইতে মকড্রিলে রাফায়েল এফ ২২ রেপ্টরকে শনাক্ত করতে সক্ষম। মজার ব্যাপার হল এফ ২২ রেপ্টরের ডিজাইনকে নকল করেই জে ২০ তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং আকাশ যুদ্ধে রাফায়েল খুব সহজেই শনাক্ত করে ফেলবে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। রাফায়েল ৪.৫ জেনারেশনের যুদ্ধবিমান হলেও রাফায়েল সেমি স্টেলথ বৈশিষ্ট্য যুক্ত। তাছাড়া জে ২০ এর ইঞ্জিন নিয়েও যথেষ্ট সমস্যা আছে, পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন এখনও তৈরি করতে পারেনি চীন।
সবকিছু বিচারে রাফায়েল ও জে ২০ এফ ১৬ এর তুলনায় যথেষ্ট এগিয়ে। পাকিস্তানের কাছে এফ ১৬ এর সর্বাধুনিক ভার্সন এফ ১৬ ব্লক ৭০ নেই। পাকিস্তানের কাছে মূলত এফ ১৬ ব্লক ৫২ ভার্সন এবং তারও পুরোনো ভার্সন রয়েছে। সুতরাং ভারতের রাফায়েলের সামনে এমনিতেই পাকিস্তান বায়ুসেনা পিছিয়ে রয়েছে। মূলত জে ২০ এবং রাফায়েলের মধ্যে যুদ্ধ হলে রাফায়েল কিছুটা এগিয়ে থাকবে রাফায়েলের পশ্চিমা আধুনিক ওয়েপনস সিস্টেমের কারনে। তবে আকাশ যুদ্ধে পাইলটের দক্ষতার উপরেই বিমানের সাফল্য নির্ভর করে।