ব্ল্যাক ডেথ কি জানেন?
সময়টা ১৩৪৭ সালের অক্টোবর মাস, সাধারনত এইসময়ে ইউরোপ জুড়ে কনকনে ঠান্ডা বায়ুপ্রবাহ চলে। এমনই এক শীতের দিনে কৃষ্ণসাগর হয়ে বহু পথ অতিক্রম করে প্রায় বারোটি বানিজ্যিক জাহাজ ইটালির সিসিলি বন্দরে পৌঁছায়। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ কিছুটা অবাক হয় যে জাহাজ গুলো বন্দরে আসার পর বহুক্ষন কেটে গেলেও কেন কোনও ব্যাক্তি কোনও জাহাজ থেকে বাইরে আসছেনা। কৌতুহল বশত কিছু লোক নিজেরাই জাহাজে প্রবেশ করে এবং ভিতরের দৃশ্য দেখে তারা হতবাক হয়ে যায়। দেখা যায় জাহাজের ভিতরে সারিসারি মৃতদেহের স্তূপ এবং তার মধ্যেই কিছু অর্ধমৃত মানুষ রয়েছে। সবাই এটাই ভাবতে থাকে এত মানুষের মৃত্যু হল কি করে? তখনও কেউ বুঝতে পারেনি আগামীদিনে ইউরোপে কি ধ্বংসলীলা হতে চলেছে। আসলে জাহাজের এই মৃতদেহ গুলো ছিল ইউরোপের আকাশে ঘনিয়ে আসা কালো মেঘের সংকেত, যা ইউরোপকে মৃতের স্তূপে পরিনত করে। জাহাজ গুলো থেকে শুরু হওয়া মৃত্যুর তান্ডব কয়েক বছরের মধ্যে ভয়ানক মহামারীর রূপে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে যার কবলে পড়ে প্রান হারায় ইউরোপের অর্ধেক মানুষ। এই মহামারীর নাম ছিল ব্ল্যাক ডেথ বা কালো মৃত্যু।
তেরো ও চোদ্দ শতকে ইউরোপের অবস্থা বাকী মহাদেশ গুলোর মতোই ছিল। প্রাকৃতিক সমস্যা ও সংক্রমক ব্যাধির কবলে ইউরোপও ছিল। ১৩০০ সালের দিকে খারাপ আবহওয়ার কারনে উত্তর ইউরোপে ফসলের উৎপাদন এতটা কম হয় যে খাদ্য দ্রব্য তিনশো গুন বেশী দামে বিক্রি হতে থাকে, যার কারনে বেশীরভাগ মানুষ প্রায় অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাতে থাকে। ইউরোপে রীতিমতো খাদ্য সংকট তৈরি হয়ে যায়। ইউরোপ এই সমস্যা কোনওরকমে মোকাবিলা করছিল কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে ব্ল্যাক ডেথ নামক মহামারীর থেকে তারা তখনও অনভিজ্ঞই ছিল। ১৩৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ইটালির সিসিলি বন্দরে আসা জাহাজ গুলো থেকে যখন মৃতদেহ গুলো নামানো হচ্ছিল তখন মানুষজন বুঝতেই পারেনি তারা নিজেদের অজান্তেই তাদের মৃত্যু ডেকে আনছে। দুইদিন ধরে সেসব মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়। কিন্তু এইসব মৃতদেহ কবর দেওয়ার সময়ই অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। এক শ্রেনীর মানুষ ছিল যারা সেই বন্দরের আশেপাশেও ছিলনা, প্রথম দিকে তারা কিছুটা নিরাপদ থাকলেও ধীরে ধীরে তারাও সংক্রামিত হতে শুরু করে। এই ব্ল্যাক ডেথ আসলে প্লেগ মহামারী ছিল। কিন্তু এই ব্ল্যাক ডেথ ইউরোপে আসলো কি করে!! এই সম্পর্কে প্রথমদিকে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ হয়। কোথাও বলা হয় এই রোগ পশু থেকে মানুষের মধ্যে এসেছে আবার কোথাও দাবি করা হয় মানুষ থেকেই মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে এই রোগ। শেষে অনুসন্ধান করে জানা যায় এই প্লেগ মহামারী ছড়িয়েছে চীন থেকে৷ বর্তমান দিনের করোনা মহামারীর মতোন প্লেগ মহামারীও চীনের দান। সেসময় দক্ষিন এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার সাথে ইউরোপের বানিজ্য হত জলপথে ও স্থলপথে।
চীন থেকে মূলত রেশম আমদানি হত, এর জন্য বিশেষ রাস্তাও তৈরি করা হয়েছিল যাকে সিল্করুট বা রেশমপথ বলা হত। ১৩৪৬ সালে ইউরোপের জাহাজগুলো যখন চীনে পৌঁছায় তখন সেখানে আগে থেকেই প্লেগ মহামারী চলছিলো। সেসময় আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ইন্টারনেট না থাকায় মানুষের পক্ষে এটা জানা সম্ভব ছিলনা যে কোন দেশে কি চলছে। প্লেগ রোগ মূলত হাওয়ার মাধ্যমে, সংক্রামিত ব্যক্তির হাঁচি, কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। সেসময় চিকিৎসা বিজ্ঞান এতটা উন্নত ছিলনা যে এই মহামারী থেকে বাঁচার উপায় বার করবে। চিকিৎসাবিদরা সেসময় মনে করতো কাঠবিড়ালি, ইঁদুর, খরগোশ, মুরগী এই প্লেগ রোগের বাহক। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ইঁদুরকেই এই রোগের বাহক মানা হত।
প্লেগের ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত ব্যাক্তির গুরুত্বপূর্ন অঙ্গে আক্রমন করে। সংক্রামিত ব্যক্তির শরীরে ছুঁচের মতো ছোট ছোট ফোলা ফোলা অংশ তৈরি হয় এবং পরে তা ধীরে ধীরে বেগুনী বা কালো রঙের হয়ে যায়। এই ফোলা অংশ থেকে রক্ত ও পুঁজ বেরোতো। আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীরের ভিতরেও রক্তক্ষরন হত। এছাড়াও এই রোগে সংক্রামিত ব্যক্তির জ্বর, বমি, কাশির সাথে রক্ত বেরোনো এবং শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা হত। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে রক্ত কালো হয়ে যেত যার প্রভাবে চামড়াও কালো হয়ে যেত। এর কারনে এই রোগকে ব্ল্যাক ডেথ নাম দেওয়া হয়। সংক্রামিত ব্যক্তির পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু হত।
প্রথমদিকে এই রোগকে দি গ্রেট মোর্টালিটি বলা হত, পরে এর নাম দেওয়া হয় ব্ল্যাক ডেথ। চীন থেকে প্লেগের জীবানু বাহক ইঁদুর জাহাজে উঠে পড়ে যার কারনে জাহাজের সদস্যরা প্লেগ আক্রান্ত হয়। জাহাজে কোন ডাক্তার ছিলনা ফলে মৃত্যু ছাড়া কোন উপায় ছিলনা তাদের কাছে। সিসিলি আসার আগে জাহাজগুলো ইউক্রেনের ক্রিমিয়াতে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে এই রোগ ইউক্রেনেও ছড়িয়ে পড়ে। আটমাসের মধ্যে এই রোগ এশিয়া ও আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল, তবে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইউরোপ। বিশেষ করে ইউক্রেন, ইটালি, স্পেন ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ গুলো ও বাল্টিক দেশ গুলো তীব্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চীন থেকে শুরু হওয়া ব্ল্যাক ডেথ মহামারী সেসময় গোটা ইউরোপে প্রবল আকার ধারন করে। প্রথমে ইটালি এবং পরে বাকী ইউরোপ এই মহামারীর কবলে পড়ে। মানুষ থেকে শুরু করে পশুরাও বাদ যায়নি এই মহামারীর করাল গ্রাস থেকে। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় সেসময়। ১৩৫০ সাল আসতে আসতে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের মৃত্যু হয় ব্ল্যাক ডেথে। সেসময় ইউরোপের জনসংখ্যা ছিল ৫০ থেকে ৫২ মিলিয়ন। শুধু ইউরোপেই নয় ব্ল্যাক ডেথের কবলে পড়ে এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় ২৫ লাখ মানুষ প্রান হারায়। এত বিশাল সংখ্যায় মানুষের মৃত্যু হওয়ায় ইউরোপের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়ে। গরীর মানুষদের প্রায় সবারই মৃত্যু হয় যার কারনে কাজের জন্য লোক পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। বানিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, যার প্রভাবে ইউরোপে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। জিনিস কেনার মতোন অর্থ থাকেনা মানুষের হাতে, বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে ইউরোপে প্লেগের পাশাপাশি অনাহারেও লোক মারা যেতে থাকে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ গুলো বাধ্য হয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধও বন্ধ করে দেয়। ব্ল্যাক ডেথের কোন চিকিৎসা সেসময় জানা ছিলনা। যখনই মানুষ কোন কিছু সমাধান করতে পারেনা তখনই সেই ব্যাপারে কুসংস্কার শুরু করে দেয়, এক্ষেত্রেও তাই হয়। একশ্রেনীর মানুষ এটাকে অভিশাপ বলতে শুরু করে আবার এক শ্রেনীর মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে ইউরোপে থাকা ইহুদিরা এই রোগ এনেছে। যার কারনে ১৩৪৮ ও ১৩৪৯ সালে হাজার হাজার ইহুদিকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বহু মানুষ তুলনামূলক নিরাপদ উত্তর ইউরোপে পালিয়ে যায় প্রান বাঁচাতে। ফিলিপ জিয়াগলার তার বই দি ব্ল্যাক ডেথে লিখেছেন এসময় এক অভিনব শ্রেনীর মানুষ আসে যাদের দি উইপিং কাল্ট বলা হতো। এরা নিজেরা অন্যলোকের সামনে গায়ে চাবুক মারতো, এর মাধ্যমে তারা এটা বোঝাতে চাইতো গীর্জার কাছে এই মহামারী থামানোর কোন উপায়ই নেই। গীর্জার বিরুদ্ধে প্রায় আট লাখ মানুষ এই ধরনের অদ্ভুত প্রতিবাদে যুক্ত হয়েছিল। ধীরে ধীরে কিছু বছর পর ইউরোপ এই মহামারী থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। বলা হয় ব্ল্যাক ডেথ ইউরোপের অর্ধেক জনসংখ্যাকে ধ্বংস করে দিলেও এই মহমারীই ইউরোপে বিকাশের সূচনা করেছিল। এই মহামারীর কবলে এত লোকের মৃত্যু হয়েছিল যে মানুষের মন থেকে মৃত্যু ভয়ই চলে গিয়েছিল।
ইউরোপের মানুষ জাহাজ নিয়ে নতুন নতুন জায়গা আবিষ্কারে বেড়িয়ে পড়ে, এরপরেই ঔপনিবেশ বিস্তার শুরু হয়৷ এই মহামারীর পর ইউরোপে নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয় এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি হয়। পরে পরীক্ষা করে জানা যায় ইউরোপে দুধরনের প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। নিউমোনিক যাতে প্রচুর জ্বর ও রক্তবমি হত এবং সংক্রামিত ব্যক্তি তিনদিনের মধ্যে মারা যেত। বিওবনিক যাতে রোগীর শরীরে ফোলা অংশ তৈরি হত যা থেকে রক্ত ও পুঁজ বের হতো এবং পাঁচ দিনের মধ্যে রোগীর মৃত্যু হত। বিওবনিক প্লেগেই বেশী মানুষের মৃত্যু হয়। ইউরোপের মানুষ আগে থেকেই খাদ্য সংকটে ভুগছিল যার কারনে তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা কমে গিয়েছিল যার কারনে অনেক বেশী মানুষের মৃত্যু হয়। বহু লোক ব্ল্যাক ডেথে কষ্টের হাত থেকে বাঁচতে কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
১৮৯৪ সালপ ফ্রান্সের ব্যাকটেরিওলজিস্ট আলেকজান্ডার ইয়ার্সেন প্লেগের ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করে যার নাম ইয়ার্সেনিয়া পেস্টিস রাখা হয়। এরপরেই এই রোগের প্রতিষেধক তৈরি করা হয়। ব্ল্যাক ডেথ ইউরোপের ইতিহাসে কালো অধ্যায় ছিল যাকে ইতিহাসে মাহামারী জনিত সবচেয়ে বড় নরসংহার বলা হয়।