অফবিট

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করেছিল যে যুদ্ধ

বলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাই সিনেমাতে একটি বিখ্যাত ডায়লগ আছে তা হল যব দোস্ত বানাকে কম হো সাকতা হ্যায় তো ফির দুসমান কিউ বানায় যার অর্থ হল যখন কোন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করলে কাজ উদ্ধার হয় তাহলে সেই ব্যক্তির সাথে শত্রুতা করবার কোনও দরকার নেই। কখনও কখনও জীবনে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে সামনে থাকা শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করলেই হয়ত শত্রুতার দরকারই পরেনা, আবার এমন পরিস্থিতিও তৈরি হয় যেখানে একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারনে বন্ধু হওয়া ব্যক্তিও পরম শত্রু হয়ে যায়। ইতিহাসে এমন ঘটনা অনেক হয়েছে। এমনই একটি ঘটনা ঘটে এক বিশাল সাম্রাজ্যের সাথে যেখানে সাম্রাজ্যের শাসকের ভুল সিদ্ধান্তের কারনে বন্ধুভাবাপন্ন একটি রাজ্য সেই সাম্রাজ্যের শত্রুতে পরিনত হয়। ইতিহাসে তিনটি সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য হচ্ছে আলেকজান্ডারের গ্রীক সাম্রাজ্য, পার্সিয়ান সাম্রাজ্য এবং বিখ্যাত রোমান সাম্রাজ্য। এই রোমান সাম্রাজ্যেরই একটি ভুলের কারনে তাদের বন্ধু স্থানীয় প্রদেশ শত্রু হয়ে যায়।

সময়টা তখন ৩৭৫ এডি, সেসময় রোমান সাম্রাজ্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। কিন্তু ৩৭৫ এডি আসতে আসতে রোমান সাম্রাজ্যের লিজিয়নরা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল তারা আগের মতো শক্তিশালী ছিলনা আর। রোমান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে দীর্ঘ বাহিনীকে রোমান লিজিয়ন বলা হত। রোমান সেনাবাহিনীকে নির্দিষ্ট সংখ্যক সেনার বিচারে এক একটি শ্রেনীতে ভাগ করা হত এদের লিজিয়ন বলা হত। একটি রোমান লিজিয়নে সাধারনত ৪,২০০- ৫,৬০০ স্থলসেনা ও ৩০০ অশ্বারোহী সেনা থাকতো। রোমান লিজিয়নরা একসাথে সংঘবদ্ধ ভাবে আক্রমন করতো যার কারনে সম্মুখ সমরে তাদের পরাজিত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। একটি সাম্রাজ্য যখন শক্তিশালী হয় তখন তার শত্রুও তৈরি হয় অনেক। এমনই একটি গোষ্ঠী ছিল যাদের রোমানরা পচ্ছন্দ করতো না তাদের রোমানরা বারবেরিয়ানস বলতো, যাদের গথও বলা হত। তৎকালীন জার্মেনিক লোকেদের গথ বলা হত। উত্তর পশ্চিম ইউরোপ, মধ্য ইউরোপ এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে জার্মেনিকদের বসবাস ছিল। রোমানরা এই উত্তর মধ্য ইউরোপের নাম দিয়েছিল জার্মানিয়া। রোমানরা বিশ্বাস করতো গথদের কোন সভ্যতা, সংস্কৃতি নেই, তার বর্বর জাতি। কিন্তু বাস্তবে গথদের নিজস্ব সভ্যতা, সংস্কৃতি ছিল, তারা সফল ব্যাবসায়ী ছিল কিন্তু তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি রোমানদের থেকে আলাদা ছিল। গথরা পুরো সামরিক অনুশাসনে থাকতো যা রোমানরা পচ্ছন্দ করতোনা। 

রোমান সম্রাট জুলিয়াস ভেলেনস অগাস্টাসকে সিংহাসন থেকে হটাতে গথরা রোমান সাম্রাজ্যের শত্রু প্রোকোপিয়াস নামে এক ব্যাক্তিকে সাহায্য করে। কিন্তু জুলিয়াস অগাস্টাস প্রোকোপিয়াসকে ও গথদের পরাজিত করে। এরপর থেকেই রোমানরা গথদের শত্রু ভাবা শুরু করে। গথদের হারানোর পর জুলিয়াস অগাস্টাস পূর্ব সীমান্তে পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে, সেসময় পার্সিয়াও একটি বড় সাম্রাজ্য ছিল। জুলিয়াস অগাস্টাস যখন পূর্ব সীমান্তে ব্যস্ত ছিল সেসময় হুনরা গথদের আক্রমন করে। ইউরোপে আক্ষরিক অর্থে বারবেরিয়ানস বা বর্বর ছিল এই হুনরা। হুনদের কোন সভ্যতা ছিলনা তারা শুধু লড়াই করতে জানতো৷ মধ্য ইউরোপে হুনদের বর্বরতাকে সবাই ভয় পেত। হুনরা গথদের ভূমি আক্রমন করে তাদের এলাকা দখল করতে শুরু করে। 

প্রান বাঁচাতে প্রায় দুই লাখ গথ রোমান সীমান্তের কাছে চলে আসে। এখানে গথরা পড়ে যায় সমস্যায় কারন তাদের সামনে ছিল রোমান সীমানা, এই রোমানরা তাদের পরাজিত করেছিল এবং পিছনে রয়েছে হুনরা, গথরা দুই দিকেই শত্রুদের মাঝে বিপদে পড়ে যায়। এই দুই লাখ গথ দলের নেতা ছিল ফ্রিটির্জেন। গথ নেতা ফ্রিটির্জেন বাধ্য হয়ে রোমান সম্রাট জুলিয়াস অগাস্টাসের কাছে সাহায্য চায়। ফ্রিটির্জেন জুলিয়াস অগাস্টের কাছে কিছু ভূমি ও খাদ্য প্রার্থনা করে এবং জানায় তারা এখানে কৃষিকাজ করে জীবন কাটাবে। গথরা জুলিয়াস অগাস্টাসকে সিংহাসন থেকে হটানোর জন্য যুদ্ধ করা সত্ত্বেও জুলিয়াস অগাস্টাস ফ্রিটির্জেনের অনুরোধ মেনে নেয়। জুলিয়াস অগাস্টাস গথদের সামরিক দক্ষতা সম্পর্কে জানতো, তিনি ভাবেন গথদের রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে তার সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করবেন তাহলে রোমান সেনাবাহিনীর ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। জুলিয়াস অগাস্টাস জানতো রোমান লিজিয়নদের ক্ষমতা কমে আসছে তাই তিনি গথদের সেনাবাহিনীতে যুক্ত করবার সিদ্ধান্ত নেন। 

অগাস্টাস দুজন রোমান কম্যান্ডার লুপিনিকাস ও ম্যাক্সিমাসের হাতে গথদের দায়িত্ব দিয়ে আবারাও পূর্ব সীমান্তে পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে অভিযানে চলে যান। লুপিনিকাস ও ম্যাক্সিমাসের গথদের উপরে সবচেয়ে বেশী ক্ষোভ ছিল, তারা গথদের উপর প্রতিশোধের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। লুপিনিকাস ও ম্যাক্সিমাস গথদের জমি দেওয়ার পদ্ধতি ধীরে করে দেয় এবং গথদের খাদ্যও খুব কম পরিমানে দেওয়া হতে থাকে। লুপিনিকাস ও ম্যাক্সিমাসের পরিকল্পনা ছিল এভাবে ধীরে ধীরে অর্ধভুক্ত করে রাখা হবে গথদের যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোমানদের দাস হিসাবে কাজ করে। যখন এই পরিকল্পনার কথা ফ্রিটির্জেন বুঝতে পারলো তখন তিনি গথ যোদ্ধাদের নিয়ে রোমানদের উপর গোরিলা আক্রমন শুরু করে খাদ্যের জন্য। এভাবে মাঝে মাঝেই গথ ও রোমান সেনার মধ্যে সংঘর্ষ হত। 

৩৭৬ এডিতে একটি বিশাল রোমান সেনাকেই পরাজিত করে দেয় গথরা। এই ঘটনা রোমনদের হতভম্ব করে দেয় কারন সেসময় রোমান সেনাবাহিনীর দক্ষতা সব জায়গায় প্রশংসিত হত। সেই রোমান বাহিনীকেই পরাজিত করায় রোমান সম্রাট জুলিয়াস অগাস্টাস পূর্ব সীমান্ত থেকে ৫০,০০০ সদস্য যুক্ত বিশাল রোমান সেনা নিয়ে অ্যাড্রিয়ানাপোলে উপস্থিত হন ৩৭৮ এডিতে। আজকের বুলগেরিয়াকে অতীতে অ্যাড্রিয়ানাপোল বলা হত। গথ দলনেতা ফ্রিটির্জেন আবারও জুলিয়াস অগাস্টাসের কাছে গিয়ে পূর্বের মতোই ভূমি ও খাদ্য প্রার্থনা করে এবং তাদের সাথে হওয়া অবিচারের কথাও জানায়। কিন্ত তা সত্বেও জুলিয়াস অগাস্টাস হঠাৎই গথদের উপর আক্রমন করে বসে। যে জুলিয়াস অগাস্টাস নিজেই প্রথমে গথদের আশ্রয় দিয়েছিল সে হঠাৎ গথদের আক্রমন করার কারন নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। সবচেয়ে জোরালো কারন হিসাবে বলা হয় গথরা জুলিয়াস অগাস্টাসের দূতকে হত্যা করেছিল। 

জুলিয়াস অগাস্টাসের সাথে পঞ্চাশ হাজার সেনা ছিল, তার ধারনা ছিল গথদের হারানোর জন্য এটাই যথেষ্ট কিন্তু তিনি জানতেননা গথদের আরও বেশী সেনা ছিল। অন্তত ২০- ২৫ হাজার রোমান সেনা আরও পেছনে আসছিল যাদের অ্যাড্রিয়ানাপোলে পৌঁছাতে অন্তত দুই তিন দিন সময় লাগতো কিন্তু তার আগেই জুলিয়াস অগাস্টাস যুদ্ধ শুরু করে দেয় যা তার সবচেয়ে ঘাতক সিদ্ধান্ত ছিল। অ্যাড্রিয়ানাপোলের যুদ্ধে রোমান সেনাবাহিনীর শোচনীয় পরাজিত হয়, বেশীরভাগ রোমান সেনাই যুদ্ধে মারা যায় এবং বাকীদের বন্দী করা হয়। অ্যাড্রিয়ানাপোলের যুদ্ধের পর রোমান সাম্রাজ্য আরও কোনও বড় যুদ্ধে লড়াই করেনি কারন রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়ে গিয়েছিল। রোমানরা এমন একজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল যারা তাদের বন্ধু হতে পারতো। শুধুমাত্র লুপিনিকাস ও ম্যাক্সিমাসের ভুলের কারনে রোমান ও গথদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। অ্যাড্রিয়ানাপোলের যুদ্ধের কয়েক বছর পর গথরা পুরো রোমান সাম্রাজ্য দখল করে নেয় এবং রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হয় এক গথ ব্যাক্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *