অফবিট

৮৮ শতাংশ বাস পরিষেবা বন্ধ। কমিউনিজমের করালগ্রাসে চরম আর্থিক সংকটে কিউবা

বিংশ শতাব্দী থেকেই কমিউনিজম ও পুঁজিবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর থেকে বিভিন্ন দেশে কমিউনিজম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে কমিউনিজম ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কারনে সেসময় বিশ্বের অনেক দেশেই কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কমিউমিজম বা সাম্যবাদের বাস্তবিক কোনও মাপদন্ড না থাকায় একটা নির্দিষ্ট সময় পর প্রত্যেকটি কমিউনিস্ট দেশই পুঁজিবাদি দেশগুলোর তুলনায় সবদিক দিয়েই পিছিয়ে পড়ে। দূর্নীতি, ডিক্টেটরশিপ, অপশাসন ও নির্বিচারে গনহত্যার কারনে কমিউনিস্ট দেশগুলোর অর্থনীতি ভেঙে যায়। ১৯৯১ সালে বিশ্বের প্রথম স্বঘোষিত  কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন পনেরোটি খন্ডে ভেঙে যায়। একবিংশ শতাব্দী আসতে আসতে পুরো বিশ্ব বুঝে যায় গনতন্ত্র ও পুঁজিবাদই উন্নতির প্রকৃত চাবি। কিন্তু ততদিনে বেশকিছু কমিউনিস্ট দেশ তাদের নিজেদের পতন ডেকে এনেছিল। এরকমই একটি ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিস্ট দেশ কিউবা যা আজ তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। 

উত্তর আমেরিকার একটি ছোট দেশ কিউবা একটা সময় স্পেনের উপনিবেশ ছিল। ১৮৯৮ সালে কিউবাতে আমেরিকার আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। তবে ১৯০২ সালের ২০ মে কিউবাকে আংশিক স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ১৯৪০ সালে কিউবার রাষ্ট্রপতি হয় ফুলজেনসিও বাতিস্তা। বাতিস্তাকে আমেরিকা সমর্থন করত। বাতিস্তা রাষ্ট্রপতি হয়ে দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করে এবং কিউবার বেকার সমস্যা দূরীকরনের চেষ্টাও করে। কিন্ত তার বিরুদ্ধে দূর্নীতি ও একনায়কতন্ত্রের অভিযোগও ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পুঁজিবাদি আমেরিকা এবং কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এই প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়। কিউবার রাষ্ট্রপতি ফুলজেনসিও বাতিস্তা ছিল কমিউনিজম বিরোধী। 

১৯৫০ এর দশকে কিউবার রাজনীতিতে উত্থান হয় ফিদেল কাস্ত্রোর। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের উপর পড়াশোনা করে ফিদেল কাস্ত্রো। কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৫২ সাল থেকেই সরকারের বিরোধীতা শুরু করে। ১৯৫৩ সালে কিউবার সান্তিয়াগো দ্য কুবাতে অবস্থিত মনকাডা সেনাঘাঁটিতে ১৬০ জন লোকের নেতৃত্বে আক্রমন করে ফিদল কাস্ত্রো। সরকার বিরোধী এই আক্রমনের জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি পাবার পর ফিদেল কাস্ত্রো মেক্সিকো চলে যায় বাতিস্তা সরকারকে হটানোর প্রস্তুতির জন্য। ১৯৫৪ সালে ফুলজেনসিও বাতিস্তা দ্বিতীয় বারের জন্য রাষ্ট্রপতি হয় কিউবার। ১৯৫৫ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে পরিচয় হয় আর্নেস্তো চে গুয়েভারার। উগ্র কমিউনিজমে বিশ্বাসী চে গুয়েভারা আমেরিকার প্রচন্ড বিরোধী ছিল। বেশিরভাগ সময় সে তার সাথীদের নিয়ে জঙ্গলেই থাকতো। চে গুয়েভারা মূলত গোরিলা যুদ্ধনীতিতে বিশ্বাসী ছিল। ভারতেও মাওবাদীরা গোরিলা নীতিই অবলম্বন করে ঝটিকা আক্রমন করে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। আসলে সমস্ত কমিউনিস্ট উগ্রবাদীরাই সব দেশেই সরকারের বিরুদ্ধে গোরিলা আক্রমনের নীতিই অবলম্বন করে। চে গুয়েভারা কার্ল মার্ক্স, ভ্লাদিমির লেলিনের ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিল। অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতাদের মতোই চে গুয়েভারাও রীতিমতো গনহত্যা করেছে তার জীবনে। বাতিস্তা সরকারের কাছে ফিদেল কাস্ত্রোর সরকার বিরোধী কাজকর্মের খবর ছিল সেজন্য  কিউবাতে সেসময় ফিদেল কাস্ত্রো, তার ভাই রাউল কাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারাকে প্রকাশ্যে দেখা গেলে গ্রেফতার করবার অথবা হত্যা করবার আদেশ দিয়েছিল সরকার। 

১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গোরিলা আক্রমন করেছিল ফিদেল কাস্ত্রো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিদেল কাস্ত্রোকে ব্যাপক সহায়তা করে কমিউনিজমের প্রসারের জন্য, তাছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের আমেরিকার সমর্থিত বাতিস্তা সরকারকে কিউবা থেকে উৎখাত করার লক্ষ্য ছিল। 

১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে ৮১ জন বিপ্লবী গ্রানমা ইয়ট করে মেক্সিকো থেকে কইউবার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমনের জন্য। কিন্তু কিউবার সরকারের কাছে আগে থেকেই এই ইয়টের ব্যাপারে খবর ছিল যার জন্য তারা নামার সাথেসাথে কিউবার সেনাবাহিনী আক্রমন করে। এই আক্রমনে ৫৯ জনের মৃত্যু হয় অথবা গ্রেফতার হয়। ফিদেল কাস্ত্রো তার ভাই রাউল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা সহ ২২ জন বেঁচে যায় এই আক্রমনে এবং তারা সিয়েরা মস্ত্রা পর্বতে আশ্রয় নেয়। এখান থেকেই বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে ২৬ জুলাই আন্দোলনের জন্য গোরিলা আক্রমনের প্রস্ততি শুরু হয়। 

১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই ফিদেল কাস্ত্রো মনকাডা সেনঘাঁটিতে আক্রমন করেছিল যার জন্য সরকার বিরোধী কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ২৬ জুলাই আন্দোলন। ১৯৫৭ সালের ১৩ মার্চ হাভানাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে আক্রমনের চেষ্টা করে ফিদেল কাস্ত্রো কিন্তু এই অভিযান ব্যর্থ হয়, তার বহু সহযোগীর মৃত্যু হয়। ১৯৫৮ সাল আসতে আসতে কিউবার বহু মানুষ বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং ফিদেল কাস্ত্রোর পক্ষে যোগ দেয়। কিউবাতে রীতিমতো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, এরকম পরিস্থিতিতে আমেরিকা ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে বাতিস্তা সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফিদেল কাস্ত্রোর বাহিনীকে প্রতিহত করতে বাতিস্তা সিয়েরা মস্ত্রা পর্বতের পাদদেশে সেনাবাহিনীও পাঠায় কিন্তু কাস্ত্রোর সেনাবাহিনীর সামনে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। নভেম্বর মাস আসতে আসতে কিউবাতে ফুলজেনসিও বাতিস্তা ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়ে, যদিও তার সেনাবাহিনীর অধিকাংশ তখনও তারপক্ষেই ছিল কিন্তু আমেরিকা থেকে অস্ত্র না আসার করনে সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারা পূর্নাঙ্গ আক্রমন শুরু করে বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে। ২৭ ডিসেম্বার চে গুয়েভারার নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিদ্রোহীরা সান্তা ক্লারা শহরের কাছে একটি অস্ত্রবোঝাই ট্রেন লুঠ করে। পতন আসন্ন জেনে ফুলজেনসিও বাতিস্তা ১ জানুয়ারি, ১৯৫৯ সালে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে ডোমেনিকান প্রজাতন্ত্র পালিয়ে যায়। সেখান থেকে পরে পর্তুগালের মাদেইরাতে চলে যায় বাতিস্তা এবং বাকী জীবন পর্তুগালে নির্বাসনেই কাটিয়ে দেয়। ক্ষমতা দখল করেই ফিদেল কাস্ত্রো বাতিস্তা সরকারের সাথে জড়িত ৬০০ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয় এবং বহু লোককে গ্রেফতার করা হয়। কমিউনিস্ট শাসকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা ভোগ এবং পরিবারতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, উত্তর কোরিয়া সহ সমস্ত কমিউনিস্ট দেশেই এই একই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এই একই অবস্থা কিউবারও হয়। ১৯৫৯ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৪৭ বছর পর্যন্ত কিউবার প্রধান ছিল ফিদেল কাস্ত্রো, এই সময়কালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন হয়েছে দশ বার। ২০০৬ সালে ফিদেল কাস্ত্রো তার ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেয়। 

কোনও দেশে দীর্ঘদিন ধরে কমিউনিস্ট সরকারের শাসনকাল থাকলে সেই দেশটি দীর্ঘমেয়াদি ভাবে চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়ে। কারন কমিউনিস্ট শাসনে দেশটির জনগনের কোনও অধিকার থাকেনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার। সুতরাং ডিক্টেটর সরকার যদি ভুল আর্থিকনীতি গ্রহনকরে তাহলেও প্রতিবাদ করতে পারেনা জনগন। এই জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, অতীতে চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়ার মতোন দেশ চরম অর্থনৈতিক দুর্দশা, দূর্নীতির স্বাক্ষি থেকেছে। বর্তমানে কিউবাতেই চরম অর্থনৈতিক দুরাবস্থা বিরাজ করছে। বিগত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কিউবা। 

২০২০ সাল থেকে, কিউবাতে নাগরিকদের কর্মক্ষেত্রে মজুরি কমে গেছে, সরকারি পরিষেবার অবনতি হয়েছে, নিয়মিত বিদ্যুৎ বিভ্রাট, দূর্নীতি ও কালো বাজারের শিকার সাধারন মানুষ।  লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে ইতিমধ্যেই। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বে কিউবার অবস্থান ১৭৫তম। ২০২৩ সালে কিউবান অবজারভেটরি অব হিউম্যান রাইটস এর সমীক্ষা অনুযায়ী দেশটির ৮৮ শতাংশ জনসংখ্যাই দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। উত্তর আমেরিকা অঞ্চলের ৩২টি দেশের মধ্যে আর্থিকভাবে সবচেয়ে নীচে রয়েছে কিউবা। কিউবার সরকারের ভুল আর্থিক পরিকল্পনাই দায়ী দেশটির এই পরিস্থিতির জন্য। কিউবার অর্থনীতির প্রধানভিতই ছিল পর্যটন। করোনা মহামারীর পর থেকে দেশটির অর্থনৈতিক দুর্দশা শুরু হয়। কিউবা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসের অধিকাংশই আমদানি করতো কিন্তু বিগত কয়েক বছরে দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় কিউবা আমদানি করতে পারছেনা যার জন্য দেশটিতে খাদ্য, জ্বালানি, ঔষুধ সহ প্রয়োজনীয় জিনিসের পরিমান অন্তত ৫০ শতাংশ সংকোচন হয়েছে। প্রয়োজনীয় সারের অভাবে কিউবাতে খাদ্য উৎপাদনও কমে গেছে। কিউবাতে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ৪০ শতাংশ জ্বালানি, ৪ শতাংশ সার এবং ২০ শতাংশ প্রানীজ খাদ্য মজুত রয়েছে। কিউবার হসপিটাল গুলোতেও ৬৮ শতাংশ ঔষুধের অভাব দেখা দিয়েছে। কিউবাতে গন পরিবহনের প্রধান ভরসা বাস, জ্বালানির অভাবে দেশটির ৮৮ শতাংশ বাস পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেছে। কমিউনিস্ট শাসনের করালগ্রাসে রীতিমতো বিধ্বস্ত কিউবার জনজীবন। একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী দেশকে সম্পূর্নভাবে ধ্বংস করতে কমিউনিজমের কোনও বিকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *