অফবিট

পুরনো ঝামেলা বাদ দিলেও বর্তমানে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে এখনও তিনটি অঞ্চলকে ঝামেলা রয়েছে

বিশ্ব রাজনীতিতে দুটি দেশের মধ্যে মজবুত কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। দুটি দেশ সামরিক ক্ষমতায় প্রায় সমান শক্তিশালী হলে এবং উভয় দেশের স্বার্থ একই হলে, দেশ দুটির মধ্যে একটি জোট তৈরি হয়। কিন্ত এটাও সত্য যে শক্তিধর দুটি দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক বেশীদিন টিকে থাকে না। যার সবচেয়ে ভালো উদাহারন রাশিয়া ও চীনের সম্পর্ক। আভ্যন্তরীন রাজনীতি, সামরিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিচারে স্বাভাবিক ভাবেই রাশিয়া ও চীনের মধ্যে একটি শক্তিশালী কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। রাশিয়া ও চীনের সমস্যা খানিকটা একই। এই দুই দেশের বিরুদ্ধেই আমেরিকা সহ পশ্চিমা বিশ্ব একটি ঘেরা বন্দি করার চেষ্টা করছে। যার জন্য রাশিয়া ও চীনের মধ্যে একটি জোট তৈরি হয়েছে। এছাড়াও অর্থনৈতিক ভাবেও দুই দেশ একে উপরের উপর নির্ভরশীল। রাশিয়াতে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার রয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার কাছে দক্ষ জনবল নেই। আবার চীনের এনার্জি দরকার। সুতরাং দুই দেশেরই একে অপরকে দরকার। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং জানিয়েছে তারা রাশিয়াকে সমর্থন করছে। যা দেখে মনে হবে চীন ও রাশিয়ার কুটনৈতিক সম্পর্ক বোধহয় খুবই মজবুত। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু ও চিরস্থায়ী শত্রু বলে কিছু হয়না। কোন দেশেই তার জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী বন্ধু ও শত্রু নির্ধারন করে। রাশিয়া ও চীনেরও ক্ষেত্রেও দুই দেশ সব বিষয়ে একমত নয়, বেশ কিছু বিরোধীতাও আছে।

চীন ও রাশিয়ার কুটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে যত ভালোই হোকনা কেন অতীতে এই দুই দেশের মধ্যে বিবাদ ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন হওয়ার আগে রাশিয়ায় জারের শাসন ছিল। রাশিয়ান সম্রাটকে জার বলা হত। এখনও বহু চাইনিজ মানুষ মনে করে অতীতে রাশিয়া পশ্চিমা শক্তি গুলোর সাথে যৌথভাবে চীনের সাথে জোর করে একাধিক অনৈতিক চুক্তি করেছিল। বিশেষ করে উনবিংশ শতকে রাশিয়ান সাম্রাট চীনের সাথে সীমানা, বানিজ্য নিয়ে এমন কিছু চুক্তি করে যা চাইনিজরা পচ্ছন্দ করেনি কিন্তু চীন সেসময় কিছু করতেও পারেনি কারন তখন চাইনিজ সাম্রাজ্য দুর্বল ছিল।

১৮৫৮ সালে চীনের সাথে রাশিয়ার আইগুনের চুক্তি এবং ১৮৬০ সালে পেকিং এর চুক্তি হয়। এই দুই চুক্তিকে নিয়ে চীন দাবি করে তাদের কাছ থেকে এক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জায়গা রাশিয়া নিয়ে নেয়। শুধু এই দুটি চুক্তিই নয় আরও এমন অনেক চুক্তি হয় সেসময়। ১৮৫১ সালে কুলজা চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বানিজ্যিক অধিকার পায় এবং বানিজ্যের শর্তও রাশিয়া ঠিক করত। ১৮৫৮ সালে আইগুনের চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া চীনের ছয় লাখ বর্গ কিলোমিটার জয়গা নিয়ে নেয়। ১৮৫৮ সালে তিয়েনস্টিনের চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া চীনের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে বানিজ্যের অধিকার পায়। ১৮৮১ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ চুক্তি অনুযায়ী চীন রাশিয়াকে নয় মিলিয়ন রূপোর রুবেল দিতে বাধ্য হয় এবং পশ্চিন চীনে বানিজ্যিক অধিকার পায় রাশিয়া। এছাড়াও এমন অনেক চুক্তি হয়, আসলে সেসময় রাশিয়ার ক্ষমতা এতটাই বেশী ছিল যে তার সামনে চীনের কিং রাজবংশ দুর্বল ছিল যার কারনে চীন নিরাপত্তার কারনে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হত। 

১৮৯০ সালের পর চীনের এক ব্যাক্তি সুন ইয়াত সেন স্বপ্ন দেখে একটি ঐক্যবদ্ধ চীনের। কারন চীনের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রাজবংশ রাজত্ব করত। সুন ইয়েত সেন পুরো চীনকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা নেন, কিন্তু তাঁর জীবিতকালে তা সম্ভব হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর চীনের দুজন শাসকের মধ্যে সরকার গঠন নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। কমিউনিস্ট দলের মাও জে দং এবং কোমেংতাং দলের চ্যাং কাই শেকের। সোভিয়েত ইউনিয়নের সেসময় প্রধান ছিল কমিউনিস্ট দলের জোসেফ স্টালিন। স্বাভাবিক ভাবেই জোসেফ স্টালিন মাও জে দংকে সহায়তা করে। মাও জে দং এর দল চ্যাং কাই শেককে পিছু হটিয়ে ফরমোসা দ্বীপে পাঠিয়ে দেয় এবং চীনে সরকার গঠন করে৷

ফরমোসা দ্বীপই আজ তাইওয়ান নামে পরিচিত। মাও জেদং ক্ষমতায় আসার কিছু বছরের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিবাদ শুরু হয় চীনের। মাও জেদং পুরোনো অনেক চুক্তি অস্বীকার করে। ১৯৫৬-১৯৬৬ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের এই দ্বন্দ্বকে বলা হয় সিনো সোভিয়েত বিবাদ। সোভিয়েত ইউনিয়ন এসময় তিব্বতকে সমর্থন করে যাতে চীন আরও ক্ষুব্ধ হয়। চীনের অর্থনীতি সেসময় ছিল কৃষিনির্ভর। কিন্তু চাষের জন্য জল দরকার যার ভান্ডার রয়েছে তিব্বতে, তাই চীন তিব্বত দখল করে নেয়। শুধু তিব্বতই নয় ইউনান প্রদেশ, ইনার মঙ্গোলিয়া, জিনজিয়াং প্রদেশ এসবই চীন জোর করে দখল করেছে। এসব প্রদেশে প্রায়ই চীনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। এসব প্রদেশ বাদ দিলে প্রকৃত চীনের আয়তন অনেক কম। মাও জে দং সবসময় ভয়ে থাকত সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি এসব প্রদেশের মানুষকে সমর্থন করে তাহলে বিদ্রোহ হতে পারে। 

অতীতের কথা বিবাদ বাদ দিলে বর্তমানে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে তিনটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বিবাদ তৈরি হয়েছে।

** প্রথমেই আসছে রাশিয়ার একদম সূদর পূর্বের অঞ্চল। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার রয়েছে কিন্তু রাশিয়ার সমস্যা হচ্ছে এখানে জনবসতি কম। যার কারনে রাশিয়া ১৯৮৮ সালে এখানে চীনের সাথে সীমান্ত খুলে দেয় এবং চীনকে বিনিয়োগ করতে বলে। এর ফলে অর্থনৈতিক ভাবে লাভ হয় রাশিয়ার কিন্তু ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের মানুষ চীনের বিরুদ্ধে চলে যায়। কারন এখানের ১৬ শতাংশ চাষের জমির মালিকই চীন। রাশিয়ার উপর ২০১৪ সাল থেকে অর্থেনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যা ইউক্রেন যুদ্ধের পর আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সুযোগ নিয়ে চীন এখান থেকে আন্তজার্তিক বাজারের মূল্যের তুলনায় অনেক কম মূল্যে খনিজ তেল কিনছে। যার কারনে সাধারন মানুষ ভাবছে চীন তাদের শোষন করছে এবং চীন তাদের এলাকা দখল করে নিচ্ছে। রাশিয়ার এই পূর্ব অঞ্চলে ভারতও বিনিয়োগের জন্য রাশিয়াকে জানিয়েছে।

** রাশিয়ার পূর্বের অঞ্চলের পরে আসছে মধ্য এশিয়ান অঞ্চল। মধ্য এশিয়ায় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ন দেশ হচ্ছে তাজাকিস্তান, কাজাখিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কিরঘিজস্তান। এই পাঁচটি দেশে রাশিয়ান প্রভাব রয়েছে কারন এগুলো আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এমনকী তালিবান আফগানিস্তান দখল করার পরও এসব দেশে আসতে সাহস পায়নি কারন রাশিয়ান সেনা এখানে মোতায়েন আছে। কিন্তু বিগত এক দশকে এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক সঙ্গী হয়ে উঠেছে চীন। ২০০০ সালে যেখানে রাশিয়ার মোট আমদানির চার ভাগের এক ভাগ আমদানি করত এই দেশ গুলোর সাথে চীন। সেখানে বর্তমানে এই দেশ গুলোর সাথে রাশিয়ার আমদানির দ্বিগুন আমদানি হয় চীনের। ২০২০ সালে ১৯.৩ বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয় চীনের এই পাঁচটি দেশের সাথে। বিশেষ করে তুর্কিমেনিস্থানের প্রায় পুরো বানিজ্যই চীনের সাথে হয়। অর্থাৎ ধীরে ধীরে এই পাঁচটি দেশে চীনের প্রভাব বাড়ছে যা রাশিয়া ভাল ভাবে নিচ্ছেনা।

** পৃথিবীর উত্তর মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি এলাকাকেই আর্কটিক অঞ্চল বলে। রাশিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো, গ্রিনল্যান্ড, কানাডা ও আমেরিকার আলাস্কা এই অঞ্চলের অন্তর্গত। রাশিয়ার মোট আয়তনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ অঞ্চলই আর্কটিক অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। এই অঞ্চলে খনিজ সম্পদের ভান্ডার রয়েছে। রাশিয়ার জন্য এই অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন যার কারনে রাশিয়া এখানে সেনার সংখ্যাও বাড়িয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে চীন এখানে আসার চেষ্টা করছে। চীন আর্কটিক অঞ্চলের মধ্যে থাকা কোন একটি দেশের জমি কেনার চেষ্টা করছে যাতে চীনও নিজেকে আর্কটিক অঞ্চলের দেশ বলে দাবি করতে পারে। কিন্তু আমেরিকা ও রাশিয়া উভয়েই এখানে চীনের বিরোধীতা করেছে। রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন নিজে এখানে চীনের বিরোধিতা করেছে। কিছু বছর আগে চীনের একটি সার্ভে জাহাজ এই অঞ্চলে এসেছিল, রাশিয়া তা আটকে দিয়েছিল। রাশিয়ার এক ভূবিজ্ঞানি চীনকে আর্কটিক অঞ্চল সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছিল, এরপর সরাসরি ওই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং রাশিয়া যে আর্কটিক অঞ্চলে চীনের বিরোধিতা করছে তা স্পষ্ট।

একটা সময় রাশিয়া চীনের তুলনায় শক্তিশালী ছিল কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি পুরো বিপরীত হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে চীন এখন রাশিয়া থেকে অনেক এগিয়ে।

আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী ২০২৭ এ চীনের অর্থনীতি হবে ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার এবং রাশিয়ার হবে ২ ট্রিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারনে রাশিয়ান অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ছে। চীন তেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বিশ্ব দ্রুত অপ্রচলিত শক্তির দিকে এগোচ্ছে সুতরাং অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়াকে দরকার পড়বেনা চীনের। চীন গবেষনা খাতেও রাশিয়ার তুলনায় ১৪ গুন বেশী খরচ করছে৷ সুতরাং ভবিষ্যতে চীনের সাথে রাশিয়ার কুটনৈতিক সম্পর্ক যে ভেঙে যাবে তা বলাই যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *