হর্ন অফ আফ্রিকার এতো গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পেছনে কি কারন রয়েছে?
সাধারনত দুই ব্যাক্তির মধ্যে ঝামেলা হলে মানুষ তা থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এর পুরো বিপরীত ঘটনা ঘটে। বিশ্ব রাজনীতিতে বলা হয় যদি দুই পক্ষের যুদ্ধ থেকে নিজের স্বার্থ পূরন করার কথা। ঠিক এমনই ব্যাপার রয়েছে জীবুতিকে ঘিরে। হর্ন অফ আফ্রিকাতে একটি ছোট দেশ হল জীবুতি। পূ্র্ব আফ্রিকার একটি বিস্তীর্ন অংশকে হর্ন অফ আফ্রিকা বলা হয় যা সোমালি পেনিনসুলা নামেও পরিচিত।
ইথিওপিয়া, ইরিট্রেরা, সোমালিয়া এবং জীবুতি এই চারটি দেশকে একত্রে হর্ন অফ আফ্রিকা বলা হয়। জীবুতির আয়তন খুবই ছোট। যেখানে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের আয়তন প্রায় ৪৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার সেখানে জীবুতির আয়তন প্রায় প্রায় ২৩,০০০ বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ জীবুতি আয়তনে হরিয়ানার অর্ধেক। জীবুতির জনসংখ্যা ৯,৫৭,০০০. এত ছেট আয়তন এবং এত কম জনসংখ্যা সত্বেও দেশটি বিশ্বের সুপার পাওয়ারদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। বিশ্বের প্রায় সমস্ত শক্তিশালী দেশগুলোর সবচেয়ে বেশী সামরিক ঘাঁটি এখানেই রয়েছে। জীবুতিতে আমেরিকা, চীন, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানি, স্পেন, ইটালির সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ভারত ও রাশিয়াও কুটনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জীবুতিতে সামরিক ঘাঁটি করার চেষ্টা করছে, সৌদি আরব খুব শীঘ্রই এখানে তাদের সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে চলেছে। সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকা ও চীনের মতোন দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সামরিক ঘাঁটি একই জায়গায় থাকা এটাই প্রমান করে জীবুতি কতটা গুরুত্বপূর্ন। ভৌগলিক অবস্থানই জীবুতিকে এতটা গুরুত্বপূর্ন করে তুলেছে। জীবুতির আশেপাশের দেশগুলোর আভ্যন্তরীন রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা বিশ্ব রাজনীতি এবং এনার্জি পরিবহন জীবুতিকে এতটা গুরুত্বপূর্ন করে তুলেছে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর কাছে।
হর্ন অফ আফ্রিকা এবং ইয়ামের মাঝে রয়েছে বাব এল মান্দাব যা লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরকে যুক্ত করে। বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই বাব এল মান্দাব কারন এখানে এনার্জির ভান্ডার রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন এনার্জি অর্থাৎ খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ এলাকা এই বাব এল মান্দাবের আশেপাশেই। এইসব দেশগুলো এনার্জি পরিবহন করে বাব এল মান্দাব হয়ে লোহিত সাগর দিয়ে সোজা সুয়েজ খাল হয়ে ভূমধ্যসাগর এবং ভারত মহাসাগরে। বাব এল মান্দাব কে বাদ দিয়ে আফ্রিকার নীচে দিয়েও এনার্জি পরিবহন করা সম্ভব কিন্তু এতে সময় অনেক বেশী লাগবে যার ফলে খরচও বেড়ে যাবে। সুতরাং অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই বাব এল মান্দাব। বাব এল মান্দাবের সবচেয়ে সংকীর্ন অংশ হচ্ছে ২৮ কিলোমিটার। যদি বাব এল মান্দাবকে কোন দেশ অবরুদ্ধ করে দেয় তাহলে এই অঞ্চলের বহু দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়বে। বাব এল মান্দাবের উপর সৌদি আরব, ইউএই, কুয়েত, কাতার, বাহরিন, ইরাক, ওমান, কুয়েত অর্থাৎ প্রায় গোটা মধ্য প্রাচ্যই নির্ভরশীল। সৌদি আরবের অবস্থান দেখে হয়ত মনে হতে পারে সৌদি আরব বাব এল মান্দাবকে বাদ দিয়ে সোজা লোহিত সাগর হয়ে সুয়েজ খাল দিয়ে এনার্জি পরিবহন করতে পারে কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে সৌদি আরবের বেশীরভাগ এনার্জি পাওয়া যায় পূর্ব ভাগে যার সবচেয়ে কাছে বাব এল মান্দাব। তবে সৌদি আরবের অবস্থান এমন সৌদি আরব চাইলে বাব এল মান্দাবকে এড়িয়ে পাইপলাইন বসিয়ে নিতে পারে সরাসরি। কিন্তু সেখানেও সমস্যা কারন সৌদি আরবের পাশেই রয়েছে ইয়ামেন যেখানে এই মহূর্তে গৃহযুদ্ধ চলছে। ইয়ামেনের রাষ্ট্রপতি ইসমাইল ওমর গুল্লাহকে ২০১৯ সালে পদ্মবিভূষন সম্মান দেয় ভারত। কারন তিনি ইয়ামেনের গৃহযুদ্ধের ফলে সেখানে থাকা ভারতীয়দের উদ্ধার করতে ভারতীয় নৌবাহিনীকে জীবুতিতে আসার অনুমতি দেন, যার ফলে ইয়ামেনে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পদ্মবিভূষন ভারতরত্নের পর ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান।
এই ইয়ামেনের হুথি বিদ্রোহীরা প্রায়ই সৌদি আরবের তেল শোধনাগার, বিমানবন্দরে মিসাইল হামলা করে। সৌদি আরবের প্রধান শত্রু আবার ইরান। এই ইরান হুথীদের সাহায্য করে। অর্থাৎ সৌদি আরব ইরান ও ইয়ামেন উভয়ের বিরুদ্ধেই ব্যাস্ত রয়েছে নিজেদের সুরক্ষা করতে। আবার ইরান যদি হরমুজ প্রণালীতে নেভাল মাইন বসিয়ে দেয় তাহলে ওমান উপসাগর হয়েও সৌদি আরবের এনার্জি পরিবহন বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সৌদি আরব চাইছে জীবুতিতে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে যাতে ইয়ামেন ও ইরানের থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়। তবে সৌদি আরব একা পারবে না যার জন্য আমেরিকার সাহায্য চেয়েছে সৌদি আরব। মধ্য প্রাচ্যে বিশ্বের মোট তেল ভান্ডারের অর্ধেক রয়েছে। এখানে বিশ্বের মোট তিন ভাগের এক ভাগ তেল শোধন হয়। বিশ্বের মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের চল্লিশ শতাংশ এখানেই পাওয়া যায়। এশিয়া থেকেও বানিজ্য করতে গেলে হরমুজ প্রনালী হয়ে এডেন উপসাগর, তারপর বাব এল মান্দাব হয়ে লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খাল হয়ে তবে ভূমধ্যসাগর এবং এখান থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বানিজ্য হয়। অর্থাৎ বাব এল মান্দাবকে একবার আটকে দিলে বিশ্বের পুরো অর্থব্যাবস্থা ভেঙে পড়বে কারন সামুদ্রিক বানিজ্যই বন্ধ হয়ে যাবে।
সৌদি আরবে বিশ্বের মোট তেলের ১৫ শতাংশ তৈরি হয়। সৌদি আরবের মোট জিডিপির ৪০ শতাংশই তেলের উপর নির্ভরশীল। সৌদির মোট তেলের ৭৫ শতাংশই আবার পূর্বাঞ্চল থেকে আসে যা বাব এল মান্দাবের পাশে। তাহলে যদি ইরান হরমুজ প্রনালীতে মাইন বসায় এবং ইয়ামেনের হুথিরা বাব এল মান্দাবে সৌদির এনার্জি পরিবহনে বাধা দেয় তাহলে সৌদি আরবের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে যার প্রভাব সৌদি আরবের রাজনীতিতে ব্যাপক ভাবে পড়বে। এমনিতেও ইরানের সাথে ইয়ামেনের হুথিদের মজবুত সম্পর্ক রয়েছে। একবার সৌদি আরব অস্থিতিশীল হলে গোটা ইউরোপ ও আমেরিকা প্রায় এনার্জি সংকটে পড়ে যাবে। সেজন্য সৌদি আরব চাইছে তারা যদি জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে পারে তাহলে আমেরিকা ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিদের সাথে মিলে হুথিদের নিয়ন্ত্রন করতে পারবে।
চীন নিজেও এনার্জি পরিবহন করে এই বাব এল মান্দাব, হরমুজ প্রনালী, পারস্য উপসাগর এবং মালাক্কা প্রনালী হয়ে। সেকারনে চীন নিজেও জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে এই অঞ্চলের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। যুদ্ধের আগে রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস কিনত ইউরোপীয়ান দেশগুলো। কিন্তু ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধের পর রাশিয়ার উপর প্রচুর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ইউরোপীয়ান দেশগুলো রাশিয়ার বদলে কাতার থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস কিনছে। যদি কখনও রাশিয়া বাব এল মান্দাব বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করে, তাহলেও সেক্ষেত্রে জিবুতিতে বিভিন্ন দেশগুলোর সামরিক ঘাঁটি থাকা গুরুত্বপূর্ন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কি হতে পারে তার উপর বিশ্লেষন করেই পরবর্তী পদক্ষেপ সাথে সাথে ঠিক করা হয়। আফ্রিকাতে একমাত্র জিবুতে আমেরিকার স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এখান থেকে আমেরিকা ইয়ামেনে হুথিদের উপর, সোমালিয়াতে ইসলামিক স্টেট বা আইএস আইএসের উপর অপারেশন করে। সুতরাং জিবুতি সন্ত্রাস দমনের কেন্দ্র হিসাবেও গুরুত্বপূর্ন। বাব এল মান্দাবের আশেপাশে দেশগুলো বিশেষ করে ইয়ামেন, সোমালিয়া, অ্যারিট্রিয়া অস্থিতিশীল। এসব দেশে রীতিমতো সন্ত্রাসী কাজকর্ম ও স্বৈরতন্ত্র চলে। অ্যারিট্রিয়াতে সেই ১৯৯০ এর দশক থেকে স্বৈরতন্ত্র চলে। সোমালিয়াতে আইএস আইএসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া সোমালিয়ান জলদস্যুদের কথা গোটা বিশ্ব জানে। প্রায়ই এখানে পন্যবাহী জাহাজের উপর আক্রমন করে সোমালিয়ান জলদস্যুরা৷ সুতরাং এইসব দেশগুলোর কারনে বাব এল মান্দাবে সমস্যা তৈরি হতে পারে যার কারনে জিবুতে এতগুলো দেশের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। জিবুতি একটি এমনই দেশ যেখান থেকে আফ্রিকা, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল, ইউরোপ, আমেরিকা সব দিকে বানিজ্য করা যায়। যার কারনে পৃথিবীর প্রায় সব সুপার পাওয়ারই এখানে উপস্থিত।