অফবিট

হিটলারকে বোকা বানাতে নকল ট্রাক, গাড়ি! অপারেশন ফর্টিটিউড

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালে, একবছর পর অর্থাৎ ১৯৪০ সালে জার্মানি ফ্রান্স দখল করে নেয়। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় আমেরিকা। আমেরিকান সেনারা চাইছিলো ফ্রান্সে জার্মান সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন করতে। কিন্ত আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জানতো সেই মহূর্তে আমেরিকান সেনাবাহিনী জার্মানদের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নেয় সেজন্য আমেরিকার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের অভিজ্ঞতার জন্য উত্তর আফ্রিকা পাঠানো হয়। সেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে যৌথভাবে আমেরিকার সেনাবাহিনী জার্মান নাজি সেনাকে পরাস্ত করে। এরপর মিত্রশক্তি ইতালি অভিযান করে জার্মানির বিরুদ্ধে কিন্ত ইতালি অভিযান প্রথমদিকে ততটা সফল হয়নি যার কারনে মিত্রশক্তি সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক ফ্রান্সকে জার্মানির হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। হিটলার জানতো মিত্রশক্তি কখনও না কখনও ফ্রান্স আক্রমন করবেই, সে কারনে হিটলার ফ্রান্সের সমস্ত উপকূলে জার্মান পাহাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্ত কোথায় এবং কখন ফ্রান্সে অভিযান হবে সেটা হিটলারও জনতোনা৷ ফ্রান্স অভিযানের জন্য মিত্রশক্তি এমনই এক পরিকল্পনা করেছিল যাতে পুরো নাজি জার্মান সেনা কিছু বুঝতেও পারেনি।

১৯৪২ সাল আসতে আসতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি প্রায় গোটা ইউরোপ দখল করে নেয়। এরপর জার্মানি পূর্ব প্রান্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে লড়াই শুরু করে, জার্মানির পশ্চিম দিকে একমাত্র ব্রিটেন জার্মানির থেকে সুরক্ষিত ছিল কারন ব্রিটেন ইংলিশ চ্যানেল দ্বারা ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে সম্পূর্ন আলাদা ছিল। জার্মানি জানতো ফ্রান্সে কখনও আক্রমন হলে পশ্চিম উপকূল দিয়েই হবে কারন বাকী ইউরোপের ভূভাগে জার্মান আধিপত্য ছিল। এই জন্য অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির পশ্চিম উপকূলে নরওয়ে থেকে স্পেনের সীমানা পর্যন্ত একটি মজবুত জার্মান প্রতিরক্ষা বাহিনী আটলান্টিক দেওয়াল তৈরি করেছিল। ভারী মেশিনগান, আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক সমস্ত মজুত ছিল এই জার্মান বাহিনীর কাছে। আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় জাপানের আক্রমনের কারনে, আমেরিকান জেনারেলরা চাইছিলো সরাসরি জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কিন্তু আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের খুব ভালো বন্ধু হওয়ায় আমেরিকা তার সেনাবাহিনী উত্তর আফ্রিকা পাঠায় প্রথমে, সেখান থেকে সিসিলি হয়ে রোম তারপর ইতালির আরও অভ্যন্তরে যেতে শুরু করে আমেরিকান সেনা। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি জোসেফ স্তালিনের রেড আর্মি নাজি সেনার সাথে লড়াইয়ে পীছু হটতে শুরু করে যার কারনে স্তালিন চাইছিলো পশ্চিম দিক দিয়ে আমেরিকা ও ব্রিটেন জার্মানি আক্রমন করুক। কিন্তু রুজভেল্ট ও চার্চিল জানতো সেই মহূর্তে আক্রমন সম্ভব নয়। ১৯৪৩ সালেও মিত্রপক্ষ কোনওভাবেই ফ্রান্স অভিযানের সুযোগ পাচ্ছিলনা৷ অবশেষে ১৯৪৩ সালের শেষের দিকে ইরানের তেহরানে জোসেফ স্তালিন, রুজভেল্ট এবং উইনস্টন চার্চিল একটি বৈঠক করে, যেখানে স্তালিন জানায় তার পক্ষে আর নাজি সেনাকে আটকানো সম্ভব নয় এবার যেভাবেই জার্মানির পশ্চিমে যুদ্ধ শুরু করতেই হবে, এবার রুজভেল্ট ও চার্চিলও সম্মত হয় স্তালিনের প্রস্তাবে। তেহরান সম্মলনে ঠিক হয় ১৯৪৪ সালের জুন মাসে ফ্রান্সে অভিযান শুরু করবে মিত্রশক্তি এবং এই অপারেশনের কম্যান্ডার নিযুক্ত করা হয় ডোয়াইট ডি আইসেনহাওয়ারকে, যিনি পরে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হন। ফ্রান্স অভিযানের সময় ঠিক করা হয়ে যায় কিন্ত ফ্রান্সে অভিযান করা হবে কীভাবে তা নিয়ে সমস্যা দেখা যায় কারন নরওয়ে থেকে স্পেনের সীমানা পর্যন্ত রয়েছে আটলান্টিক দেওয়াল যা ভাঙা খুবই মুস্কিল।

ব্রিটেনের ডোভার বন্দর থেকে ইংলিশ চ্যানেল হয়ে ফ্রান্সের ক্যালাইস বন্দর সবচেয়ে কাছে, জার্মান সেনা এখানে সম্ভাব্য মিত্রশক্তির আক্রমনের অনুমান করেছিল যার কারনে এখানে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছিল, এটা মিত্রশক্তিও জানতো। সুতরাং ক্যালাইস হয়ে অভিযান কোনও ভাবেই সম্ভব নয় তা বুঝতে পারে মিত্রশক্তি। এরকম অবস্থায় ফ্রান্সে আক্রমনের জন্য এবং জার্মান সেনাবাহিনীকে বোকা বানানোর জন্য অপারেশন বডিগার্ডের পরিকল্পনা করা হয়। এই অপারেশন বডিগার্ডের অনেক ভাগ ছিল যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল অপারেশন ফর্টিটিউড। এই অপারেশনের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল জার্মান সেনাবাহিনীকে কোথায় অভিযান করা হবে তার ব্যাপারে আগে থেকেই ভুল তথ্য দিয়ে বোকা বানানো, যাতে জার্মান সেনা ভুল দিকে পাহাড়া দেয় এবং ততক্ষনে অন্যদিক দিয়ে আক্রমন করা হবে। দুটি ভাগে অপারেশন ফর্টিটিউডকে ভাগ করা হয় ফর্টিটিউড উত্তর এবং ফর্টিটিউড দক্ষিন। 

ফর্টিটিউড উত্তরে জার্মানিকে বিশ্বাস করানো হয় মিত্রশক্তি স্কটল্যান্ড থেকে নরওয়ে হয়ে ফ্রান্সে অভিযান করবে এবং ফর্টিটিউড দক্ষিনে জার্মান সেনাকে বোঝানো হয় ব্রিটেনের দক্ষিম পশ্চিম দিক দিয়ে ফ্রান্সের ক্যালাইস বন্দরে নামবে মিত্রশক্তি অ্যাম্ফিবিয়াস জাহাজে করে, বিশেষ করে ফর্টিটিউড দক্ষিনের পরিকল্পনায় বিশেষ জোর দেওয়া হয় কারন মিত্রশক্তি জানতো জার্মানির সবচেয়ে বেশী বিশ্বাস ছিল ক্যালাইসেই মিত্রশক্তি আসবে। মিত্রশক্তি তাদের গুপ্তচরের মাধ্যমে জার্মানিকে পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে দেয় যাদের জার্মানি নিজেদের গুপ্তচর বলে মনে করতো। এই দুই দিকের কোনও দিকেই আক্রমন করার পরিকল্পনা ছিলনা মিত্রশক্তির, আসল পরিকল্পনা হয়েছিল ব্রিটেনের দক্ষিন পূর্ব দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে ফ্রান্সের নরম্যান্ডি উপকূলে ল্যান্ড করার। এই নরম্যান্ডিতে অপারেশনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় ব্রিটিশ জেনারেল বার্নাড মন্টগোমারিকে। বার্নাড ল মন্টগোমারি এর আগে উত্তর আফ্রিকা অভিযানে, সিসিলি অভিযানে এবং ইতালি অভিযানে সাফল্য এনে দিয়েছিল যার কারনে এত গুরুত্বপূর্ন অপারেশনের দায়িত্ব তাকেই দেওয়া হয়েছিল। 

ফর্টিটিউড দক্ষিনের পরিকল্পনাকে জার্মানিকে আরও বিশ্বাস করানোর জন্য ব্রিটেনের দক্ষিন পূর্ব উপকূলে একটি নকল সেনাবাহিনী তৈরি করা হয় যার নাম দেওয়া হয় ফিউস্যাগ বা ফার্স্ট ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি গ্রুপ। মিত্রশক্তি রটিয়ে দেয় এই ফিউস্যাগে দেড় লাখ সেনা রয়েছে, ট্যাঙ্ক রয়েছে আরও শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে এবং এই সেনাবাহিনীর প্রধান কম্যান্ডার জেনারেল জর্জ প্যাটন। আদতে এখানে সত্যিকারের কোন সেনাই ছিলনা পুরোটা ছিল মিত্রশক্তির একটা পরিকল্পনা জার্মানিকে বোকা বানানোর। উত্তর আফ্রিকা অভিযান এবং সিসিলিতে অভিযানের সময় থেকেই জার্মানরা জেনারেল প্যাটনকে চিনত তাই ফিউস্যাগের নেতা হিসাবে জেনারেল প্যাটনের নাম আসায় সহজেই বিশ্বাস করে নেয় জার্মানরা। মিত্রশক্তি শুধু নকল সেনাবাহিনীই তৈরি করেনি, নকল যুদ্ধ উপকরনও তৈরি করেছিল। ব্রিটেনে ফ্লোকস্টোন বন্দরে ২০০ এর অধিক ল্যান্ডিং ক্রাফট রাখা হয়েছিল কিন্তু এগুলো নকল ছিল, কাঠ এবং উপরে কাপড় দিয়ে এগুলো তৈরি করা হয়েছিল, রবার ও কাপড় দিয়ে নকল ট্যাঙ্কও তৈরি করা হয়েছিল এমনকী ট্যাঙ্ক যাবার নকল রাস্তাও তৈরি করা হয়েছিল, নকল ট্রাক, গাড়ি সমস্ত কিছু তৈরি করা হয়েছিল। এসমস্ত কিছু এতটাই দক্ষভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে উপর থেকে জার্মান গুপ্তচর বিমান যখন ছবি তুলতো তারা বুঝতেও পারেনি, জার্মানরা এসব ছবি দেখে ভাবে সত্যিকারেই বিশাল সেনাবাহিনী সজ্জিত হয়েছে ফ্রান্স অভিযানের জন্য। এভাবে জার্মান বায়ুসেনাকে বোকা বানানো হয়। কিন্ত সেসময় ইংল্যান্ডে প্রচুর জার্মান গুপ্তচরও ছিল, তাদের বোকা বানানোর জন্য অন্য পরিকল্পনা করা হয়। 

জেনারেল প্যাটন বেশ কিছু লোককে নিযুক্ত করে যাদের মিত্রশক্তির সেনাবাহিনীর পোষাক দেওয়া হয় এবং নকল ব্যাজ দেওয়া হয়। এইসমস্ত লোকেরা বিভিন্ন বার, হোটেলে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ক্যালাইসে আক্রমনের ব্যাপারেই আলোচনা করত যার কারনে আশেপাশে থাকা জার্মান গুপ্তচরদের সত্যিকারেই মনে হতে থাকে হয়ত ক্যালাইসেই অভিযান হবে। এছাড়া সেসময় মিত্রশক্তির কাছে বন্দী ছিল এক জার্মান জেনারেল হ্যান্স গ্রেমার যাকে উত্তর আফ্রিকাতে বন্দী করেছিল মিত্রশক্তি। হ্যান্স গ্রেমারের শরীর ক্রমশ খারাপ হওয়ায় তাকে জার্মানি পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এখানেও প্যাটানের একটা পরিকল্পনা ছিল। যে রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে প্যাটানকে বন্দরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেই রাস্তায় এমন কিছু চিহ্ন ছিল যা দেখে হ্যান্স গ্রেমার ভাবে এটা ডোভার বন্দরের এলাকা এখান থেকে ক্যলাইস খুব কাছে, গাড়িতে মিত্রশক্তির সেনারাও ক্যালইসের কথা আলোচনা করছিলো নিজেদের মধ্যে। তাছাড়া বন্দরের কাছে বিশাল সেনাবাহিনীও লক্ষ্য করে হ্যান্স গ্রেমার যা দেখে হ্যান্স গ্রেমার সত্যিকারেই ভাবে ক্যলাইসে আক্রমন হবে, এই কথা সে ফিরে গিয়ে জার্মান জেনারেল এরউইন রোমেলকে জানায় যাকে ফ্রান্স রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিল হিটলার। জেনারেল প্যাটন যেটা চাইছিলো ঠিক সেটাই হয় আসলে হ্যান্স গ্রেমারকে যেখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেটা ডোভার বন্দর ছিলনা কিন্তু রাস্তায় এমন চিহ্ন ছিল যাতে সে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। নরম্যান্ডি আক্রমন যেখান দিয়ে হবে সেখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হ্যান্স গ্রেমারকে যেখানে সত্যি বিশাল সেনাবাহিনী ছিল। জেনারেল প্যাটনের লক্ষ্য ছিল হ্যান্স গ্রেমারের মাথায় ক্যালাইস আক্রমনের পরিকল্পনা সত্যি বলে ঢুকিয়ে দেওয়া যাতে সে ফিরে গিয়ে জার্মান কম্যান্ডোদের জানাতে পারে। জেনারেল প্যাটন তার উদ্দেশ্যে সফল হয়। 

অপারেশন ফর্টিটিউডে মিত্রশক্তির গুপ্তচরদের সবচেয়ে বেশী ভূমিকা ছিল। এদের মধ্যে অনেকে ডবল এজেন্ট ছিল যারা জার্মানি এবং মিত্রশক্তি উভয়পক্ষের হয়েই কাজ করতো। অপারেশন ফর্টিটিউড এর উদ্দেশ্য ছিল জার্মান সেনাবাহিনীকে ক্যালইসে ব্যস্ত রাখা অন্তত দুই সপ্তাহ যাতে নরম্যান্ডিতে যে মিত্রশক্তি ল্যান্ড করবে তা জানতে না পারা কিন্ত অপারেশন ফর্টিটিউড এতটাই সফল হয় যে নরম্যান্ডিতে মিত্রশক্তির সেনাবাহিনী ল্যান্ড করার ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত জার্মান সেনাবাহিনী বুঝতেই পারেনি। যখন হিটলার নরম্যান্ডির ব্যাপারে জানতে পারলো তখন জার্মানির আর বিশেষ কিছু করার ছিলনা, ফ্রান্স জার্মানির হাত থেকে বেড়িয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *