পাঙ্খাওয়ালা, গোয়ালার মতো বাংলাদেশ থেকে যে পেশা গুলি হারিয়ে যাচ্ছে
সভ্যতা যত উন্নত হচ্ছে ততই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিরও আবির্ভাব ঘটছে। যার ফলে পৃথিবীর থেকে হারিয়ে গেছে এমন অনেক পেশা। এক সময় যে সমস্ত পেশা বহুল প্রচলিত ছিল সমাজে তার অস্তিত্ব বর্তমান দিনে আর খুঁজে পাওয়া যায়। ঠিক এই একই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় ভারতবর্ষের পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। প্রযুক্তির উন্নয়ন কিংবা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এই শহর থেকে হারিয়েছে বহু পেশা। সমাজের থেকে হারিয়ে যাওয়া এই রকমই কয়েকটি পেশা হল –
১. ভিস্তিওয়ালা
১৮৭৮ সালের আগে ঢাকা শহরে খাবার জলের উৎস ছিল পুকুর, কুয়া, নদী। কিন্তু এই সময় থেকে ঢাকা শহরে চালু হয় আধুনিক সুপেয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা। কয়েকজন মানুষ টাকার বিনিময়ে মশক (চামড়ার ব্যাগ)-এ করে ঢাকা শহরের বাড়িতে বাড়িতে খাবার জল পৌঁছে দিত। আর এই কাজে নিযুক্ত মানুষদের বলা হত ‘ভিস্তিওয়ালা’ বা ‘সুক্কা’। তৎকালীন সময়ে ঢাকার যে এলাকায় ভিস্তিওয়ালা বা সুক্কা-রা বসবাস করত সেটি ‘সিক্কাটুলি’ নামে পরিচিত ছিল।
২. বাতিওয়ালা
বর্তমানদিনে ঢাকায় বিলুপ্ত পেশাজীবীর মধ্যে অন্যতম হল বাতিওয়ালা। আগেকার সময়ে রাত হলেই ঢাকা ঘুটঘুটে এক অন্ধকার শহরে পরিনত হত। ঢাকার এই অন্ধকার দূর করার জন্য ১৮৭৭ সালে শুরু হয় ঢাকার রাস্তার পাশে কেরোসিনের বাতি জ্বালানো। এইভাবে উদ্ভব হয় ঢাকা শহরে এক নতুন পেশাদার শ্রেণির। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় বাতিওয়ালারা মই বেয়ে ল্যাম্প পোস্টে উঠে তাদের সাথে আনা কেরোসিন দিয়ে সেগুলোতে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেত। তবে এই পেশাটি ১৯৫২-১৯৫৩ সালের পর উঠে যায়। ঢাকার শেষ বাতিওয়ালার ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন রাউত।
৩.পাঙ্খাওয়ালা
হাতপাখা নির্ভর এই পেশাজীবীদের চল ছিল রাজা-জমিদারদের আমলে। বর্তমান সমাজে এই পেশাটির কোনো অস্তিত্ব নেই, অনেক বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বড় আকারের তালপাখার নাম ছিল আরানি এবং বড় আকারের তালপাখার নাম ছিল আরবাকি।
৪.গোয়ালা
১৮৩০ সালের আদমশুমারি অনুসারে, ঢাকায় ৩৮২ ঘর হিন্দু গোয়ালা বাস করত। এরা গরু লালন-পালন করত এবং গরুর দুধ শহরবাসীর কাছে সরবরাহ করত। দুধ সরবরাহ করার পাশাপাশি তারা দুধ দিয়ে ঘি, দই,ছানা তৈরি করত। সেই সময় ঢাকায় মিষ্টি তৈরি করার জন্য গোয়ালাদের উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল ছিল। এক সময় যে শহরে এই পেশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ছিল আজ সেই শহর থেকে হারিয়ে গেছে এই পেশা।
৫.সাপুড়ে
মোগল ঢাকা থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত ঢাকা ছিল জলা-জঙ্গলপূর্ণ এলাকা। তাই সেখানে সাপ থাকাটাও খুবই স্বাভবিক। ঠিক সেইরকমই সেই সময় ছিল সাপুড়েও। বর্তমান সময়ে এই পেশা সম্পূর্নরূপে বিলুপ্তি না হলেও অনেকাংশই বিলুপ্তি হয়ে গিয়েছে। যেমন মূল শহর থেকে এই পেশা হারিয়ে গেছে। তবে মাঝে মাঝে দেখা যায় সাপুড়েদের।
৬.ধুনারি
আগেকার সময় এই পেশাটি যেভাবে প্রচলিত ছিল বর্তমান দিনে সেই চলটা উঠে গেছে। সেই সময় তুলা ধুনা করা পেশাজীবীরা গ্রামে-শহরে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তুলা ধুনা এবং লেপ, বালিশ তোষক ইত্যাদি প্রস্তুত করার কাজ নিত। কিন্তু বর্তমানে এই পেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঢাকা শহরে। তবে তুলা ধুনা একটি অতি প্রাচীন পেশাটি সম্পূর্নভাবে বিলুপ্ত হয়নি কারণ যারা এই ধরনের কাজ করত তারা এখন লেপ-তোষক ইত্যাদি তৈরির বড় বড় দোকানে শ্রমিকের কাজ করে থাকে। ঢাকা শহরে যে সমস্ত ধুনারিরা তারা বিহার থেকে এসেছিল বলে জানা যায়।
৭.নৈচাবন্দ ও টিকাওয়ালা
একসময় ঢাকা শহরে উপমহাদেশের বৃহত্তম হুঁকা বানানোর শিল্পের বহুল প্রচলন ছিল। যারা এই হুঁকার নল তৈরি করতেন তাদেরকে বলা হতো নৈচাবন্দ। ঢাকার নৈচাবন্দরা মূলত আসতো সিলেট থেকে। নৈচা তৈরি করা হত শিশু, জাম,জারুল,শিমুল কাঠ দিয়ে। তবে বর্তমান দিনে হুঁকা নামের ধূমপানের বস্তুটি হারিয়ে গেছে। হুঁকার জায়গায় ঢাকা শহরের মানুষ বেছে নিয়েছে সিগারেটকে।
বর্তমান দিনে ঢাকার যে টিকাটুলি এলাকা তা আগে ছিল মূলত হুঁকার টিকাদারদের আবাসস্থল। টিকাটুলির এই টিকাদাররা অতিসাধারণ টিকিয়াকে একটি অসাধারণ শিল্পে পরিণত করেছিল। এই টিকাদারদের তৈরি করা টিকিয়াগুলি ছিল অতুলনীয়। এগুলো এতো হালকা এবং দাহ্য ছিল যে, দিয়াশলাইয়ের একটা শলা দিয়েই অনেকগুলো টিকিয়াতে আগুন ধরানো যেত।
ঢাকার নৈচার কারিগররা যেখানে বসবাস করতেন সেটি নৈচাবন্দটোলা নামে পরিচিত ছিল। যার অবস্থান বর্তমানে সদরঘাটের কাছে ছিল এবং পরে তা বিলীন হয়ে যায় বুড়িগঙ্গার বক্ষে। এক সময় ঢাকায় বহুল ব্যবহৃত করা হুকোর চল উঠে গেছে যেই জায়গায় চলে এসেছে সস্তা ও সহজে বহনযোগ্য বিড়ি। যার ফলে ধীরে ধীরে ঢাকা থেকে সম্পূর্ন বিলুপ্ত হয়ে যায় নৈচা তৈরির কারিগররা।