ইরানী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্স
সালটা ১৯৭৮, ইরানে শাহ মহম্মদ রেজার শাসন। এই সময় ইরান প্রাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছিল কিন্তু সাথে সাথে দেশে ঘটে চলা একের পর এক দূর্নীতির বিরুদ্ধেও সরব হতে শুরু করেছিল। শাহ মহম্মদ রেজার এই পশ্চিমী প্রীতি মেনে নিতে পারছিলনা ইরানেরই বেশ কিছু মানুষ। ফলে শাহ মহম্মদ রেজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের হার বাড়তে শুরু করে। কয়েকলাখ মানুষ বিদ্রোহ শুরু করে এবং ক্রমশ হিংসা বাড়তে শুরু করে এই বিদ্রোহ। প্রায় ষাট হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই বিদ্রোহে। এই বিদ্রোহের নাম ইরানিয়ান রেভোলিউশন যার নেতা ছিল রাহোল্লাহ খোমেনী। এই বিদ্রোহ ইরানের পহলভী বংশের শাসক শাহ মহম্মদ রেজাকে ফেব্রুয়ারী ১৯৭৯ তে ক্ষমতাচ্যুত করে থামে এবং ইরানের নতুন শাসক হয় রাহোল্লাহ খোমেনী যে ইরান থেকে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে সরিয়ে দেয়।
ইরানের হওয়া এই বিদ্রোহের প্রভাব সুদূর লন্ডনেও ছড়িয়ে পড়ে। ৩০ এপ্রিল, ১৯৮০ লন্ডনের দক্ষিন ক্যানিংস্টনে প্রতিদিনের মতোই ব্যাস্ত ইরানের দূতাবাস। আচমকা ছয়জন লোক বন্দুক হাতে দূতাবাসে ঢুকে পড়ে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দূতাবাসের থাকা ২৬ জনকে বন্দী করে ফেলে, তবে তিনজন লোক কোনও রকমে পালিয়ে যায়। এই ছয়জন ব্যাক্তি ডেমোক্রেটিক রেভোলিউশোনারি ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অফ আর্বিস্তানের সদস্য ছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় অপারেশন নিমরোড। কি করে ব্রিটিশ সরকার এই ২৬ জন বন্দীকে বাঁচালো? এবং অপারেশন নিমরোড সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
৩১ মার্চ, ১৯৮০ ওয়েন আলি মহম্মদ নামে এক ব্যাক্তি ইরাকি পাসপোর্ট নিয়ে লন্ডনে আসে। লন্ডনে পৌঁছেই পশ্চিম লন্ডনে একটি বাড়ি ভাড়া নেয় সে। ওয়েন আলি মহম্মদ এর বয়স ২৭ বছর, ইরানের কুজিস্তানের বাসিন্দা ছিল। তার সাথে আরও তিনজন লোক এসেছিল। ওয়েন আলি মহম্মদ ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে রাজনীতিতে যোগ দেয়। ওয়েন আলি ইরানের ৩১ টি প্রদেশের মধ্যে একটি কুজিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে রাজনীতি শুরু করেছিল যার জন্য ইরানের পুলিশ তাকে ও তার সঙ্গী সাথীদের গ্রেফতার করে এবং তাদের উপর প্রচুর অত্যাচার করা হয়, যার কারন ওয়েন আলি ইরানের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। কুজিস্তান প্রদেশে স্বল্প সংখ্যায় আরবী মানুষরা বাস করত, এরাই আলাদা দেশ চাইছিল। এই এলাকায় প্রচুর তেল পাওয়া যায়, যার জন্য এই এলাকা ইরানের জিডিপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। ওয়েন আলিকে গ্রেফতার করেছিল সাবাক নামে এক গোপন পুলিশ সংস্থা ইরানের, যারা শাহ মহম্মদ রেজার হয়ে কাজ করতো। একমাস ধরে লন্ডনে সমস্ত পরিকল্পনা করে ৩০ এপ্রিল সকাল সাড়ে নটার সময় ওয়েন আলি বাড়ির মালিককে চাবি ফেরত দিয়ে বলে তারা এক সপ্তাহের জন্য ব্রিস্টল যাচ্ছে সেখান থেকে তারা ইরাক ফিরে যাবে। এর দুই ঘন্টা পর ওয়ান আলি ও তার পাঁচজন সদস্য ইরানের দূতাবাসে পৌঁছে সবাইকে বন্দী করে ফেলে। বন্দী সবাইকে দূতাবাসের দ্বিতীয় তলায় রেখে পুরো বাড়িকে তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে তারা। কিছুক্ষনের মধ্যেই ব্রিটশ পুলিশ পুরো এলাকাকে ঘিরে ফেলে। একজন সন্ত্রাসী দূতাবাসের জানালা দিয়ে পুলিশের দিকে গুলি চালায় ফলে পুলিশ বাধ্য হয় পিছিয়ে আসতে। ওয়েন আলি ও তার সঙ্গীরা পুলিশকে তাদের দাবী জানায়, তাদের বক্তব্য ছিল কুজিস্তানকে ইরান থেকে আলাদা করতে হবে সেখানে কুজিস্তান সরকারের শাসন হবে এবং সেখানকার জেলে বন্দি থাকা তাদের ৯১ জন সাথীকে মুক্তি দিতে হবে। সন্ত্রাসীরা এটাও জানায় তাদের ইংল্যান্ড থেকে নিরাপদে বেরোনোর পথ করে দিতে হবে। এর জন্য তারা ব্রিটিশ সরকারকে ১ মে দুপুর অবধি সময় দেয় এর মধ্যে তাদের দাবী পূরোন না হলে তারা গোটা বাড়ি বোম্ব দিয়ে উড়িয়ে দেবে সাথে সব বন্দীকে মেরে ফেলবে এটাও জানায়। এদিকে ইরানের সরকার এই ঘটনার পুরো দায় ব্রিটিশ ও আমেরিকান সরকারের উপর চাপিয়ে দেয় এবং তারা ব্রিটেনের সাথে কোনওরকম সহযোগিতায় রাজি হয়না। সন্ত্রাসীরা বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ফ্রেডা নামে এক প্রেগন্যান্ট মহিলাকে ছেড়ে দেয়। ওয়েন আলি ও তার সঙ্গী সাথীদের প্রশিক্ষন দিয়েছিল ইরাক, ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য কারন সেবছরই ইরাক ইরান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।
ব্রিটিশ ক্যাবিনেট বৈঠকে এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এর দায়িত্ব দেওয়া হয় স্যাসের হাতে। স্যাস বা স্পেশাল এয়ার সার্ভিস ব্রিটিশ সেনাবাহিনীরই একটি ভাগ, যারা ব্রিটেনের স্পেশাল ফোর্সের অন্তর্গত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। ৩০ এপ্রিল গভীর রাতেই স্যাসের দুটি দল হেলিকপ্টারে করে ইরানিয়ান দূতাবাসের কাছে একটি বাড়িতে আসে এবং সম্ভাব্য অপারেশনের পরিকল্পনা করতে থাকে। ১ মে সকালে ওয়েন আলি বিবিসির সাথে যোগাযোগ করে আশ্বাস দেয় তাদের ইরানিয়ান ব্যাতীত কোন ব্যাক্তির সাথে শত্রুতা নেই, সেই দিনই বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ক্রিস নামে এক ব্যাক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয় সে বিবিসিরই লোক ছিল কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদিকে সেইদিন রাতে ইরানিয়ান দূতাবাসের পাশের দেওয়ালেই ইথিওপিয়ান দূতাবাসের দেয়ালে ছিদ্র করে ব্রিটিশ পুলিশ যাতে সারভিল্যান্স ডিভাইস ইনস্টল করা যায় ইরানিয়ান দূতাবাসের ভিতরে। ২ এপ্রিল ওয়েন আলি ব্রিটিশ পুলিশকে নির্দেশ দেয় কিছু আরবিক দেশের সাথে কথা বলতে যাতে তারা নিরাপদে সেখানে যেতে পারে। ব্রিটিশ সরকার লেবানন, জর্ডন, সিরিয়া, কাতার, কুয়েতের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করে। এদিকে স্যাস ততক্ষনে গোটা দূতাবাসের পুরো নকশা খুঁটিয়ে দেখে দূতাবাসের সামনের দরজা স্টিলের এবং নীচের তলার জানলা গুলো বুলেটপ্রুফ। এই দিক দিয়েই দূতাবাসে ঢোকার পরিকল্পনা করে তারা। ৩ মে, ওয়েন আলি আবারও ব্রিটিশ পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে যত দ্রুত সম্ভব তাদের দাবী পূরন করার কথা বলে, বিবিসি ওয়েনের দাবী আবারও সম্প্রচার করে। ৪ মে, ব্রিটিশ সরকারের সাথে আরব দেশ গুলোর প্রতিনিধিদের সাথে জরুরী বৈঠক হয় যাতে আরব প্রতিনিধিরা জানায় তারা ওয়েন ও তার সাথীদের নিরাপদে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিতে প্রস্তত কিন্তু ব্রিটিশ সরকার জানায় তারা কোনওমতেই কোন সন্ত্রাসীকে ফিরতে দেবেনা। এদিকে স্যাস তাদের অপারেশনের পূর্নাঙ্গ পরিকল্পনা করে ফেলেছিল ততক্ষনে। যতদিন যেতে থাকে ওয়েন ও সাথী দের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে থাকে। ৫ মে সকালে ওয়েন আলি পুলিশকে জানায় আগামী ৪৫ মিনিটের মধ্যে তার দাবী পূরন করা না হলে সে একজন কে হত্যা করবে। ঠিক দূপুর ১ঃ৪৫ নাগাদ আব্বাস নামে এক বন্দীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পরই স্যাসকে অপারেশন শুরু করার নির্দেশ দেয় ব্রিটিশ সরকার। সন্ধ্যা ৭ঃ২৩ এ স্যাসের দুটি দল অপারেশন নিমরোড শুরু করে। স্যাসের সমস্ত কম্যান্ডো দল দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় রেড টিম ও ব্লু টিম। রেড টিমের কম্যান্ডোরা ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলার জানলার কাছে এসে জানলা ভেঙে বাড়িতে ঢোকে, অন্যদিকে ব্লুটিম নীচের তলার জানলা গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে বাড়িতে ঢোকে। স্যাস কম্যান্ডোরা প্রথমেই ওয়েন আলিকে হত্যা করে। এরপর একে একে পাঁচজন সন্ত্রাসীকে হত্যা করে স্যাস। একজন সন্ত্রাসী বন্দীদের সাথে বাইরে যাবার পরিকল্পনা করেছিল, স্যাস তাকেও হত্যা করে। তবে একজন সন্ত্রাসীকে তারা গ্রেফতার করে এবং আজীবন কারাবাসের শাস্তি হয় তার, ২৮ বছর জেলে থাকার পর ২০০৮ সালে এই ব্যাক্তি মুক্তি পায়। অপারেশন নিমরোড ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অপারেশন গুলোর মধ্যে একটি। মাত্র ১৭ মিনিটের মধ্যে স্যাস পুরো অপারেশন সম্পন্ন করেছিল। মোট ৩৫ জন কম্যান্ডো অংশ নিয়েছিল এতে। বিশ্বের প্রথম দশ এলিট ফোর্সের একটি হল ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্সের অন্তর্গত স্যাস।