অফবিট

বিষকে মেকআপ প্রসাধনী রূপে বেচতেন যে মহিলা

মেকআপ সচরাচর মানুষকে সুন্দর করতে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে মেয়েরা নিজেকে আরও সুন্দর করে তুলতে মেকআপ ব্যবহার করে। কিন্তু ইতিহাসে এমন এক মহিলা ছিলেন যিনি মেকআপ তৈরি করতেন মানুষের মৃত্যুর জন্য। অর্থাৎ সেই মেকআপ ব্যবহার করলে মানুষের জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। বিষয়টি শুনে অবাক লাগলেও বাস্তবে সত্য ঘটনা। ১৭ শতকে ইতালিতে জিউলিয়া তোফানা নামের এক মহিলা শত শত পুরুষকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছিলেন। বিষকে তিনি মেকআপ প্রসাধনী রূপে বিক্রি  করতেন।

জানা যায়, ১৬২০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইটালির দক্ষিণাঞ্চলের পালেরমো শহরে জিউলিয়া তোফানা। তার একটি মেয়েও রয়েছে। কিন্তু সেই মেয়ে এবং তার পরিবার বর্তমানে কোথায় আছে সেই সম্পর্কে এখন কেউ কিছু জানে না। তবে সোনা গিয়েছিল যে তখন আর মাও মেকাপের মাধ্যমে বিষ তৈরি করতে পারতেন। অনেকেই অনুমান করেন মায়ের কাছ থেকেই এই কারুকার্য শিখেছিলেন তোফানা। তার মা থোফানিয়া ডি’আদামোকে ১৬৩৩ সালে ইতালির সিসিলির পালের্মোতে তার স্বামীকে হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। নিজের জীবনের প্রায় ৬০০ জন পুরুষকে মেকাপের মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তা সত্যেও সবার চোখে বিশেষ করে মহিলাদের কাছে তোফানা ছিলেন হিরো। তার একটিমাত্র কারণ হল- যেসব মহিলাদের উপর তাদের স্বামীরা অত্যাচার করতো, এবং দারিদ্রতার কারণে বন্ধ ঘরে মহিলাদের যে অত্যাচার সহ্য করতে হত তারই বিরোধিতা করত তোফানা। 

গিউলিয়া তোফানার বক্তব্য ছিল একমাত্র বিধবা হওয়ার মাধ্যমেই নারীরা নিজেদের এই নরম যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দিতে পারবে। বিষ প্রয়োগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটি নিদিষ্ট শ্রেণীর মানুষকে হত্যা করতেন। তিনি তাদেরই হত্যা করতেন যাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই বলে মনে করতেন তিনি। সে কারণেই মহিলাদের কাছে অনন্য ছিলেন তোফানা। যেহেতু রোমে তখন বিবাহ বিচ্ছেদের প্রচলন ছিলো না, তাই নরকীয় জীবন থেকে মুক্তির একমাত্র পথ ছিলো মৃত্যু সেটা হোক নিজের বা স্বামীর।

যদিও অনেকেই তোফানর এই কাজকে পছন্দ করতেন না। এমন হত্যাকান্ডের জন্য তার নাম রাশিয়ান সিরিয়াল কিলার দারিয়া সাল্টিকোভা ও হাঙ্গেরিয়ান সিরিয়াল কিলার এলিজাবেথ ব্যাথোরির পাশাপাশি রাখা হয়েছিল। দারিয়া সাল্টিকোভা করেছিলেন ১০০-র অধিক খুন আর এলিজাবেথ ব্যাথরি করেছিলেন ৬৫০-র অধিক। তবে দারিয়া সাল্টিকোভা ও এলিজাবেথ বাথরির খুনের জন্য সম্পদ ও ক্ষমতার প্রয়োজন হলেও গিউলিয়া তোফানার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

যে বিষের জন্য তোফানা বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল সেই বিষের নাম ছিল একুয়া তোয়াফানা’। গিউলিয়া তোফানার নামেই যার নামকরণ। এই বিষ এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে মৃত্যুর পর মৃতদেহের ময়নাতদন্তেও সেই বিষের উপস্থিতি ধরা পরতো না। 

একুয়া তোফানা গিউলিয়া সেসময় যে বিষগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় ছিল সেগুলো হল, কান্তারেলা, স্ট্রিকিনিন, হেমলক, বেলাডোনা, ফক্সগ্লোভ, একুয়া তোফানা এবং আর্সেনিক। গিউলিয়া তোফানার মার্কেটিং কৌশল ভিন্ন ধরণের ছিল। তোফানা বিষ বিক্রি করতেন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মহিলাদের কাছে। যারা জীবনে অসুখী ছিলেন। সেই সময়ে বিবাহ পদ্ধতি ছিল আগে থেকেই ঠিক করে রাখা। কেউ বিবাহিত জীবনে অসুখী হলে কিংবা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও ডিভোর্সের কোনো কার্যকরী পদ্ধতি ছিলনা। অনেক নারীই ছিলেন যারা স্বামীর হাত থেকে মুক্তি চাইতেন। 

প্রকৃতপক্ষে একুয়া তোফানা কোনো মেকাপ সামগ্রী ছিলনা। এটি ছিল আর্সেনিক, লেড এবং বেলাডোনার এক মিশ্রণ। আলাদাভাবে এই তিনটিই এক একটি ভয়ানক বিষ। তবে এই তিন বিষের মিশ্রণে তৈরি নতুন বিষ এর ধারণা তোফানার মাথায় এসেছিল নাকি তার মা থোফানিয়া ডি আদেমো এর মাথায় এসেছিল তা জানা যায়না। একুয়া তোফানা এতটাই ভয়ংকর বিষ ছিল যে এর ৪ ফোটাই যথেষ্ট ছিল একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য। একটি ছোট বোতলে করে একুয়া তোফানা বিক্রি হতো। বোতলের গায়ে সেন্ট নিকোলাসের ছবি থাকতো। এই বোতল শোভা পেত অনেক নারীর ড্রেসিং টেবিলে অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীর সাথেই। এর বোতলের ডিজাইনই এমন ছিল যে ভুলেও কেউ সন্দেহ করতে পারতো না যে এটা কোন মেকআপ সামগ্রী নাকি বিষ।

তবে ১৬৫০ সালের দিকে বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন তোফানা। এক নারী গ্রাহক এক অঘটন বাঁধিয়ে বসলেন। সেই নারীর সাথে তার স্বামীর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। একদিন সেই নারী তোফানার কাছ থেকে একুয়া তোফানার একটি বোতল নিয়ে যান এবং স্বামীর জন্য তৈরিকৃত স্যুপ এ মিশিয়ে দেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওই মহিলার মন পাল্টে যায় এবং সে তার স্বামীর হাত থেকে স্যুপের বাটি কেড়ে নেয়। ওই মহিলার স্বামীর এতে সন্দেহ হয় এবং সে তাকে জেরা করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সেই মহিলা তোফানা এবং তার বিষের কথা সব বলে দেয়। এবং পরে তার স্বামী এই খবর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। এরপরই  তোফানাকে গ্রেফতার করতে তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ।

তবে তোফানা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে তাকে গ্রেপ্তার করা এক প্রকার অসাধ্য ছিল। কিন্তু তখনই এক গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তোফানা রোম এবং আশেপাশের এলাকার জলে তার তৈরিকৃত একুয়া তোফানা বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন। এই গুজবের পর পুলিশ আবার নড়েচড়ে বসে এবং জোর করে চার্চ থেকে তোফানাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায়। বিভিন্ন টর্চারের পর তোফানা স্বীকার করে তার তৈরিকৃত বিষে শুধু রোমেই ১৬৩৩ থেকে ১৬৫১ সালের মাঝে প্রায় ৬০০ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৬৫৯ সালে তোফানাকে তার মেয়ে এবং তাদের ৩ জন গৃহ পরিচারিকা সহ দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেওয়া হয়। সে বছরই তোফানা সহ তার মেয়ে এবং সাহায্যকারীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এরপরে ১৬৫৯ সালে মৃত্যু হয় তোফানার, এবং ভাবেই শেষ হয় গিউলিয়া তোফানা নামক এক নীরব ঘাতকের গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *