বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ নাস্ত্রাদামুসের কিছু ভবিষ্যতবাণী
বলা হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কিছু ভবিষ্যৎ বক্তার মধ্যে নাস্ত্রাদামুস একজন। বর্তমান সময়েও নাস্ত্রাদামুস প্রবল জনপ্রিয়। ১৫৬৬ সালের ১৭ জুন নাস্ত্রাদামুস তার উইল তৈরি করে এবং ১ জুলাই পাদ্রীকে ডেকে বলেন পরের দিন রাতের আগেই তার মৃত্যু হবে, সেকারনে পাদ্রীকে অন্তিম সংস্কারের কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। ঠিক পরেরদিন অর্থাৎ ২ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। এরকমই ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন তিনি। নাস্ত্রাদামুস তার জীবনে অনেক ভবিষ্যৎ বানী করেছেন যার কিছু সত্যি হয়েছে এবং কিছু হয়নি। তবে তাঁর ভবিষ্যৎ বানী নিয়ে আজও রীতিমতো চর্চা চলে ইন্টারনেটে। মৃত্যুর প্রায় সাড়ে চারশো বছর পর এখনও তাঁর অদ্ভুত সব ভবিষ্যৎ বানী এখনও মানুষের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে।
১৫০৩ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের একটি ছোট গ্রামে জন্ম হয় নাস্ত্রাদামুসের। তার পুরো নাম ছিল মিচেল দ্য নাস্ত্রাদামুস। কুড়ি, বাইশ বছর বয়স থেকেই নাস্ত্রাদামুস ভবিষ্যৎ বানী করা শুরু করে দিয়েছিল। একবার নাস্ত্রাদামুস তার এক বন্ধুর সাথে ইটালির রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ সামনে দিয়ে আসা এক যুবককে দেখে মাথা হেঁট করে সম্মান জানান তিনি, এটা দেখে তার বন্ধু কারন জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান এই ব্যাক্তি ভবিষ্যতে পাদ্রী হবে। ফেলিক্স নামে ওই যুবক পরে ১৫৮৫ সালে পাদ্রী হন।
ফরাসী জ্যোতিষবিদ নাস্ত্রাদামুস ডাক্তার ও শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্লেগের মতো রোগের ওষুধ তৌফিক করতেন। কবিতার আকারে তিনি তার ভবিষ্যৎ বানী করে গেছেন। যেমন ২০২০ সালে বিশ্বে চলা আর্থিক মন্দা এবং ঔই বছর পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে যাওয়া পাঁচটি উল্কাপিন্ডের খবর তিনি আগেই জানিয়েছিলেন। নাস্ত্রাদামুস তাঁর সব ভবিষ্যৎ বানীই কবিতার আকারে জানিয়ে ছিলেন। একবার ফ্রান্সের মহারানী ক্যাথরিন তাঁকে ডাকেন তাঁর দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ বলা জন্য। নাস্ত্রাদামুস বুঝতে পারেন দুই রাজকুমার খুব কম বয়সেই মারা যাবেন কিন্তু এই কথা সরাসরি জানালে মহারানি শাস্তি দিতে পারে তাঁকে যার কারনে তিনি কবিতার আকারে পুরো ঘটনা বলেন যাতে সরাসরি কেউ বুঝতে না পারেন। এরপর থেকে তিনি সমস্ত ভবিষ্যৎ বানী কবিতার আকারে লিখে যান। ১৫৫০ সালে তিনি দ্য প্রফিসিস নামে বই লেখেন যেখানে তিনি ৬,৩৩৮ ভবিষ্যৎ বানী লিখেছিলেন৷ তিনি যুদ্ধ, রাজা, সাম্রাজ্যের উদয় ও ধ্বংস, ভূমিকম্প, মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সহ প্রায় সমস্ত বিষয়েই লিখেছিলেন। তাঁর ৭০ শতাংশ ভবিষ্যৎ বানী সত্যি হয়েছে। নাস্ত্রাদামুসের সত্যি হওয়া ভবিষ্যৎ বানী গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নয়টি ঘটনা :–
১) হেনরী দুই এর মৃত্যু :– ফ্রান্সের রাজা হেনরী দুই এর সম্পর্কে নাস্ত্রাদামুস লিখেছিলেন যুদ্ধের ময়দানে যুবক সিংহ বৃদ্ধ সিংহের উপর আঘাত করবে। একই জায়গায় দুবার আঘাত করবার ফলে বৃদ্ধ সিংহের কষ্টদায়ক মৃত্যু হবে। ১৫৫৯ সালের ৩০ জুন হেনরী দুই তাঁর মেয়ে এলিজাবেথের বিবাহ উপলক্ষে একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। ঘোড়ার পিঠে চেপে যুদ্ধের এই প্রতিযোগিতায় গ্যাব্রিয়েল দ্য লরগেসের দ্বারা তিনি চোখে দুবার আঘাত প্রাপ্ত হন। দশদিন পরে চোখ ও মাথায় আঘাতের কারনে অত্যন্ত যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু হয়। অর্থাৎ নাস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যৎ বানী অনুযায়ী বৃদ্ধ সিংহ হেনরী দুই এবং যুবক সিংহ গ্যাব্রিয়েল লরগেস। কাকতালীয় ভাবে যুদ্ধের দিন তাঁরা দুজনেই সিংহের মুকুট পরেছিল।
২) লন্ডনের বিশাল আগুন:– মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আগুন লেগেছিল লন্ডনে ১৯৬৬ সালে। এই ব্যাপারে নাস্ত্রাদামুস লিখেছিলেন ৬৬ সালে লন্ডনে রক্তের অভাব ঘটবে এবং আগুন ছড়িয়ে পড়বে। একজন প্রাচীন মহিলা উঁচু জায়গা থেকে নেমে আসবে এবং একই সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ মারা যাবে। ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৬ সালে লন্ডনের এক প্রাচীন বেকারী থেকে আগুন গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তিনদিন ধরে এই আগুনে খ্রীষ্টান ধর্মের অনেক মানুষ মারা যায়।
৩) ফরাসী বিপ্লব :– নাস্ত্রাদামুস লিখেছিলেন গান, চিন্তা এবং অধিকারের কথা কয়েদীরা ঘোষনা করবে যাদের শসকরা বন্দী করে রেখেছে। পরে বুদ্ধিহীন ব্যাক্তিরা এই ঘটনাকে মহান কোন অলৌকিক ঘটনা মনে করবে। ১৭৮০ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় সমস্ত শসাক গোষ্ঠীকে প্যারিসের দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়। সাধারন মানুষ ফ্রান্সের ক্ষমতা নিয়ে নেয়।
৪) নেপোলিয়নের বিজয় :– নাস্ত্রাদামুস লিখেছিলেন পৌ, নে, লরেন থেকে আগত ব্যাক্তি যে দিকে যাবে সেদিকে তার বিজয় হবে কিন্তু শেষে জেলে তার মৃত্যু হবে। এই পৌ, নে, লরেন জায়গা গুলো ফ্রান্সে। নেপোলিয়নের উত্থান এখান থেকেই হয়েছিল। নেপোলিয়ন প্রথম দিকে শুধু জিতেই যাচ্ছিল। পরে ওয়াটারলুর যুদ্ধে ব্রিটেনের কাছে হেরে গিয়ে জেলে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
৫) লুই পাস্তুরের আবিষ্কার :— মহান ফরাসী বৈজ্ঞানিক লুই পাস্তর সম্পর্কে নাস্ত্রাদামুস বলেছিলেন কয়েক শতাব্দী ধরে হারিয়ে যাওয়া তথ্য উদ্ধার হবে। পাস্তরকে লোকে ভগবানের মতো মানবে কিন্তু নির্দিষ্ট একটি সময় পর মানুষ তাকে অসম্মান করবে। লুই পাস্তরের সাথে ঠিক তাই হয়। ১৮২২ সালে ফ্রান্সে জন্মানো লুই পাস্তর একজন রসায়নবিদ ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট ছিলেন। আণুবীক্ষনিক জীবানু ও তাদের জন্ম নিয়ে গবেষনা করেন তিনি। তাঁর কারনেই রেবিশ ও অ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা আবিষ্কার হয়। কিন্তু পরে তাঁর নামে কিছু লোক বই লিখে বদনাম শুরু করে।
৬) অ্যাডলফ হিটলার :– নাস্ত্রাদামুস লিখেছিলেন পশ্চিম ইউরোপে গরীব মানুষদের মধ্যে এক বাচ্চার জন্ম হবে। যে তার কথার মাধ্যমে বিশাল একটি সেনা গঠন করবে, তার খ্যাতি পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়বে। ক্ষুধার্ত পশুর দল নদী অতিক্রম করবে কিন্তু একটি বড় অংশ হিস্টারের বিপক্ষে থাকবে। জার্মানির এই ছেলেটি যখন কোন উপায় খুঁজে না পাবে তখন লোহার খাঁচায় মানুষকে কষ্ট দেবে। নাস্ত্রাদামুস এখানে হিস্টার বলতে হিটলারকে বুঝিয়েছেন। হিটলারের জন্ম হয়েছিল পশ্চিম জার্মানির এক গরীব পরিবারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তার উগ্র বক্তব্যের মাধ্যমে বিশাল নাজি সেনা গঠন করেছিল। জাপান ও অটোমান সাম্রাজ্য হিটলারকে সহায়তা করেছিল অর্থাৎ তার খ্যাতি পূর্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানে লোহার খাঁচা বলতে গ্যাস চেম্বারের কথা বলা হয়েছে যেখানে লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিল হিটলার।
৭) চার্লস ডে গুল্লের নেতৃত্ব :– নাস্ত্রাদামুস লিখেছিলেন হারকিউলিস রোম এবং অ্যানারমাকের রাজা হবে। ডে গুল্লে তিনবার শাসক হবে। ইটালি এবং ভেনিসের জল কাঁপতে থাকবে। এই শাসক সব রাজার থেকে শ্রেষ্ঠ হবে। চার্লস ডে গুল্লে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন, কিছু সময় পর তিনি তৎকালীন ফ্রান্সের কার্যকারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৫৯ সালে তিনি ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি হন। অর্থাৎ চার্লস ডে গুল্লে তিনবার তিনবার শাসক হয়েছিল। সবশেষে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন যা সব শাসকের থেকে শ্রেষ্ঠ পদ।
৮) জন এফ কেনেডির মৃত্যু :— নাস্ত্রাদামুস লিখেছিলেন একটি প্রাচীন কাজ সম্পন্ন হবে। উপর থেকে একজন শয়তান ভালো মানুষের উপর পড়বে। একজন নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যু হবে এবং আসল অপরাধীকে পাওয়া যাবেনা। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডিকে ওপর থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। লি হার্ভে অসওয়াল্ড নামে এক নির্দোষ ব্যাক্তির উপর মামলা চালানো হয়, মামলা চলাকালীন তাঁর মৃত্যু হয়। পরে জানা যায় লি হার্ভে অসওয়াল্ড নির্দোষ ছিলেন। জন এফ কেনেডিকে কে হত্যা করেছে তা আজও জানা যায়নি।
৯) ৯/১১ আক্রমন:— নাস্ত্রাদামুস লিখেছিলেন ৪৫ ডিগ্রির কাছে আকাশ জ্বলবে। নতুন শহর পুড়ে যাবে। একজন ঠান্ডা ও নিষ্ঠুর হৃদয় ব্যাক্তি কাউকে দয়া করবেনা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ার হাইজ্যাক বিমান দিয়ে ধ্বংস করা হয় যাতে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। নিউইয়র্ক শহর ৪৫ ডিগ্রি অক্ষাংশের খুব কাছে।
এছাড়াও জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমানু বোমা বিস্ফোরনের কথা, মানুষের চাঁদে যাওয়ার কথাও নাস্ত্রাদামুস জানিয়েছিল। নাস্ত্রাদামুসের বই দ্য প্রফিসিসে যে ৬,৩৩৮ ভবিষ্যৎ বানী করেছিলেন তার মধ্যে এখনও অবধি আটশোটি কথা সফল হয়েছে। এটা শুনে হয়ত মনে হবে বাকী গুলে হয়ত মিথ্যা কিন্ত ব্যাপারটা তা না, নাস্ত্রাদামুস ১৫৫০ থেকে ৩৭৯৭ সাল অবধি হতে চলা অনেক ঘটনা লিখে গেছেন। এখন সবে ২০২৩ সাল অর্থাৎ এখনও প্রায় ১৭৬৪ বছর ভবিষ্যতের কথা তিনি লিখে গেছেন।
নাস্ত্রাদামুস তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্পর্কেও বলে গেছেন। তিনি বলেছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হবে দক্ষিন এশিয়ার কোন দেশ থেকে। দক্ষিন এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী দুই দেশ হচ্ছে ভারত ও চীন দুজনের কাছেই পরমানু অস্ত্র রয়েছে। এদিকে পারমানবিক শক্তিশালী পাকিস্তানও রয়েছে চীনের সমর্থনে। তবে নাস্ত্রাদামুস এটাও বলে গেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে ধর্মে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে। তবে এই যুদ্ধ কে হারবে কে জিতবে সেসব সম্পর্কে বলা নেই। তবে নাস্ত্রাদামুসের বেশ কিছু ভবিষ্যৎ বানী সত্যি হয়নি যেমন তিনি বলেছিলেন ১৯৯৯ সাল অথবা ২০২১ সালে পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে, তবে তিনি জোর দিয়ে বলেননি।
২০১২ সালে মহাপ্রলয়ের কথাও বলেছিলেন তিনি যা হয়নি। ইন্দিরা গান্ধী ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস সম্পর্কেও বলে গিয়েছিলেন নাস্ত্রাদামুস। এমনকী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস যে সাবমেরিনে করে জার্মানি গিয়েছিলেন সেই কথাও তিনি বলে গিয়েছিলেন। নাস্ত্রাদামুস বলে গিয়েছেন তিন দিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা এমন জায়গায় এক ব্যাক্তির জন্ম হবে যে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। তিনদিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা দেশ আমাদের ভারতবর্ষও। তবে বিশ্বে তিনদিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা এমন অনেক দেশই আছে। এখন দেখার নাস্ত্রাদামুসের এই কথা কতটা সত্যি হয়।