অফবিট

ভারত কীভাবে তাওয়াংকে রক্ষা করছে?

সময়টা ৭ নভেম্বর, ১৯৫০ সাল, তিব্বতে চীনের প্রভাবের কয়েক মাস পর এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যুর এক মাস আগে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে একটি চিঠি লিখে জানান চীন ভারতকে শান্তি রক্ষার নামে ধোঁকা দিয়েছে। কয়েক শতাব্দী পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে ভারতকে দ্বিমুখী যুদ্ধের প্রস্ততি নিয়ে রাখতে হবে। পাকিস্তানের পাশাপাশি উত্তর পূর্ব ভারতে চীনের বিরুদ্ধেও প্রস্ততি নেওয়া দরকার ভারতের। একটা খুব তাড়াতাড়ি ক্যাবিনেট বৈঠক দরকার। বলা হয় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের এই চিঠি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর উপর তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের আশঙ্কা শেষ অবধি সত্যি হয়। ১৯৬২ সালে অতর্কিত ভারত আক্রমন করে চীন। কিন্তু তার আগে অসাধারন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাওয়াংকে ভারতের অংশ করে নেন। চীনের কুইং সাম্রাজ্যের থেকে তাওয়াংকে সর্বপ্রথম ব্রিটিশরা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়েছিল। এই তাওয়াংকে হারানোর শোক আজও ভুলতে পারেনি চীন। তাওয়াং ভারতের জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ন কেন!! ভারত কীভাবে তাওয়াংকে রক্ষা করে চলেছে এটা প্রত্যেক ভারত বাসীর জানার প্রয়োজন।

ভারত ও চীনের সীমান্ত নির্ধারন নিয়ে প্রথম থেকেই বিবাদ রয়েছে। ভারত ও চীন সীমান্তে তিনটি ভাগে বিভক্ত যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিম সেক্টর, মধ্য সেক্টর এবং পূর্ব সেক্টর। পশ্চিম সেক্টরে লাদাখ রয়েছে ভারতের দিকে এবং তিব্বত ও জিন জিয়াং প্রদেশ রয়েছে চীনের দিকে। মধ্য সেক্টরে উত্তরাখন্ড ও হিমাচল প্রদেশ ভারতের দিকে রয়েছে, যেখানে তিব্বত রয়েছে চীনের দিকে। পূর্ব সেক্টরে অরুনাচল প্রদেশ ভারতের দিকে রয়েছে এবং তিব্বত রয়েছে চীনের দিকে। অর্থাৎ তিনটি সেক্টরেই ভারতীয় ভূভাগের বিপরীতে তিবত রয়েছে।  ভারত ও চীনের সীমান্তকে এলএসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বলা হয়। অরুনাচল প্রদেশকে তিব্বত থেকে ম্যাকমোহন রেখা দ্বারা আলাদা করা হয়েছে। ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধের পর উভয় দেশ শান্তি রক্ষার জন্য এই এলএসি তৈরি করে। ১৯৯৩ সালে সীমান্তে শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে উভয়দেশ এলএসি মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বরাবরের মতোই চীন নিজেদের সীমানা বাড়িয়ে বলতে শুরু করে। সীমান্ত নিয়ে সব প্রতিবেশীর সাথেই ঝামেলা আছে চীনের। ভারতের দাবি অনুযায়ী এলএসির দৈর্ঘ্য ৩,৪৮৮ কিলোমিটার, সেখানে চীন দাবি করে এলএসির দৈর্ঘ্য ২০০০ কিলোমিটারের একটু বেশী। চীন প্রথম থেকেই অরুনাচল প্রদেশকে তাদের বলে দাবি করে আসছে। এর অন্যতম প্রধান কারন অরুনাচল প্রদেশের ভূ প্রকৃতি। ৮৩,৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত অরুনাচল প্রদেশ উত্তর পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য। ভৌগোলিক ভাবে এই রাজ্যে ৯৮ শতাংশ জঙ্গল ও ২ শতাংশ জল রয়েছে। অরুনাচল প্রদেশের সাথে ভুটান, মায়ানমার এবং তিব্বতের সীমানা রয়েছে। একাধিক বার চীন সেনা অরুনাচলে প্রবেশের চেষ্টা করেছে কিন্তু বারবার ভারতীয় সেনা তাদের অসাধারন বীরত্বে চীনকে এখানে পরাজিত করেছে। অরুনাচল প্রদেশকে ঘিরে বিতর্কের পেছনে কীছু ঐতিহাসিক কারনও আছে। 

ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৮২৬ সালে যখন ব্রিটিশরা অ্যাংলো বার্মিজ যুদ্ধের মাধ্যমে আসামকে ভারতের অংশ করে নেয়। সেসময় অরুনাচল প্রদেশের বেশ কিছু অংশ আসামের মধ্যেই ছিল। ব্রিটিশরা অরুনাচল প্রদেশের লোহিট উপত্যকায় চা চাষ শুরু করে। সেসময় এই অঞ্চল তিব্বত বা চীন কারও অধীনেই ছিলনা। ব্রিটিশরা এরপর তিব্বতের মধ্যে দিয়ে একটি রাস্তা নির্মানের প্রস্তাব দেয় যাতে চীনের সাথে বানিজ্য করা যায় কিন্তু তিব্বত বাধা দেয়। যার কারমে সেসময় ভারতে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঠিক করে তিব্বতে তারা প্রভাব বাড়াবে কারন ব্রিটিশরা চিন্তায় ছিল রাশিয়া ওই অঞ্চলে যাতে না চলে আসে। 

১৯০৩ সালে স্যার ফ্রান্সিস ইয়াংহাসবেন্ডকে লর্ড কার্জন নির্দেশ দেয় তিব্বতে মিলিটারি অভিযান করার। ১৯০৪ সালে তিব্বত দখল করে নেয় ব্রিটিশরা। এইসময় চীনে কুইং সাম্রাজ্যের শাসন ছিল। কুইংদের দাবী ছিল তিব্বত তাদের অংশ কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের দাবী শোনেনি। ১৯১২ সাল আসতে আসতে চীনে কুইং সাম্রাজ্যের পতন হয়। তখন চীনের নতুন শাসক গোষ্ঠী, তিব্বতের শাসক ও ব্রিটিশদের মধ্যে একটি বৈঠক হয় যাকে সিমলা বৈঠক বলা হয়্ এখানে ঠিক হয় তিব্বতকে দুটি ভাগে ভাগ করা হবে। তিব্বতকে বাইরের এবং ভিতরের তিব্বত ভাগে বিভক্ত করা হয় ম্যাকমোহন লাইন দ্বারা। ব্রিটেনে তৎকালীন বিদেশ সচিব স্যার হেনরি ম্যাকমোহনের নামে এই লাইনের নাম রাখা হয়। বাইরের তিব্বত ছিল ভারতের দিকে। ঠিক হয় এখানে চীনের স্বায়ত্তশাসন থাকবে এবং সরকার হবে লামাদের কিন্তু শেষমুহুর্তে চীন এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। যার ফলে ১৯১৪ সালের ৩ জুলাই ব্রিটেন ও তিব্বতের মধ্যেই এই চুক্তি হয় এবং তাওয়াং এলাকা ব্রিটেনের অধিকারে চলে আসে। এরপর ১৯৩৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাওয়াং এর উপর আক্রমন করে বিপক্ষ শক্তি। তখন থেকে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বুঝতে পারেন ভবিষ্যতে কখনও না কখনও তিব্বত আক্রমন করবে চীন। সেজন্য তিনি আগে থেকেই তাওয়াং এর দায়িত্বে পাঠিয়ে দেয় দুই বিশেষ ব্যাক্তি জয়রাম দৌলাতরাম এবং মেজর বব খাটিংকে। 

১৯৫০ সালে মৃত্যুর আগে তাওয়াং এর পরিপূর্ন সুরক্ষার ব্যাবস্থা করে যান সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন তাওয়াং এ যেন সবসময় আসাম রাইফেলস থাকে। ১৯৫১ সালে মেজট বব খাটিং তার বাহিনী নিয়ে তাওয়াং পৌঁছায়। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের দূরদৃষ্টির জন্যই তাওয়াং আজ ভারতের অংশ হয়েছে এজন্য তাওয়াংকে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ভারতকে দেওয়া শেষ উপহার বলা হয়। ১৯৫৯ সালে তাওয়াং হয়েই দলাই লামা ভারতে এসে আশ্রয় নেয়। সেই থেকেই চীনের সাথে ভারতের ঝামেলা শুরু যার ফলস্বরূপ ১৯৬২ সালের যুদ্ধ।

চীন গোটা অরুনাচল প্রদেশকেই তাদের বলে দাবী করে কিন্তু তাওয়াং এর উপর তাদের বিশেষ নজর রয়েছে, এর পেছনে বিশেষ কিছু কারন আছে। তিব্বতের প্রধান ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। তাওয়াং এ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ মঠ রয়েছে। তাওয়াং এ চুমি গাটসে জলপ্রপাত রয়েছে যা ১০৮ টি জলপ্রপাতের সমষ্টি। বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে অতি পবিত্র এই জলপ্রপাত। যার কারনে চীন এই পুরো তাওয়াং দখল করে পুরো তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের মানুষদের নিজেদের নিয়ন্ত্রনে আনতে চায়। তাওয়াং এলাকায় প্রচুর খনিজ সম্পদ পাওয়া যায় এবং এখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। এছাড়া তওয়াং এর স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে চীনের কাছে৷ তাওয়াং এর উত্তরে রয়েছে বামলা পাস। এই পাস দিয়েই ১৯৬২ সালে চাইনিজ সেনা ভারত আক্রমন করেছিল। চীন খুব ভালোভাবেই জানে যদি কখনও ভারতের সাথে যুদ্ধ হয় তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনী খুব সহজেই বামলা পাস হয়ে তিব্বতে পৌঁছে যাবে। সেজন্য চীনের সবসময় তাওয়াং এর দিকে নজর থাকে। চীন খুব ভালো করেই জানে যদি তাওয়াং সহ অরুনাচল প্রদেশ দখল করতে পারে তাহলে খুব সহজেই শিলিগুড়ি করিডর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে তারা। চীন অরুনাচল প্রদেশকে নিয়ে প্রায়ই মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করে ভারতের উপর। 

২০০৭ সালে অরুনাচলের মুখ্যমন্ত্রীকে চীন ভিসা দেয়নি কারন চীন জানায় তারা নিজের দেশের লোককে কী করে ভিসা দেবে? ২০০৯ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর অরুনাচল প্রদেশ সফরেরও বিরোধীতা করেছিল চীন। তবে চীন যাই করুক না কেন প্রাচীন কাল থেকেই অরুনাচল প্রদেশ ভারতেরই অংশ। 

মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ মহারানী রুক্মিনীকে অরুনাচল প্রদেশ থেকেই নিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং ইতিহাস বলে অরুনাচল প্রদেশ চিরকাল ভারতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। অরুনাচল প্রদেশকে সবসময় রক্ষা করার জন্য প্রস্তত রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ২০১৭ সালে ডোকলামকে চীনের সেনার বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী রুখে দাঁড়িয়েছিল। ৭৩ দিন উভয় পক্ষের সেনাবাহিনীর দাঁড়িয়ে থাকার পর চীন নিজেই পিছিয়ে গিয়েছিল। ২০২০ সালে লাদাখে চীনের ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঝামেলা হয় যাতে শেষ পর্যন্ত পীছু হটে চীন। তাওয়াং এর নিরাপত্তার জন্য ভারত এখানে মিলিটারি বেস, এয়ার বেস তৈরি করেছে। যেখানে যুদ্ধ বিমান, অ্যাটাক হেলিকপ্টার রয়েছে। তাছাড়া গোয়েন্দা স্যাটেলাইট সবসময় নজর রাখছে এই উপত্যকার উপর। অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও ড্রোন রয়েছে এখানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *