৩০০ বছর আগে স্বর্গ লাভের জন্য শিশু হত্যা করতেন রমণীরা
পূণ্য লাভ কিংবা স্বর্গ লাভের আশাতে অনেক মানুষ অনেক পন্থা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু স্বর্গ লাভ করতে গিয়ে একাধিক শিশু হত্যা করার ঘটনা খুবই আশ্চর্যজনক এবং মর্মান্তিক। এই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৭০৪ সালে জার্মানিতে। স্বর্গ লাভের আশাতে শিশু হত্যা করে এই মর্মান্তিক ও নৃশংস ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন অ্যাগনেস ক্যাথরিনা শিকিন নামের একজন কিশোরী তথা খ্রিষ্টান ধর্মের অনুরাগী।
জানা যায় যে, ঘটনাটি ঘটেছিল তথা শিশু হত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিল ১৭০৪ সালের কোন এক বসন্তের সকালে। সেই সময় খ্রিস্টান ধর্মের অনুরাগী এক কিশোরী অ্যাগনেস ক্যাথরিন গ্রামে একজন কৃষকের স্ত্রীর কাছ থেকে এক গ্লাস দুধ চেয়ে খেয়েছিলেন। দুধ খাওয়ার পর গ্রাম ছেড়ে যখন তিনি চলে যাচ্ছিলেন তখন দেখতে পেয়েছিলেন যে চারটি ছেলে খেলাধুলা করছে। সেই চারজন যুবকের মধ্যে হ্যান্স মাইকেল ফার্চ নামের একজন ৭ বছর বয়সী ছেলেকে ডেকে তিনি বলেছিলেন যে তিনি এই গ্রামে অপরিচিতা এবং রাস্তা খুঁজে দিতে। যদিও বাকি ছেলেরাও অ্যাগনেস ক্যাথরিনকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি সকলকে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। যথারীতি বাকি ছেলেদের বারন করার কারণে তারা পরবর্তীতে নিজেদের খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। একমাত্র অ্যাগনেস ক্যাথরিন ও হ্যান্স মাইকেল ফার্চ নামের ওই যুবক রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। কথা বলতে বলতেই দুজন পথ চলার যেই শুরু করেছিল কিভাবে যে সময় ব্যতীত হয়ে সূর্য অস্ত গিয়ে সন্ধ্যা নেমেছিল কেউই বুঝে উঠতে পারেননি। এরপরই যথারীতি সন্ধ্যা নামতেই হ্যান্স মাইকেল অ্যাগনেস ক্যাথরিনকের কাছে বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুমতি চায়। কিন্তু ছেলেটি বাড়ি যাবে এই কথা শুনতেই খুবই নৃশংসভাবে শিশুটিকে মাটিতে ফেলে দেয় ক্যাথরিন। নিজেকে বাঁচাতে এবং ক্যাথরিনের মাথা ঠান্ডা করতে হ্যান্স মাইকেল চার্চ থেকে শেখা ধর্মীয় বাণী বিড়বিড় করতে শুরু করেছিলেন। মন্ত্র পাঠ শুনে কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছিল ক্যাথরিন। সেই সময় হ্যান্স মাইকেল ভেবেছিল হয়তো ক্যাথরিনের মাথা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে আরো নিঃসঙ্গে হয়ে ক্যাপ্টেন একটি চাকু বের করে সাত বছর বয়সী ওই শিশুর গলার উপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল। যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় শিশুটি ছটফট করছিল ঠিক সেই সময় ক্যাথরিন চিৎকার করে বলেছিলেন যে ” ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুক হে মিষ্টি দেবদূত “।
এবার সকলের প্রশ্ন হচ্ছে শুধুই কি স্বর্গ লাভের ইচ্ছা নাকি অন্য কোন কারণে শিশু হত্যা করেছিলেন ক্যাথরিন!
এবার তাহলে বলা যাক যে, মহিলা তথা কিশোরী অ্যগনেস ক্যাথরিন যে গোটা ঘরের ঘটিয়েছিলেন তার পেছনে আসল রহস্য কি? এই কিশোরী যে একজন ৭ বছর বয়সী শিশুকে হত্যা করেছিলেন সেটা পথ চলতি এক ব্যক্তির সাক্ষী দ্বারা প্রমাণ হয়েছিল। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল যে অ্যগনেস ক্যাথরিন খ্রিস্টান ধর্মের অর্চনার সদস্য ছিলেন। তিনি একজন খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী ও অনুরাগী হওয়ার কারণে তার ধর্মীয় গুরুদের নির্দেশ অনুযায়ী সকল অনুসারীকেই ধাপে ধাপে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতো। সেরকমই হয়েছিল অ্যগনেস ক্যাথরিনের সঙ্গে। তার নিজের জীবনের উপর কোন প্রকার আগ্রহ ছিল না। তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম অনুযায়ী আত্মহত্যা মহাপাপ।
১৭০৪ সালে অর্থাৎ সেই শতাব্দীতে যে সকল খ্রিস্টান ধর্মের সদস্যরা নিজেদের জীবন চালিয়ে যেতে চাইতো না তারাই সর্ব লাভের জন্য এইভাবে শিশু হত্যা করত। হ্যান্স মাইকেল ফার্চের হত্যা ঘটনাও ছিলো সেই স্বর্গ লাভের স্কিমের একটি অংশ। যেহেতু খ্রিস্টান ধর্ম অনুযায়ী আগেই বলা হয়েছিল যে আত্মহত্যা মহাপাপ এবং যারা এই আত্মহত্যা করে তাদের স্থান জাহান্নামে হয় এবং তাদের কোন প্রায়শ্চিত্ত হয় না তাই আত্মহত্যার পথে কোন ধর্মীয় সদস্য অগ্রগতি করতে সাহস পেতো না। কারন সেই সময় যারা আত্মহত্যা করত শুধুমাত্র তারা নয় তাদের গোটা পরিবারের সদস্যদের একাধিক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। এই গোটা নিয়ম তথা পদ্ধতি কায়েম ছিল ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের উপর। এমনকি আত্মহত্যা কারীদের মৃতদেহ পর্যন্ত কবরস্থানে কবর দেওয়ার অনুমতি পেত না। যাদের এভাবে মৃত্যু হতো মানে যারা আত্মহত্যা করত তাদের মৃতদেহ তুলে দেওয়া হতো তখনকার সমাজে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ যাদেরকে কসাই বলে সম্বোধন করা হতো তাদের হাতে। সেই সকল কসাই ব্যক্তিরা ওই মৃতদেহগুলিকে নির্জন জায়গায় পুঁতে দিত যেখানে মানুষের যাওয়া আসা খুব কমই ছিল। অ্যাগনেস ক্যাথরিন সেই সাত বছর বয়সী বাচ্চাটিকে হত্যা করেছিলেন একমাত্র স্বর্গে যাওয়ার জন্য। কারণ খ্রিস্টান ধর্ম অনুযায়ী বলা আছে যে শিশুরা একমাত্র স্বর্গে যেতে পারে। কারণ তারা তখনও পাপ কাজ করে না এবং পাপের সঙ্গে যুক্ত হয় না। শুধুমাত্র যে ক্যাথরিন এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাই নয়, তার মতো আরো অনেক মানুষ স্বর্গ লাভের জন্য শিশু হত্যা করেছেন। এই গোটা পদ্ধতিটিকে বলা হত ‘সুইসাইড বাই প্রক্সি’।
অ্যাগনেস ক্যাথরিনের মতো যারা শিশু হত্যা করে তাদের স্বর্গে পাঠাতো তারা নিজেদেরকে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান ভাবতো। তারা মনে করত এইভাবে শিশু হত্যা করে তারা শিশুদের স্বর্গে পাঠাচ্ছে এবং তাদের বেদনাদায়ক জীবন থেকে মুক্তি দিচ্ছে। যদিও তারা কোনদিন এই হত্যার ঘটনা স্বীকার করেনি। বরাবরই এই হত্যার ঘটনার দায়ভার চাপিয়ে এসেছে ইউরোপীয় ইহুদী এবং কেল্ট তথা ডাইনিদের উপর। খ্রিস্টান ধর্মের অনুগামীরা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে শিশু হত্যা করছে এবং মিথ্যে অভিযোগ করে বলতো যে ডাইনি এবং ইহুদিরা ডাকিনী বিদ্যা ও শয়তানের উপাসনার জন্য শিশু হত্যা করছে।
পরবর্তীতে সমাজ উন্নত হওয়ার কারণে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এই গোটা ঘটনার উপর রিসার্চ চালিয়েছিল। সেই গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছিল যে ১৬১২ থেকে ১৮৩৯ সালের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপে প্রক্সি পদ্ধতির মাধ্যমে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ১১৬ জন শিশুর। শুধুমাত্র হত্যা নয় মাঝে মাঝে অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ করত হত্যাকারীরা। এই সকল অপরাধীদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের অপরাধ স্বীকার করে আইনের কাছ থেকে মৃত্যু দন্ডের আশা করেছিল। কারণ তারা নিজেদের জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাইতো। এই প্রক্সি পদ্ধতি যে অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে করা হতো সেটা নয় বরং কখনো কখনো মায়েরা নিজের সন্তানকেও শিকার বানাতো। সেই কারণে ইতিহাসবিদ্যা এই ঘটনার দিন নামকরণ করেছিলেন যে ক্লাসিক্যাল ইনফ্যান্টিসাইট। যখন এই সকল অপরাধীরা আত্মসমর্পণ করতো তারা আদালতে নিজেদের কারণ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করত। তারা কেন শিশু হত্যা করতে এবং তার কারণ কি সম্পূর্ণটাই আদালতকে জানাত তারা। কারণ অভিযুক্তরা মনে করত সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি করলেই তারা মৃত্যুর আগেই ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমা পেতে পারে।
১৬৯১ সালে অনৈতিক জীবনযাপন চালানোর অভিযোগে মারিয়া হেলেনা ল্যাঙ্গিন নামে এক নারী নুরেমবার্গের কারাগারে বন্দি ছিলেন। এখানে তিনি কোন শিশুকে না পাওয়ার কারণে একজন বধির ব্যক্তিকে ইট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিলেন। আবার সেই একই কারণে অর্থাৎ স্বর্গ লাভের আশায় ১৭০৩ সালের জুন মাসে একজন মহিলা তার শিশুকে পেগনিৎজ নামক একটি নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছিলেন। তিনি এটাই মনে করেছিলেন যে তার শিশুর স্বর্গ লাভ হয়েছে এবং এবার তারও হবে।
পরবর্তীতে আবার একই ঘটনা ঘটেছিল ১৭৪৬ সালে। সেই সময়কালে একজন মহিলা স্প্যান্ডাউ কারাগারে বন্দি অবস্থায় নিজের জীবন এবং নরক থেকে মুক্তি পেতে কারাগারে আরেক মহিলার শিশুকে হত্যা করেছিলেন। ১৬৭০ সাল লাগাতেই গোটা ঘটনাটি তথা প্রক্সি খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল সমাজের কাছে। যার কারণে পরবর্তী শতাব্দী প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ৬২টি। গোটা ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে শিশুদের হত্যা করার পেছনে একমাত্র হাত থাকতো মহিলাদের। অনেকের অনুমান বিকৃত মস্তিষ্ক তথা অন্ধ বিশ্বাসের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো। তবে এই ঘটনাগুলির পেছনে মূল দায়ী ছিলেন ধর্মান্ধ খ্রিস্টান ধর্মীয় যাজক তথা গুরুদেবেরা। সেই সকল অসৎ মানুষের কুমন্ত্রণার কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছিল শতাধিক শিশুর।
বিকৃত মস্তিষ্ক হওয়ার কারনেই এই সকল জিনিস ঘটত বলে পরবর্তীকালে একাধিক রিপোর্ট বেড়িয়েছিল। যদিও জার্মানিতে এরকম একাধিক ঘটনা ঘটেছিল যার সঠিক প্রমান পাওয়া দুস্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
একাধিক তথ্য নির্ভর লেখা এই নিয়ে প্রচুর মতামত রয়েছে।