ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলা
পুলিশ সূত্র অনুযায়ী, এক রাজনৈতিক সন্দেহভাজন ব্যাক্তি ১৯২৫ সালের ৭ নভেম্বর কয়েকজন তরুণ আগন্তুকের সাথে কাশীপুরের দিকে যাচ্ছিল। এরপর তাঁরা একটা ট্যাক্সিতে করে বরানগরে নেমে কিছুটা পথ রিক্সায় তারপর কিছুটা পথ হেঁটে পৌঁছেছিল দক্ষিণেশ্বরের সেই বাড়িতে। আর এই যাত্রায় তাদেরকে অনুসরন করেছিল এক ব্যাক্তি। এরপর পুলিশ ওই ট্যাক্সির নাম্বার নোট করে। সেই সূত্র ধরে জবানবন্দীর মাধ্যমে পুলিশ সন্ধান পায় বিপ্লবীদের এই গুপ্ত আস্তানার।
তবে বিপ্লবী বীরেন ব্যানার্জি বা হরিনারায়ণ চন্দ্রর বক্তব্য অনুযায়ী, ওই সময় কয়েকজন বিপ্লবী বন্ধু জ্বরে ভুগছিল দক্ষিণেশ্বরের এই বাড়িতে এবং অন্যদিকে ওই সময়ই তাঁদের আরেক বিপ্লবী বন্ধু ধ্রুবেশ চ্যাটার্জি শোভাবাজারের বাড়িতে জ্বরে ভুগছিল।
ওই সময় ধ্রুবেশের দেখভাল করার জন্য বীরেন ব্যানার্জি এবং অনন্তহরি মিত্র উভয়ে মিলে শোভাবাজার থেকে দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে আসতে যায়। সেই সময় তাঁরা কাশীপুরে ট্যাক্সি ছেড়ে কিছুটা পথ রিক্সায় আর কিছুটা পথ হেঁটে পৌঁছেছিল দক্ষিণেশ্বরের সেই বাড়িতে। এই পথ অনুসরন করে পুলিশ ১০ নভেম্বর ভোর সাড়ে ছয়টার সময় হানা দেয় দক্ষিণেশ্বরের এই বাড়িতে। পুলিশের এই অভিযানে সর্বপ্রথম পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল নিমাই দে, তবে তাঁর আসল নাম ছিল রাখাল দে যা পরবর্তী সময়ে জানা যায়। এরপর উপরের তলায় উপস্থিত থাকা সকল বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে চারজন অসুস্থ থাকা বিপ্লবীকেও গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। দক্ষিণেশ্বরের এই বাড়ি তল্লাশি করে পুলিশ এখান থেকে উদ্ধার করেছিল একটা আলমারিতে থাকা তাজা বোমা, কতগুলি সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড আর গ্লিসারিনের বোতল, ছয় চেম্বারের গুলিভর্তি রিভলবার, একটা সাত কার্তুজের পিস্তল, একটি বই যাতে লেখা ছিল বোমা তৈরির বাহাত্তরটি উপাদানের মিশ্রণ প্রণালী। এখান থেকে উদ্ধার করা বোমা, মুখ্য বিস্ফোরক ইন্সপেক্টর রবসন জলে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ওই একই দিনে দুপুর ২টো নাগাদ শোভাবাজারের বাড়িটি ঘিরে ফেলে পুলিশে। সেখান থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে প্রমোদ চৌধুরি এবং অনন্ত চক্রবর্তীকে।
এরপর শুরু হয়েছিল তদন্ত। ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের এই তদন্তের মাধ্যমে উঠে এসেছিল বিপ্লবীদের কার্যকলাপের বেশ কিছু তথ্য এবং তার সাথে জানতে পেরেছিল যে এই দল গোপনে এক বিরাট ষড়যন্ত্রের জাল বুনে ছিল।
দক্ষিণেশ্বরের এই বাড়িতে অস্ত্রের আমদানি হত যা বিদেশ থেকে চোরাপাচারের মাধ্যমে আসত। হরিনারায়ণ চন্দ্র অস্ত্র পাচারের জন্য বিভিন্ন বিদেশী জাহাজে ইলেক্ট্রিশিয়ান, কেরানি বা পর্যবেক্ষকের পদে কর্মরত ভারতীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুধাংশু চৌধুরির উপর। নির্মল সেনকে রেঙ্গুনে অস্ত্র আমদানির জন্য পাঠানো হয় এবং দেবেন দে’কে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সুধাংশু চৌধুরি দুই বিপ্লবী এবং কলকাতায় বীরেন ব্যানার্জির সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতেন। অন্যদিকে এস.এস. আরাঙ্কালা জাহাজের কেরানি ফণীন্দ্র বসু আর এস.এস এডভান জাহাজের পর্যবেক্ষক আজমাত আলির প্রচেষ্টায় সংগৃহীত হয়েছিল পিস্তল এবং অন্যান্য অস্ত্র। এছাড়াও নির্মল সেন একটি রিভলবার রেঙ্গুনের পুলিশ কমিশনারের অফিস থেকে চুরি করেন। কলকাতায় বীরেন ব্যানার্জির কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সুধাংশুর হাতে দেওয়া হয়েছিল এই রিভলবারটি।
এছাড়াও তাঁরা নাকি জাপানে রাসবিহারী বসুর সাথে যোগাযোগ করে সেখান থেকে ভারতীয় মুদ্রার বিনিময়ে গোপনে বেশ কিছু অস্ত্র-শস্ত্র আমদানি করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করার কারণে ভেস্তে গিয়েছিল সমস্ত পরিকল্পনা এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল সমস্ত বিপ্লবী শাখা-সংগঠনগুলি।
মি. জে.ডব্লিউ. নেলসন, মি. মুজফ্ফর আহমেদ এবং রায়বাহাদুর সুরেশচন্দ্র সিন্হার নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকার ‘বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেণ্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯২৫’ ধারায় বিশেষ একটি ট্রাইবুন্যাল গঠন করেছিল দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। সেই সময় সারা বাংলা জুড়ে জনমত গড়ে ওঠেছিল ব্রিটিশদের গোপনে মামলা রুজু করা বা গোপনে তার প্রক্রিয়াকরণ চালু রাখার বিরুদ্ধে। জনগন দাবি করেছিল যে উন্মুক্ত আদালতে উপযুক্ত পদ্ধতিতে বিচার হোক এই মামলার সাথে জড়িত থাকা অভিযুক্তদের। এই সময় জনরোষের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশ সরকার এই মামলা চলাকালীন এর সঙ্গে যুক্ত বিচারক, পুলিশ প্রমুখের সুরক্ষার জন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করেছিল –
১) একজন সার্জেন্ট বন্দীদের গরাদের সামনে মোতায়েন করা থাকবে এবং আরেকজন সার্জেন্ট মোতায়েন করা থাকবে ঘরের সামনে ঢোকার আগে।
২) উকিলের অনুমতি ছাড়া আদালতকক্ষে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
৩) কেবলমাত্র প্রবেশাধিকার ছিল বন্দীদের আত্মীয়দেরই।
৪) আদালতে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে ভালো করে সার্চ করা হতো সমস্ত বন্দিদের। যদি কারো মল-মূত্রত্যাগের প্রয়োজন পড়তো তখন তাদেরকে একজন সার্জেন্ট যথাস্থানে নিয়ে যেতেন এবং আদালতে ঢোকার পূর্বে পুনরায় ভালোমতো সার্চ করা হত সমস্ত বিপ্লবীদের।
৫)বাইরের কোনোরকম কোনো খাবার জেলের ভিতর বন্দীদের জন্য নিয়ে আসা নিষেধ ছিল।
৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করা হয়। এই রায়ে হরিনারায়ণ চন্দ্র, অনন্তহরি মিত্র এবং রাজেন লাহিড়িকে দশ বছরের কারাদণ্ডের দণ্ডিত করা হয়, পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের দণ্ডিত করা হয়েছিল বীরেন ব্যানার্জি, নিখিলবন্ধু ব্যানার্জি এবং ধ্রুবেশ চ্যাটার্জিকে। এছাড়া তিন বছরের জন্য দণ্ডিত করা হয়েছিল দেবীপ্রসাদ চ্যাটার্জি ও শিবরাম চ্যাটার্জিকে। সকল বিপ্লবীর শাস্তি মেয়াদ কমানোর আবেদন করা হয়। এই আবেদনে শুধুমাত্র রাজেন লাহিড়ির দশ বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছিল আর বাকিদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। এই বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়েই ২৮ মে ১৯২৬ সালে বিপ্লবীরা মিলে নিউ আলিপুর কেন্দ্রীয় জেলের মধ্যেই একটা লোহার তীক্ষ্ণ রড দিয়ে আই.বি অফিসার ভূপেন চ্যাটার্জিকে হত্যা করেন। ভূপেন চ্যাটার্জিকে হত্যা করার সময় সেখানে পাঁচজন বিপ্লবী উপস্থিত ছিলেন। যার ফলে তাদের মধ্যে কে প্রকৃত হত্যাকারী সেটা বের না করতে পেরে পুলিশ ইচ্ছেমতো ভূপেন চ্যাটার্জিকে হত্যা করার জন্য দুজনকে অভিযুক্ত করেছিল এবং বাকি তিনজনকে এই কাজে সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছিল। ১৯২৬ সালের ৯ আগস্ট বিচারে অনন্তহরি মিত্র ও প্রমোদ চৌধুরীর ফাঁসি আদেশ দেওয়া হয় এবং বাকিদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়।
বিচার চলাকালীন ১২ নভেম্বর দৈনিক বসুমতী পত্রিকার লেখা হয় যে, একটি মাত্র বোমা আবিষ্কার করে পুরো বাড়িটিকে দক্ষিণেশ্বরের বোমা কারখানা বলে দেগে দেওয়া যায় না। এর পরের দিন ১৩ নভেম্বর আরও এক পত্রিকায় লেখা হয় যে, সমস্ত দেশবাসী যাতে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে উত্তাল না হয়, এই কারণেই গোপন রাখা হয়েছিল সমস্ত বিচার প্রক্রিয়া।