টয়লেটের কারনেই বিস্ফোরণ ঘটত। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের টয়লেট ব্যবস্থা কতোটা বিপদজনক ছিল?
আধুনিক যুগে সবচেয়ে বেশি চর্চিত প্রাচীন সভ্যতাগুলি মধ্যে অন্যতম ছিল প্রাচীন রোম। প্রায় ২ হাজার বছরের এই সাম্রাজ্যের পাশাপাশি গবেষকদের চর্চার বিষয় ছিল সেই সময়ের তৈরি স্থাপত্যগুলিও। হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেলে তাদের তৈরি বিশাল স্থাপত্যগুলির মধ্যে বেশ কিছু স্থাপত্যের অস্তিত্ব মেলে বর্তমান দিনেও।
সেই সময়ে রোমানদের তৈরি চমৎকার সৃষ্টিগুলি মধ্যে অন্যতম ছিল পাবলিক টয়লেট। আর এই পাবলিক টয়লেটে ছিল জলের প্রবাহের ব্যবস্থাও। তাই তারা যে চমৎকার নির্মাতা ছিলেন তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই পাবলিক টয়লেটগুলি নির্মাণ করার পিছনে মূল লক্ষ্য ছিল রোমের মতো বড় রোমান শহরগুলিতে স্বাস্থ্যবিধি উন্নত করা। তবে এই পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে প্রাচীন রোমের মানুষরা ভয় পেত। তাদের মনে মধ্যে ভয়ের পাশাপাশি বাসা বেঁধেছিল কুসংস্কারেরও যার কারনে তারা টয়লেট থেকে জীবিত বের হওয়ার জন্য যাদু মন্ত্র পাঠ করত। কিন্তু কেন সেই সময়কালের এত অত্যাধুনিক আবিষ্কারকে ব্যবহার করতে সেখানকার মানুষ ভয় পেত?
শহরের এই পাবলিক টয়লেটে জলের সরবরাহের করার জন্য রোমানরা ড্রেনেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে শহর থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরের ঝর্ণার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছিল। রোমান শক্তির প্রতিক ছিল এই জলপ্রবাহিত ড্রেন। ঝর্ণার প্রবাহিত এই জলের ফোয়ারা তারা ব্যবহার করত তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজে যেমন- পান করা, স্নান করা এবং টয়লেট শেষে পশ্চাৎদেশ পরিষ্কার করা ইত্যাদি। প্রায় ২০০০ বছর আগে পাবলিক টয়লেটে জলের প্রবাহের ব্যবস্থা থাকার ঘটনাটি ছিল সত্যিই চমৎকার ও আশ্চর্যজনক।
রোমান পাবলিক টয়লেটগুলো তৈরি করা হতো একটি বিল্ডিং এর মধ্যে। সেখানে অনেক গুলো ছোট ছোট গর্ত তৈরি করা হত মলত্যাগ করার জন্য এবং বসার জন্য ছিল অনেক জায়গা। এই টয়লেটের নীচ দিয়ে প্রবাহিত হত ঝর্ণা বা জলাশয় থেকে আনা জল। এর ফলে প্রস্রাব এবং মল সাথে সাথেই পরিষ্কার হয়ে চলে যেত। তাত্ত্বিকভাবে সেই সময়কালে এই অত্যাধুনিক সৃষ্টিতে এতো অসাধারণ সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সেখানকার মানুষজন এই পাবলিক টয়লেট ব্যবহারে ভয় পেত। তাদের মনে মধ্যে ভয়ের পাশাপাশি বাসা বেঁধেছিল কুসংস্কারেরও যার কারনে তারা সেখান থেকে জীবিত বেরিয়ে আসার জন্য যাদু মন্ত্র পাঠ করত এবং লাকি চার্ম ব্যবহার করত।
শুরুর দিকে, খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল এই পাবলিক টয়লেটগুলি এবং যেই বিল্ডিং এর মধ্যে এই পাবলিক টয়লেটগুলো তৈরি করা হতো তার ছাদ খুবই নিচু ও জানালাগুলো খুব ছোট ছিল। যার কারনে সেখানে বাইরের আলো খুব একটা প্রবেশ করতে পারত না। এই টয়লেটগুলো খুবই অপরিষ্কার থাকত কারন কখনো কেউ পরিষ্কার করত না। টয়লেট এর মলমূত্র ত্যাগ করার গর্ত খুব ছোট হওয়ার কারনে মল ত্যাগ করতে গিয়ে গর্তে ফেলার বদলে উপরেই মলত্যাগ করে ফেলত। বর্তমান দিনে প্রত্নতাত্ত্বিকদের আবিষ্কার করা রোমান পাবলিক টয়লেটগুলো ছিল সাদা মার্বল পাথরের তৈরি। তবে পরিষ্কার না করার কারনে ময়লা এবং নোংরা জমে জমে সাদা মার্বেল পাথরের রঙই তারা বদলে দিয়েছিল। যার ফলে বেশিরভাগ রোমানদের ভাগ্য হয়নি সেই সাদা মার্বেল পাথরের টয়লেট দেখার। রোমান পাবলিক টয়লেটগুলো অপরিষ্কারাচ্ছন্ন হওয়ার কারনে সেখানে ইঁদুর, সাপ, মাকড়শার ইত্যাদি থাকত। যার ফলে টয়লেট করতে গিয়ে রোমানদের ইঁদুর, সাপ, মাকড়শার আক্রমণের শিকার হতে হত। আবার ময়লা আবর্জনা এবং পচনশীল নর্দমা থেকে সৃষ্টি হত মিথেন গ্যাস যার ফলে মাঝে মধ্যে পাবলিক টয়লেট গুলোতে আগুনে বিস্ফোরণ হওয়ার ঘটনাও ঘটত।
রোমান বাট ব্রাশ- মলত্যাগের পরে মলদ্বার পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার করা হত জাইলোস্পনজিয়াম (ল্যাটিন ভাষায় একটি লাঠিতে থাকা স্পঞ্জ)। এটি ছিল ইদুর, সাপ কিংবা মিথেন গ্যাসের বিস্ফোরণের থেকেও বেশি বিপজ্জনক। জাইলোস্পনজিয়াম একটি মৃদু এবং সহজ হাতিয়ার ছিল যাতে একটি লাঠিতে একটি সামুদ্রিক স্পঞ্জ রাখা ছিল। এটি মলত্যাগের পরে মলদ্বার পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার করা হত।সহজ ভাষায় বললে, রোমানদের বাট ব্রাশ ছিল জাইলোস্পনজিয়াম। একটু যদি রসিকতা করে বলি তাহলে জাইলোস্পনজিয়াম ছিল একটি আধুনিক টয়লেট ব্রাশ যা শুধুমাত্র টয়লেট পরিষ্কার করার কাজেই ব্যবহৃত করা হত।এই জাইলোস্পনজিয়াম একজন ব্যবহার করার পর সেটিকে একটি ভিনেগার বা লবণ জলে ভরা বালতিতে রেখে দিত। এরপর ওই একই জাইলোস্পনজিয়াম অন্য ব্যক্তিরাও ব্যবহার করতে পারে।
বলা বাহুল্য যে, রোমানরা কৃমি এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পিছনে অন্যতম একটি কারন হল এটি।
প্রতিদিন গড়ে আমাদের শরীর মলত্যাগ করে ১২৮ গ্রাম (৪.৫ আউন্স)। রোম শহরে নাগরিক সংখ্যা ছিল প্রায় ১ মিলিয়নেরও বেশি। সেই জনসংখ্যা অনুযায়ী হিসাব করলে সেই শহরে প্রতিদিন গড়ে ১২৮ টন মল তৈরি হয়েছিল। ধনী রোমানরা তাদের রাস্তায় মল দেখতে না চাওয়ার কারনে তারা তৈরি করেছিলেন পাবলিক টয়লেট। বলা বাহুল্য যে, এই পাবলিক টয়লেটে পা রাখেনি রোমান উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা। আসলে এই পাবলিক টয়লেটগুলি ছিল নিম্নবিত্ত ও দাসদের জন্য। তবে তারাও মাঝে মধ্যে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করত। তবে এই পাবলিক টয়লেট গুলো মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি হওয়ার কারনে সবসময় খুব ঠান্ডা থাকত। তাই তাদের যাতে ঠাণ্ডা না লাগে তার জন্য ধনী রোমানরা পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করার আগে জায়গা গরম করার জন্য তাদের দাস বা চাকরদের কিছুক্ষণ পাবলিক টয়লেটে বসিয়ে রাখত। সাধারণত ধনী রোমানরা মল ত্যাগ এবং প্রস্রাব করার জন্য তাদের ভিলায় ল্যাট্রিন ব্যবহার করত না। এর জন্য তারা পাত্র ব্যবহার করত যা ছিল একটি সহজ উপায়।
ক্লোয়াকা ম্যাক্সিমা ছিল একটি অসাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়, রোমের ক্লোয়াকা ম্যাক্সিমা ছিল রোমান ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণগুলির মধ্যে একটি। এই ড্রেনের মধ্যে দিয়ে পাবলিক টয়লেট ও রোমের সকল নর্দমা প্রবাহিত হত। এই সম্পর্কে রেমান এক লেখক প্লিনি দ্য এন্ডার বলেছিলেন যে প্রাচীন রোমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জিনিস ছিল এটি। রোমের নাগরিকদের কাছে ক্লোয়াকা ম্যাক্সিমা ছিল পবিত্র। ক্লোয়াকা ম্যাক্সিমা ১৮ শতকে একটি পর্যটক আকর্ষণ হয়ে ওঠেছিল।
সবশেষে কিছু কথা, সেই সময়ে রোমানরা পাবলিক টয়লেট এবং সেই পাবলিক টয়লেটে জলের প্রবাহের ব্যবস্থা করে চমৎকার নির্মাতা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই পাবলিক টয়লেট গুলি নির্মাণ করার পিছনে মূল লক্ষ্য ছিল রোমের মতো বড় রোমান শহরগুলিতে স্বাস্থ্যবিধি উন্নত করা, তবে এই পাবলিক টয়লেটগুলি ছিল স্বাস্থ্যের দিক থেকে খুবই ঝুকিপূর্ণ। বলা যেতে পারে যে, এই রোমান পাবলিক টয়লেটগুলি ছিল সংক্রামক রোগের প্রজনন ক্ষেত্র।