ক্রীতদাসের সন্তান হয়েও রোমে শিক্ষক হয়েছিলেন যে ব্যক্তি
একজন ক্রীতদাসের সন্তান হয়ে রোমের সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু সেই কঠিন কাজকে বাস্তবায়ন করে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখেছিলেন সম্রাট পার্টিনাক্স। এক কথায় বলা যায় প্রাচীন মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করত তাদের জন্ম। কোন ব্যক্তি কোন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে জন্মগ্রহণ করছে সেই হিসেবে নির্ধারিত হত তাদের আগামী জীবন। কিন্তু পার্টিনাক্স একজন ক্রীতদাসের সন্তান হয়েও তিনি রোমের স্কুলের একজন ব্যাকরণের শিক্ষক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাহলে একটু পরিষ্কার করেই বলা যাক তার গোটা জীবন কাহিনী।
একদা একসময় বিশৃঙ্খলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল রোম সাম্রাজ্য। তখন সকলকে উপেক্ষা করে সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার সামলে ছিলেন পার্টিনাক্স। রোমের নিষ্ঠুরতম সম্রাট তথা শাসক কমোডাসের উত্তরসূরি ছিলেন পার্টিনাক্স। তার পুরো নাম ছিল পাবলিয়াস হেলভিয়াস পার্টিনাক্স। সেই সময়ের আইন অনুযায়ী শাসক শ্রেণীর ছেলে মেয়েরাই সাম্রাজ্যের কনসাল সিলেটর কিংবা সম্রাট হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু পার্টিনাক্স শাসক শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ করেননি। উপরন্তু তার বাবা ছিলেন একজন ক্রীতদাস। সেই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে নানান ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করেও নিজেকে সাম্রাজ্যের শাসন সামলানোর উপযুক্ত করেছিলেন তিনি। কুখ্যাত সম্রাটের মৃত্যুর পরেই সাম্রাজ্যের শাসনভারের দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। যদিও সেটা বেশি দিনের নয় সেই শাসনভারের দায়িত্ব ছিল মাত্র তিন মাসের জন্য।
রোমের কুখ্যাত সম্রাট কমোডিয়াস নিজের শাসনকালে কোনদিনই সাম্রাজ্যের উপর মনোযোগী ছিলেন না। কারণ তিনি বরাবরই নিজের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতেন। এমনকি সাম্রাজ্যের সব কিছুতেই নিজের বলে দাবি করেছিলেন। নিজের শক্তির জাহির করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে বছরের বারো মাসের নাম নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছিলেন তিনি। রোম নগরীর নাম পরিবর্তন করেছিলেন। এছাড়াও তার শক্তির বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করে দিয়েছিলে। কিন্তু তারপরও শত্রুদের হাতেই হত্যা হয়েছিল রোমের নিষ্ঠুর শাসক কমোডিয়াসের। তার মৃত্যুর পরেই রোমের শাসনভার পেয়েছিলেন পার্টিনাক্স। তিনি যেমন বিশৃঙ্খল রোমকে শৃঙ্খলা বদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন সেরকমই শাসনের একটি দৃষ্টান্ত সকলের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন তিনি।
এক নজর দেখে নেওয়া যাক পার্টিনাক্স এর প্রারম্ভিক জীবন এবং ক্ষমতায় উত্থানের ইতিহাসে। ১২৬ খ্রিস্টাব্দে রোম সাম্রাজ্যের আলবা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পার্টিনাক্স। মায়ের নাম জানা না গেলেও সেই সময় তার বাবা হেলভিয়াস সাকসেসাস ছিলেন একজন ক্রীতদাস। যদিও পরবর্তীতে অর্থাৎ বেশ কয়েক বছর পর তিনি একজন উল ব্যবসায়ী হিসেবে সু-প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। যেহেতু পার্টনাক্সের বাবা একজন ক্রীতদাস ছিলেন তাই তিনি নিজের জীবনে পড়াশোনা সুযোগ না পেলেও নিজের ছেলেকে যথেষ্ট শিক্ষার আলো দেখিয়ে ছিলেন। আর তখন অর্থাৎ ছেলের শিক্ষা লাভের সময় যেহেতু তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন এবং তার কাছে যথেষ্ট অর্থ ছিল তাই পার্টনাক্স ভালোভাবে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের জীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতার মধ্যে দিয়ে। পার্টিনাক্স প্রথমে একটি স্কুলে ব্যাকরণের শিক্ষক হিসেবে নিজের শিক্ষকতার জীবন শুরু করেছিলেন। প্রায় নিজের ৩৫ বছর বয়সে শিক্ষক হিসেবে বিরক্ত হয়ে ওঠার কারণে রোমের সেনাবাহিনীতে ১৬০ সালে যোগদান করেছিলেন পার্টনাক্স। মূলত একঘেয়েমি দূর করতেই এই যোগদান করেছিলেন তিনি। আগেই বলা হয়েছে শাসক শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ না করলে রোমান আইন অনুযায়ী কোন উচ্চ পদে সাধারণ মানুষের যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট সচ্ছল ছিলেন পার্টিনাক্স। তাই অর্থের জোরে নিজের পূর্ব কোন সামরিক অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও রোমান সাম্রাজ্যের সিরিয়ার একটি গ্যালিক সৈন্যদলের কমান্ডর পদে চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। এমনকি সেনাবাহিনীতে যোগদান করার পরপরই নিজের গুণ এবং বুদ্ধিমত্তার জেরে ১৬৬ সালে চলা পার্থিয়ান যুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। যুদ্ধ ময়দানে এতটাই সুকৌশলীতা প্রদর্শন করেছিলেন যে সেনাবাহিনীতে যোগদান করার অল্প সময়ের মধ্যেই তার পদোন্নতি হয়েছিল। সে কারণেই পার্টিনাক্সকে সেনাপ্রধান করে তখনকার সময়ের রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের নিরাপত্তার জন্য তাকে হাঙ্গেরির দানিউব নদীর সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থানান্তর করে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়কার রোমান সম্রাট রোম সেনাবাহিনীদের সঙ্গে জার্মান মার্কোমানি উপজাতিদের নিয়ে যুদ্ধের পরিচিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে সম্রাট অরেলিয়াসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার জেরে তার সঙ্গে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল পার্টিনাক্সের। তার উপর সমাজে এতটাই বিশ্বাসযোগ্যতা জন্মেছিল যে ১৭৫ সাল নাগাদ সম্রাট তাকে রাজ্যের দূত হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পাশাপাশি সিরিয়া, দামেস্ক ও ব্রিটেন সহ বেশ কিছু দেশের গভর্নরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন পার্টিনাক্সকে।
পরবর্তীতে অবশ্য মৃত্যু হয়েছিল রোমান সম্রাট অরেলিয়াসের। সম্রাটের মৃত্যুর পরেই সিংহাসনে বসেছিলেন তার ছেলে কমোডিয়াস। যদিও তিনি ছিলেন তার বাবার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সাম্রাজ্যের দিকে নজর দেওয়ার পরিবর্তে নিজের শক্তি বৃদ্ধিতে বেশি মনোযোগ দিতেন তিনি। অর্থাৎ এক কথায় বলা চলে এর রোমান সম্রাটের ভগবান বলেই নিজেকে দাবি করতেন। মাঝেমধ্যে নিজে শক্তি প্রদর্শনের জন্য প্রচন্ড শক্তিশালী হারকিউলাসের অবতার হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন কমোডিয়াস। এছাড়াও সাম্রাজ্যের বাসিন্দাদের নিজের শক্তির প্রদর্শনী দেখানোর জন্য দুর্বল ও আহত গ্লাডিয়েটরদের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করতেন তিনি। এখানে বলে রাখা ভালো সেই সময় সাধারণ মানুষদের মধ্যে গ্লাডিয়েটরদের যথেষ্ট সুনাম ছিল। উচ্চবৃত্তরা গ্লাডিয়েটরদের যুদ্ধ থেকে আনন্দ উপভোগ করলেও তাদের সম্মান করতেন সাধারণ মানুষ। সেই কারণে দুর্বল ও আহত গ্লাডিয়েটরদের নিয়ে কলোসিয়ামের যুদ্ধ করাটা মোটেই ভালো চোখে দেখেননি সাধারণ মানুষেরা। বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন সম্রাটের উপর। বিশেষ করে গ্লাডিয়েটরদের সঙ্গে কমোডাসের যুদ্ধ কখনোই সমান্তরাল হতো না। এক কথা বলতে গেলে জনগণ রোমান সম্রাটের উপর বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন।
পরবর্তীতে ১৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে খাবারের মধ্যে বিষ প্রয়োগ করে কমোডাসের হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন তার প্রেমিকা। যদিও সেই পরিকল্পনার জেনে যাওয়ার পর বমি করে সমস্ত বিষ নিজের পেট থেকে বের করে দিয়েছিলেন কমোডাস। এরপরই সম্রাটের কুস্তি সঙ্গী নার্সিসাসকে সম্রাটের স্নানের সময় পাঠিয়ে তাকে শাসক করে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন চক্রান্তকারীরা। সেই মোতাবেক সম্রাটের হত্যার পর তার মৃত্যু নিশ্চিত হতেই সিনেটররা কমোডাসকে রোম সাম্রাজ্যের শত্রু ঘোষণা করে তার মূর্তি ভেঙে দিয়েছিলেন। ফিরিয়ে এনেছিলেন রোমের পুরনো নাম। এরপরই খালি হয়ে গিয়েছিল সিংহাসন। আগামী রোমান সম্রাটকে হবে সেই বিষয়টি কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল নানা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছিল বিশৃঙ্খলা। সেই সময় রোমের প্রধান সিনেটর লেটাস, ইলেক্টাস এবং মার্সিয়া পার্টিনাক্সের কাছে গিয়ে তাকে সিংহাসনের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও সেই সময় রাজনীতিতে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন পার্টিনাক্স।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সিংহাসনে বসতে গেলে আগে রক্ষীদের মন জয় করতে হবে। কারণ রক্ষীরা সম্রাটের বিপরীতে থাকলে যে কোন মুহূর্তে শত্রুপক্ষ তাকে হত্যা করতে পারে। সেই কারণেই রক্ষীদের মোটা অর্থের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। এরপরই তারা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে সেনেটের কাছে গেছিলেন। এই বিষয়ে কমোডাসের বিপরীতে থাকা সিনেটররা খুশি হলেও কমোডিয়াসের সাথে গ্ল্যাডিয়েটর গেমসে অংশগ্রহণকারী সিনেটররা যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন।