অফবিট

সুন্দরী বিষ কন্যা। এরা কারা জানেন?

বর্তমানে বিষকন্যা পৌরাণিক গল্প গাথা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বহু পূর্বে আনুমানিক চাণক্যের সময়ে বিষ কন্যা বাস্তবে ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর একটি গল্প এই প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়েছে যেখানে মোহিনী রূপে আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন এক বিষ কন্যা।

ষোড়শ শতাব্দীর এক গ্রন্থ অনুযায়ী বলা হয়েছে যে, যীশু খ্রীষ্টের জন্মের বহু পূর্বে রাজারা বিষ কন্যাদের ব্যবহার করতেন শত্রুপক্ষকে হত্যা করার জন্য। না পারলে কৌশলের মাধ্যমে বিষ কন্যাকে ব্যবহার করেই নিজেদের শত্রুকে দমন করতেন রাজারা। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় অৰ্থশাস্ত্র’ প্রণেতা চাণক্যও রাজাকে সাবধান করে বলেছিলেন, “অচেনা রমণীদের ব্যবহারের আগে ধুয়ে নিতে হবে তাদের উরু। কারণ হতেই পারে, তারা বিষকন্যা!”

একটি গল্পে এমনও লেখা রয়েছে যে,  জন্ম থেকেই কোন শিশু কন্যা বিষ কন্যা রূপে জন্মাতো না। পুরো রাজ্য থেকে বাছাই করা সদ্য জন্মানো কণ্যা শিশুদের নিয়মিত বিষ খাওয়ানোর আদেশ দিতেন এক রাজা। এক জন ছাড়া মারা গেল তাদের সকলেই। আর প্রতিদিন বিষপানে বেঁচে থাকা সেই একটি মেয়ে এক সময়ে হয়ে উঠতো চোখ-ধাঁধানো সুন্দরী এক বিষকন্যা। এক দিন দলবল-সহ যুদ্ধে বন্দি হয়ে, বিষকন্যাকে শত্রু শিবিরে বীণা বাজাতে পাঠালেন আক্রান্ত রাজা। সেই মেয়ের রূপ যেন এক আগল ভাঙা প্লাবন! মুগ্ধ শত্রু-রাজা তাকে ডাকলেন নিজস্ব আড়ালে। তার পরে যেই তাকে কাছে টেনে তার ঠোঁটে রাখলেন অধৈর্য চুম্বন, মারা গেলেন নিজে। এই পদ্ধতিতেই চলত শত্রু দমনের  ক্রিয়া।

বিষ কন্যাদের শরীরের ভেতরে বিষ থাকলেও তাদের রূপ কোন অপ্সরা থেকে কম ছিলনা। বিষ কন্যাদের এই রূপকে ব্যবহার করত রাজারা। কখনো উপহার হিসেবে তো কখনো নর্তকী হিসেবে শত্রু পক্ষকে বিষকন্যা উপহার দিতেন তাদের প্রতিপক্ষ। আর সিংহভাগ পুরুষের কমজোরই হল নারী। সেক্ষেত্রে বিষকন্যার রূপে মোহিত হয়ে যখনই তার সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করতেন তখনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরতেন রাজারা। এক কথায় বলতে গেলে রাজনৈতিক পরিসরেই রাজকন্যাদের ব্যবহার করা হতো।

এছাড়াও এমন বেশ কয়েকটি সত্য ঘটনা রয়েছে যেখানে বিষ কন্যাদের ভূমিকা দেখা গিয়েছে। সেই সত্য ঘটনাই এই প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়েছে।

*মহাবীর  আলেকজান্ডার ও বিষকন্যা :-  গ্রীক মহাবীর আলেকজান্ডার পারস্যের রাজা দারায়ুসকে পরাজিত করে ভারত সীমান্তে উপস্থিত হয়েছিলেন। তখন সীমান্তের রাজা আলেকজান্ডারকে অভ্যর্থনার খাতিরে ৫ জন সুসজ্জিত তরুণীকে উপঢৌকন হিসেবে রাজার সামনে হাজির করেছিলেন। কিন্তু রাজা আলেকজান্ডার জানতো না পঞ্চম কন্যাটি ছিলেন বিষকন্যা। তাদের সাথে আরো ছিল ঘোড়া বিভিন্ন উপহারের ঢালির সাথে পাঁচ সহচর। যেহেতু সব কন্যার মধ্যে বিষ কন্যাই ছিলেন রূপবতী তাই  প্রথমে পঞ্চম কন্যাটিকে নিজের কক্ষে ডেকে ঘনিষ্ঠ হতে গিয়েছিলেন রাজা। রাজা দূরদৃষ্টি খুব একটা না থাকলেও তার শিক্ষক এরিস্টটল ছিলেন বহুদর্শী প্রাজ্ঞ। অর্থাৎ কোন মানুষ কি রকম তিনি এক নজরেই বুঝে যেতে পারতেন। 

পরবর্তীতে আলেকজান্ডারের শিক্ষক তাকে এগোতে নিষেধ করেছিলেন এবং স্পষ্টভাবেই তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ওই পঞ্চম কন্যাই হলো বিষ কন্যা। আলেকজান্ডার বিষয়টি যাচাই করতে তার দুই দেহ রক্ষীকে চুম্বন করতে বলেছিলেন রূপসীর সঙ্গে। এরপরই তারা চুম্বন করতেই মাটিতে লুটিয়ে পরেছিল। এরপর তার বেশ কয়েকটি পশুর সঙ্গে একই রকম ঘটনা ঘটায় আলেকজান্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে তার তলোয়ার বের করে দু’ভাগ করে দিয়েছিলেন বিষ কন্যাকে। এরপরই তাকে পুড়িয়ে ভষ্মে পরিণত করেছিলেন তিনি। 

* চন্দ্রগুপ্ত, চাণক্য ও বিষকন্যা :-  চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য রাজার বীরত্বের কাহিনি কারোর অপরিচিত নয়। তবে এই চন্দ্রগুপ্তের শিক্ষক ছিলেন তুখর বুদ্ধিশীল ও চতুরাইতে দক্ষ অন্যতম শিক্ষক চাণক্য। শিক্ষকের কথা শুনে প্রত্যেক পদক্ষেপ এগোতেন চন্দ্রগুপ্ত। যার কারণে অল্প বয়সে মৌর্য সাম্রাজ্য ধরে রাখতে পেরেছিলেন তিনি। তবে সিংহাসনে বসে প্রজাদের রাজা হয়েও শান্তি ছিল না তার মনে। কারণ চারিদিকে শত্রুরা তাকে ঘিরে ধরতো সব সময়। বিশেষ করে চাণক্যের মতে চন্দ্রগুপ্তকে তার শত্রুরা শেষ করতে পারতো একমাত্র বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে। তাই আগামী দিনে যাতে বিষের জন্য চন্দ্রগুপ্তকে প্রাণ না দিতে হয় তাই প্রত্যহ চন্দ্রগুপ্তের অজান্তে তার খাবারে সামান্য পরিমাণে বিষ মিশাতেন চাণক্য নিজে। যাতে একটু একটু করে চন্দ্রগুপ্তের শরীর বিষ সহ্য করার ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। আর সেই রকমই হত। কিন্তু হঠাৎই  একদিন চন্দ্রগুপ্ত তার গর্ভবতী স্ত্রীর সঙ্গে নিজের খাবার ভাগ করে খেতেই দেখা দিল ঘোর বিপদ। বিষের জন্য মাটিতে লুটিয়ে পরলো তার স্ত্রী। তখনই চাণক্যকে খবর দিতেই গর্বের থেকে শিশুকে বাঁচাতে পারলেও তার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি শিক্ষক। কিন্তু বিষের কারণে শিশুর মাথায় একটি নীল গোল দাগ তৈরি হওয়ার জন্যই আগামী দিনে তার নাম হয়েছিল বিন্দুসার।

সেই মর্মান্তিক ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর আর এক বার ধননন্দের ক্ষমতালোভী, কুচক্রী মন্ত্রী রাক্ষস, চন্দ্রগুপ্তের কাছে পাঠিয়েছিল এক বিষকন্যাকে। কিন্তু এই বিষয়টি চাণক্যের নজরে পরতেই চন্দ্রগুপ্তের চৌহদ্দি থেকে বিষকন্যাকে চাণক্য পাঠিয়ে দিয়েছিলো যুদ্ধে, মিত্র অথচ আকাঙ্ক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বী পর্বতকের দরজায়। সবার মত সেই একই ভুল করেই মারা গিয়েছিলেন পর্বতকও। এই কাহিনীকে অবলম্বন করে বিশাখদত্তের রাজনৈতিক নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’ তৈরি হয়েছিল।

*পিলপাইয়ের সুখ্যাত উপকথা :-  পারসিক উপকথাতেও একটি বিষ কাহিনীর কথা উল্লেখ করা রয়েছে। তবে এই কাহিনীতে বিষ কন্যার সেভাবে উল্লেখ পাওয়া যাবে না। তবে সাধারণ বিষ প্রয়োগ করা এবং বিষ কন্যার বিষ প্রয়োগ করার মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। কোন ব্যক্তি শরীরে বিষ কন্যা তার বিষ প্রয়োগ করলে এক শরীর থেকে আরেক শরীরে সেটি স্থানান্তর করে। কিন্তু সাধারণ বিষে সেটা হয় না।

পারসিক উপকথায় যে গল্প উল্লেখ রয়েছে সেখানে বলা হয়েছে যে সুলতানের বেগম জানতেন সুলতানের অনেক বাসনা গ্রীবায় চুম্বন করা। বেগম সেই সুযোগ করে দিতেই সুলতান গ্রীবায় চুম্বন করেছিলেন, আর আগে থেকেই সেখানেই বিষ মাখিয়ে রেখেছিলেন বেগম। ব্যাকুল সুলতানের মনে সন্দেহের বিন্দুমাত্র লেশ ছিলো না। তিনি আনন্দের সাথে লেহন করতেই নিজের মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

* ইতিহাসে কি বিষপুরুষ ও ছিল?

ইতিহাসে এবং নানা গল্পের বই  কিংবা উপকথায় বিষ কন্যাদের উল্লেখ থাকলেও সেভাবে বিষ পুরুষদের উল্লেখ নেই বলে অনেকের অনুমান। কিন্তু যারা বিষ কন্যাদের কাহিনীতে বিশ্বাসী তাদের বিষ পুরুষদের গল্পেও বিশ্বাস রাখতে হবে। কারণ খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতকের সূচনায় পশ্চিম – ভারতে সকলের মুখে মুখে রচিত ছিল এই গল্প। বিশেষ করে পশ্চিমী ভ্রমণকারীদের কলমেও তার উপাখ্যানের কথা শোনা যায়। আর সেই বিষ পুরুষের নাম ছিল গুজরাতের সুলতান মাহমুদ শাহ। 

কথিত আছে, মাহমুদের বাবা পুত্রকে ছোটবেলা থেকেই বিষ খাইয়ে মজবুত করে তুলেছিলেন। মতলব ছিল শত্রুরা যেন পুত্রের ওপর কখনও বিষ প্রয়োগ না করতে পারে। তার বিবরণ অনুযায়ী মাহমুদ নিয়মিতভাবে নানা ধরনের বিষ সেবন করতেন। তিনি পান চিবিয়ে যদি কারও গায়ে পিক ছিটাতেন তাহলে তার মৃত্যু অবধারিত ছিল। এমনকি এই সুলতানের অন্দরে তিন – চার হাজার নারী আছে। রাত্রে যে মেয়েটি সুলতানের শয্যাসঙ্গিনী হলো, পরদিন আর তাকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যেত না। বিষধর সুলতানের প্রেমালিঙ্গনে মৃত্যু অবধারিত। মাহমুদ এই দৃশ্য সব সময় নিশ্চয় উপভোগ করতে পারতেন না। তার দেহ বিষপূর্ণ হলেও হৃদয়ে হয়তো বিষের ছোঁয়া তখনও লাগেনি। এজন্যেই তিনি নাকি এর একটা প্রতিকারও খুঁজে বের করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে থাকত একটি আংটি। নায়িকা সেটি মুখে পুরে সুলতানকে স্পর্শ করলে কোন ক্ষতি হতো না তার। মাহমুদকে আনন্দ দানের পরেও যে রূপসীরা বেঁচে ছিল তারা নাকি ওই আংটির মায়াবলেই। গুজরাতের সুলতান মাহমুদ শাহ ছাড়াও আরও একজন বিষ পুরুষ ছিলেন নাদির শাহ। তার নিঃশ্বাসেও নাকি ছিল বিষ। দু’টি তরুণী সৌখিন নাদিরের দাঁত পরিষ্কার করছিল। সুলতানের তপ্ত নিঃশ্বাস স্পর্শে একজনের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছিলো। অন্যজন কোনমতে প্রাণে বেঁচেছিল। তবে এইসব কাহিনী অষ্টাদশ শতকের পরে ক্রমশ আবছা হতে শুরু করেছিল।

একাধিক তথ্য নির্ভর লেখা। দ্বিমত থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *