বহু শিখকে নির্মমভাবেহত্যা করেছিল যে মুঘল শাসক
ইতিহাসে এমন কিছু যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল যার গৌরব গাথা যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান। এইসব যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া বীররা চিরকালের জন্য অমর হয়ে গেছে। ঠিক এমনই এক যুদ্ধ হচ্ছে ছাপ্পার ছিরির যুদ্ধ,যেখানে বান্দা সিং বাহাদুরের নেতৃত্বে শিখরা মুঘলদের পরাজিত করেছিল। ওয়াজির খান বনাম বান্দা সিং বাহাদুরের এই যুদ্ধে সাময়িক ভাবে মুঘলদের সরিয়ে শিখ শাসন শুরু হয়েছিল। তবে এরপরে বান্দা সিং বাহাদুর সহ বহু শিখকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল মুঘল শাসক ফারুকশিয়র।
বান্দা সিং বাহাদুরের জন্ম হয়েছিল ১৬৭০ সালের ২৭ অক্টোবর জম্মু কাশ্মীরের পুন্চ জেলার রাজৌরী গ্রামে। রাজৌরীর এক হিন্দু পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। ওনার বাবার নাম রাম দেব এবং তিনি একজন কৃষক ছিলেন। কিছু তথ্যমতে তার বাবা ভরদ্বাজ গোত্রের ছিলেন এবং তারা রাজপুত ছিলেন। প্রথম জীবনে তার নাম ছিল লছমন দেব। রাজপুত পরিবারে জন্ম হওয়ায় ছোট বেলা থেকেই ঘোড়ায় চড়া, তীর ধনুক চালানো ও অস্ত্র শিক্ষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি শিকারও করতেন ছোটবেলায়। পনেরো বছর বয়সে একদিন তিনি একটি মহিলা হরিনের শিকার করেন কিন্তু তিনি দেখেন হরিনটির পেটের মধ্যে দুটি সদ্যোজাত বাচ্চা হরিন তাঁর চোখের সামনেই যন্ত্রনায় মারা যায়। এই ঘটনা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তিনি সংসার ত্যাগ করে সাধু হবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঘর ছেড়ে বিভিন্ন সাধু সন্তদের অনুসরন করতে শুরু করেন। প্রথমে তিনি লাহোরের কাছে সাধু রাম দাসকে অনুসরন করা শুরু করেন। কিছুদিন পরে তিনি সাধু জানকী দাকে অনুসরন করেন। তখন তার নাম হয় মাধো দাস। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি নাসিকের কাছে পঞ্চবটিতে এসে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি সাক্ষাৎ পান সাধু অঘোর নাথের। পাঁচ বছর পঞ্চবটিতে অঘোর নাথের সেবা করেন তিনি। বলা হয় তার সেবায় খুশী হয়ে অঘোর নাথজী তাকে বেশ কিছু দৈব শক্তি প্রদান করেছিল। ১৬৯১ সালে মারা যান অঘোর নাথ। এরপর একুশ বছর বয়সী মাধো দাস নান্দের চলে আসে এবং সেখানেই নিজের আশ্রম তৈরি করেন। সেখানেই পরবর্তী ষোলো বছর ধরে বসবাস করেন তিনি এবং একটি বিশাল আশ্রম তৈরি করেন। ১৭০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিখ ধর্মগুরু গুরু গেবিন্দ সিং তাঁর কিছু অনুগামী সহ মাধো দাসের আশ্রমে পৌঁছান। বলা হয় মাধো দাসের তার শক্তির অহঙ্কার হয়ে গিয়েছিল কিন্তু যখন তিনি গুরু গোবিন্দ সিং জীর সংস্পর্শে আসেন তখন তার কোন শক্তিই কাজ করছিলো না যার কারনে তিনি গুরু গোবিন্দ সিংকে নতজানু হয়ে প্রনাম করে তার শিষ্যত্ব গ্রহন করেন এবং তখন তার নাম হয় বান্দা সিং বাহাদুর। তাঁকে শিখ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ভার দেয় গুরু গোবিন্দ সিংজী। সেই বছরই গুরু গোবিন্দ সিং বান্দা সিং বাহাদুরকে নির্দেশ দেন পাঞ্জাব যেতে এবং সেখানে নিষ্ঠুর, অত্যাচারী রাজাদের শাস্তি দিয়ে সাধারন মানুষকে রক্ষা করার আদেশ দেন। শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিং তার জীবনে ২৫ বছর ধরে ষোলোটি যুদ্ধ করেছিলেন সাধারন মানুষকে রক্ষা করবার জন্য। এর জন্য গুরু গোবিন্দ সিংজীর দুই পুত্র সহ অনেক অনুগামী নিজেদের জীবন বলিদান দিয়েছিল।
শরহিন্দের নবাব ওয়াজির খান গুরু গোবিন্দ সিংজীর দুই পুত্রকে হত্যা করেছিল। ওয়াজির খান সবসময় ভয়ে থাকত শিখদের থেকে কারন সে জনত শিখরা তাকে ছাড়বেনা। সেকারনে সে তার দুই পাঠান গুপ্তচর পাঠিয়েছিল নান্দেরে গুরু গোবিন্দ সিংজী কে হত্যা করতে, কারন ওয়াজির খানের ধারনা ছিল গুরু গোবিন্দ সিং মারা গেলে শিখেদের কোন নেতা থাকবেনা। সেই দুই পাঠানের মধ্যে একজন গুরু গোবিন্দ সিংকে ছুরিকাঘাত করেছিল কিন্তু গুরু গোবিন্দ সিং কোনওরকমে বেঁচে যান। কিন্তু এই ঘটনার দেড় মাস পরে গুরু গোবিন্দ সিং মারা যান সেই ছুরির আঘাতে প্রাপ্ত ক্ষত থেকে। কিন্তু তিনি মারা যাবার আগে খালসা তৈরি করে যান এবং বান্দা সিং বাহাদুরকে তৈরি করে দিয়ে যান পাঞ্জাবকে রক্ষা করার জন্য। পাঞ্জাবে পৌঁছেই বান্দা সিং বাহাদুর পাঞ্জাব, আফগানিস্তান ও কাশ্মীরে সমস্ত শিখদের সংবাদ পাঠায় গুরু গোবিন্দ সিং এর দেহত্যাগের ব্যাপারে এবং শিখদের ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই বান্দা সিং বাহাদুরের সেনায় যোগ দেয় ৪০০০ অশ্বারোহী এবং ৭৮০০ স্থলসেনা। কিছুদিনের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে চল্লিশ হাজার হয়। সেইসময়ের কিছু বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী অর্থ সাহায্য করে বান্দা সিং বাহাদুরকে। সেসময় মুঘলরা যথেষ্ট শক্তিচালী ছিল কারন তাদের উন্নত অস্ত্র, বন্দুক, হাতি সব ছিল, দক্ষ সেনাবল ছিল কিন্তু সেই তুলনায় শিখদের শুধু তরোয়াল ও গুরুর আশীর্বাদ ছিল সাথে। কিন্তু তা সত্বেও বান্দা বাহদুর সিং এর নেতৃত্বে শিখরা মুঘলদের বিরুদ্ধে দশটি যুদ্ধ করে, যার প্রতিটাতেই তারা জয়ী হয়। ১৭০৯ সালে পাঞ্জাবের সাধৌরাতে উসমান খানকে হত্যা করে বান্দা সিং বাহাদুরের সেনা। এই উসমান খান গুরু গোবিন্দ সিং এর প্রিয় পীর বুধু শাহকে হত্যা করেছিল। সামান, শোনিপথ, কেন্থাল, শাবাদ, থাসকা সহ অনেক জায়গায় মুঘলদের পরাজিত করার পর বান্দা সিং বাহাদুর ও তার সেনার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় শিরহিন্দ ও তার নবাব ওয়াজির খান।
ওয়াজির খান গুরু গোবিন্দ সিং এর দুই পুত্রকে হত্যা করেছিল সেজন্যা শিখরা তার বদলা নেবার জন্য প্রস্তত ছিল। তাছাড়া শিরহিন্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন শহর ছিল কারন দিল্লি থেকে লাহোর অবধি পুরো মুঘল বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শহর। সুতরাং এই শহর দখল করে পুরো পাঞ্জাবে আধিপত্য স্থাপনের পাশাপাশি মুঘল অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্থ করা যাবে। কিন্তু ওয়াজির খানের কাছে ২০,০০০ সদস্যের সুসজ্জিত বিশাল সেনা ছিল যাদের আধুনিক অস্ত্র ছিল কিন্ত সেই তুলনায় বান্দা সিং বাহাদুরের সেনার কাছে প্রয়োজনীয় ঘোড়াও ছিলনা। ১৭১০ সালের মে মাসে শিরহিন্দ শহর থেকে ১৫ মাইল দূরে ছাপ্পার ছিরি গ্রামে ওয়াজির খানের সেনা ও বান্দা সিং বাহাদুরের সেনার মধ্যে যুদ্ধ হয়। বান্দা সিং বাহাদুরের প্রায় এগারো হাজার সেনা যুদ্ধ করে যেখানে ওয়াজির খানের নেতৃত্বে কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজারের বিশাল সেনা অংশ নেয় এই যুদ্ধে, তাছাড়া ওয়াজির খান ২৪ টি কামান, একশো যুদ্ধ হাতি নিয়ে এসেছিল কিন্তু তা সত্বেও শেষ রক্ষা হয়নি। বান্দা সিং বাহাদুরের সেনার অসাধারন বীরত্বের সামনে পরাজিত হয় ওয়াজির খানের মুঘল সেনা। ওয়াজির খানকে হত্যা করে ফতেহ সিং। মুঘল সেনা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে শিরহিন্দ শহর শিখদের অধীনে আসে। কিন্তু বিজয়ের পরও বান্দা সিং বাহাদুর আদেশ দেন কোন মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরস্থানকে কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করার।
২০১৬ সালের ১১ নভেম্বর একটি পাঞ্জাবি সিনেমা চার সাহিবজাদে, রাইস অফ বান্দা সিং বাহাদুর মুক্তি পেয়েছিল যাতে এই যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত দেখানো হয়েছিল। ২০১১ সালে এই বিজয়ের সম্মানে ছাপ্পার ছিরি গ্রামে ফতেহ বুর্জ নামে একটি ৩২৮ ফুট লম্বা টাওয়ার নির্মান করা হয়েছে যা এখন পাঞ্জাবে গুরুত্বপূর্ন পর্যটনকেন্দ্র।
বান্দা সিং বাহাদুর এরপর খালসা রাজত্ব তৈরি করে, তাঁর রাজধানী হয় মুখলিশ গড়। বান্দা সিং বাহাদুর তার রাজ্যে গুরু নানকজী ও গুরু গোবিন্দ সিংজীর ছবি দেওয়া মুদ্রাও চালু করেছিলেন। অসাধারন শাসক ও বীর যোদ্ধা ছিলেন বান্দা সিং বাহাদুর। এরপরেও বিভিন্ন জায়গায় অত্যাচারী শাসকদের শাস্তি দেওয়া চালিয়ে যেতে থাকে বান্দা সিং বাহাদুর। তাঁর সাহস ও বীরত্বে ভীত হয়ে পড়ে দিল্লিতে মুঘল শাসক বাহাদুর শাহ। ১৭১২ সালে মৃত্যু হয় বাহাদুর শাহ, এরপর ১৭১৩ সালে মুঘল শাসক হয় ফারুক শিয়র। এরপর মুঘল সেনা বান্দা সিং বাহাদুরের দুর্গ অবরোধ করে। আট মাস অবরোধ থাকার পর বান্দা সিং বাহাদুর ও আটশো শিখকে গ্রেফতার করে মুঘল সেনা ১৭১৫ সালের ডিসেম্বরে। তবে গ্রেফতার হবার আগেও বান্দা সিং বাহাদুর ৫০-৬০ জন মুঘল সেনাকে হত্যা করেছিল। হাজি করম খান তার বই তাযকিরাতু-সুলাতিন চুগতিয়ানে লিখেছে মুঘলরা বান্দা সিং বাহাদুরকে গ্রেফতার করতে পেরেছিল কারন দীর্ঘদিন ধরে ঘেরা বন্দি থাকার ফলে খাদ্য কমে আসায় দুর্বলতর হয়ে পড়েছিল শিখ সেনা, সেই সুযোগে গ্রেফতার করা হয় তাদের। অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে শিখদের হত্যা করে ফারুক শিয়র। বান্দা সিং বাহাদুরের সামনে তার চার বছরের ছেলেকে হত্যা করে তার হৃদপিন্ড বার করে বান্দা সিং বাহাদুরের মুখে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়। তার চোখ তুলে নেওয়া হয়, হাত, পা কেটে দেওয়া হয়, চামড়া তুলে নেওয়া হয় এবং অচেতন অবস্থায় থাকার সময় ১৭১৬ সালের ৯ জুন বান্দা সিং বাহাদুরের মাথা কেটে নেওয়া হয়। এরকম নৃশংস ও নারকীয় অত্যাচার করা হয় বান্দা সিং বাহাদুরের সাথে। তবে অসাধারন বীরত্বের কারনে বান্দা সিং বাহাদুর ভারতের ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।