অফবিট

শয়তানের নামে জীবন্ত প্রাণী বলি। নিজের একাধিক স্বামীর বলি চড়িয়েছেন। কে ছিলেন এই নারী?

বর্তমান যুগে জাদু টোনা কিংবা ডাইনি বিদ্যাকে কুসংস্কার মনে হলেও পূর্বে এই ভয়ংকর বিদ্যার থেকে দূরত্ব বজায় রাখত সাধারন মানুষেরা। তবে বেশ কিছু মানুষের কৌতুহল ছিল এই বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে। আর নিয়েও ফেলতেন এই বিদ্যার শিক্ষা এবং প্রয়োগ করতে সাধারণ মানুষের উপর জাদু টোনা। যেহেতু আগে সমাজ অতটা শিক্ষিত ছিল না তাই জাদু টোনা যারা করতেন তাদের ডাইনি কিংবা রাক্ষসী বলেই আখ্যায়িত করতো উনবিংশ শতাব্দীর মানুষেরা। সেরকমই ১৩ শতকে শেষের দিকে অর্থাৎ ১৪ শতকের প্রারম্ভে এলিস কিটেলার নামের একজন নারী খুবই প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন যাদুবিদ্যা ও কালা জাদুর জন্য। তিনি এই কালা জাদুর মাধ্যমে নিজের তিনজন স্বামীকে হত্যা করায় আয়ারল্যান্ডের ডাইনি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নথিপত্র অনুযায়ী এলিস কিটেলারের তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল সেই তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।

১২৮০ সালে আয়ারল্যান্ডের কিলকেনি শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এলিস কিটেলার। তিনি ওই শহরের সবচেয়ে ধনী এবং প্রভাবশালী নারীদের মধ্যে একজন ছিলেন। যার কারণে তার অহংকার এবং গরিমা এতটাই উঠেছিল যে তার প্রতিবেশীরা তাকে ভালো চোখে দেখতেন না। এমনকি তিনি সারাদিন নিজের বাড়ির মধ্যেই বন্দি থাকতেন বলে প্রতিবেশীরা অনুমান করেছিলেন এলিস যাদুবিদ্যা ও ডাইনি বিদ্যার চর্চা করছে। যদিও সেই অনুমানের সঠিক কোন পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাইনি কেউই।

পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে এলিস বিয়ের যোগ্য হয়ে উঠলে তিনি প্রথম একজন ব্যাংকার উইলিয়াম আউটালাওয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। একজন ব্যাংকারের পাশাপাশি সুদের বিনিময়ে সাধারণ মানুষকে অর্থ সাহায্য করতেন তিনি। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছর পরেই অর্থাৎ ১৩০২ সালে আচমকা রহস্যজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছিল উইলিয়াম আউটালাওয়ের। প্রথম স্বামীর এভাবে মৃত্যুর প্রায় কয়েক বছরের মধ্যেই এলিস দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন আরেকজন ধনী ব্যক্তি অ্যাডাম লে ব্লান্ডকে। কিন্তু সেই স্বামীরও ১৩১১ সালে মৃত্যু হয়েছিল। অর্থাৎ পাঁচ বছরের মধ্যে দুবার বিয়ে করে দুবারই স্বামী হারিয়েছিলেন এলিস।

তবে এলিস যে সমস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে বিবাহ করেছিলেন তাদের প্রত্যেকেরই প্রথমে স্ত্রী বিয়োগ হয়েছিল। প্রথম এবং দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর আরও একজন ধনী ব্যক্তি রিচার্ড নামের একজনের সঙ্গে তৃতীয় বার বিয়ে করেছিলেন তিনি। তবে রহস্যজনকভাবে সেই তিন নম্বর স্বামীটিও মারা গিয়েছিল। কিন্তু এই সকল ব্যক্তিদের প্রথম পক্ষের সন্তানরা একত্রিত হয়ে বিষয়টাকে বেশ গম্ভীরভাবেই নিয়েছিলেন। এরপরেই শুরু করেছিলেন এলিসের উপর নজরদারির কাজ। তবে বিয়ে করার পর্বে থেমে ছিলেন না এলিস। তার সর্বশেষ এবং চতুর্থ স্বামী ছিলেন জন লে পোয়ার। বিয়ে করার পরপরই আগের তিনজন স্বামীর মতোই আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন চতুর্থ স্বামীও। তখন সময় ছিল ১৯২৪ সাল।

যখন এলিসের চতুর্থ স্বামী ও একই রকম ভাবে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু থেকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তার প্রাণ বাঁচাতে জন লে পোয়ারকে সতর্ক করেছিলেন এলিসের মৃত স্বামীদের সন্তানেরা। কিন্তু জন এলিসকে এতটাই অন্ধ বিশ্বাস ও ভালবাসতেন যে কারো সাবধানতা সেরকম গুরুত্ব দিতে না তিনি। কিন্তু একদিন যখন এলিসের দাসী জনকে সতর্ক থাকার কথা জানাতে কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল জনের। এরপরই নিজের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রীর উপর নজরদারি শুরু করেছিলেন স্বয়ং জন।

একদিন হঠাৎই জন তার স্ত্রী এলিসের কাছে তার ঘরের চাবি চেয়ে বসেছিলেন। প্রথমে এলিস সেই চাবি দিতে অস্বীকার করলেও পরে দিয়ে দিয়েছিলেন। চাবি হাতে পেতে জন এলিসের ঘরে ঢুকে যা দেখেছিলেন তাতে তার চোখ্যু চরক গাছ হয়ে উঠেছিল। কারণ জন এলিসের ঘরে ঢুকেই দেখেছিলেন ঘর ভর্তি নানা রকমের বাক্স। এরপরই বাক্সগুলো খুলে দেখেছিলেন তাতে তার স্ত্রীর সব অপকর্মের প্রমাণ রয়েছে, এমনকি প্রতিদিন জনকে অল্প অল্প করে বিষ প্রয়োগ করছে তার স্ত্রী সেটিও বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। পাশাপাশি নিজের ভালোবাসার মানুষ এলিস গভীরভাবে জাদুবিদ্যা ও ডাকিনী বিদ্যার সঙ্গে জড়িত তার তথ্য প্রমাণ পেয়েছিলেন জন। এছাড়াও বাক্স গুলো ভরপুর ছিল নানা রকম সব অদ্ভুত গুঁড়ো শিশি ওষুধ এবং শয়তানের নাম খোদাই করা পাউডার দিয়ে।

পরবর্তীতে জন এই সমস্ত বাক্স এবং তাদের বন্দি সব কালা জাদুর যন্ত্র দেখে বুঝতে পেরেছিলেন তার স্ত্রী ডাকিনী বিদ্যার চর্চিত। তাই তিনি সব বাক্স অতি সন্তর্পনে দুজন ব্যক্তির সাহায্যে চার্চের বিশপের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরই চার্চের বিশপ একজন তুখোর তদন্তকারী রিচার্ড ডি লেড্রেডকে এলিসের সম্পর্কে তদন্ত করে আনতে বলেছিলেন এবং সেই তদন্তে উঠে এসেছিল কাইটেলারের যাদুবিদ্যা ও বিষ প্রয়োগের প্রমাণ।

সকল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এলিজ দোষী সাব্যস্ত হলে তার সকল সম্পত্তি এবং বাড়ি বাজেয়াপ্ত তো করে নিয়েছিল গির্জার প্রধান সারির ব্যক্তিরা। এরপরই এলিস সহ তার ছেলে উইলিয়াম আউটলাওয়ে ও তার ব্যক্তিগত দাসী পেট্রনিলা ডি মিথ ও‌ ১১ জন দাসীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিল বিশপ।

এখানে বলে রাখা ভালো এলিসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং প্রধান শিষ্য ছিলেন তার নিজের ছেলে উইলিয়াম আউটলাওয়ে। শুধুমাত্র মাকে সমর্থন করা নয় এই যাদুবিদ্যার অন্যতম শীর্ষ ছিলেন উইলিয়াম। এই ছেলের প্রতি এলিসের বেশি ভালোবাসা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আয়ারল্যান্ডের সন্ধ্যে নামতেই সকলে যখন নিজের বাড়িতে ঢুকে যেত তখন একটি ঝাঁটা নিয়ে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা সমস্ত ধুলো নিজের ছেলের বাড়ির দিকে চালান করতেন এলিস, এবং মনে মনে বলতেন আমার ছেলের জীবনে এই ভাবেই হেঁটে আসুক ধন-সম্পত্তি ও প্রতিপত্তি।

এলিসের বিরুদ্ধে করা তদন্তে যে প্রমাণ উঠে এসেছিল তাতে ভিত্তি করে এলিসকে সাতটি অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এমনকি তাদের শাস্তি ঘোষণা করার পরেও প্রমাণ পেয়েছিলেন যে এলিস তার সঙ্গে কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে ডাকিনী বিদ্যা করতেন। এই বিদ্যার ফলে এলিস ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে তাচ্ছিল্য করতেন এবং ভয়ংকর কিছু আচার পালন করতেন বলে অভিযোগ বিশপের। সেই আচারের মধ্যে পড়তো জীবন্ত প্রাণীকে শয়তানের নামে উৎসর্গ করে বলি দেওয়া, এবং সেই প্রাণীর অঙ্গ শহরের রাস্তাতে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা সহ যে সকল অপরাধীদের ফাঁসিতে মৃত্যু হতো সেই মৃত ব্যক্তিদের চুল ,আঙ্গুলের নখ ,পশুর অন্ত্র, কৃমি, বিষাক্ত ভেষজ এবং মারা যাওয়া শিশুদের মাংস সহ বিভিন্ন উপাদান ও তন্ত্র মন্ত্র করে এক ধরনের গলুই তৈরি করতো তারা। আর এই সমস্ত ডাইনি বিদ্যার জিনিসগুলো রাখতো যে সকল ডাকাতের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে তাদের খুলিতে। শুধুমাত্র সংগ্রহ করে রাখাই নয় সেই খুলিতে রীতিমতো একত্রিত হয়ে ফুটতো এই মিশ্রণ গুলি।

শুধুমাত্র বিশপদের প্রমাণ করা তথ্যের ভিত্তিতে নয় রীতিমতো এলিসের একজন অতি কাছের দাসী নিজের জবানবন্দিতে জানিয়েছিলেন যে,” এলিস বিড়ালের আকৃতির এক বৃহৎ জন্তুর সঙ্গে যৌন মিলন করতেন মাঝে মধ্যে, কারণ তিনি মনে করতে এই মিলনের মাধ্যমে খুশি হবে শয়তান”।

অন্যদিকে বিশপের তরফ থেকে যে তথ্য প্রকাশ্যে এসেছিল সেখানে এলিস একজন ডাইনি বলে পরিচিত না হলেও তার ওষুধের মাধ্যমে তিনজন স্বামীর মৃত্যু এবং একজন স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এটা প্রমাণিত হয়েছিল। এক কথায় বলতে গেলে এলিস এই সকল ডাইনি বিদ্যা শিখে একটা জিনিসই পাওয়ার চেষ্টা করছিল যে তার ছেলে যাতে সকলের থেকে অধিক ধনী হয়। কারণ এলিস নিজেই ছিলেন অর্থ লোভী একজন মহিলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *