প্রথম থেকেই কী ৫০ টি রাজ্য ছিল! আমেরিকার কিভাবে এতো শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠল?
রাজেশ রায়:— জানেনকী আমেরিকার জাতীয় পতাকায় থাকা ৫০ টি তারা এবং ১৩ টি লাল সাদা অনুভূমিক সরলরেখার অর্থ? আমেরিকার জাতীয় পতাকায় থাকা ৫০ টি তারা আমেরিকার ৫০ টি রাজ্যকে নির্দেশ করছে এবং ১৩ টি লাল সাদা সরলরেখা আমেরিকার আসল ১৩ টি কলনীকে নির্দেশ করছে। কিন্তু প্রথম থেকেই কী আমেরিকার ৫০ টি রাজ্য ছিল? কী করে আমেরিকা সাধারন একটি দেশ থেকে ইউনাইটেড স্টেটস হয়ে উঠল? ব্রিটিশ কলোনী থেকে বিশ্বের প্রথম গনতন্ত্র ও বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার এই যাত্রা সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
১৪৯২ সালে ইটালির ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম আমেরিকা আবিষ্কার করে। তখন থেকেই আমেরিকায় শুরু হয় ইউরোপীয়ানদের উপনিবেশ বিস্তার। মূলত চারটি ইউরোপীয়ান দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগাল আমেরিকায় তাদের উপনিবেশ বিস্তার করে। ১৫৬৫ সালে প্রথমে স্পেন উত্তর আমেরিকার সেন্ট অগস্টিন যার বর্তমান নাম ফ্লোরিডা এবং নিউ মেক্সিকোয় নিজেদের উপনিবেশ বিস্তার করে। সেন্ট অগস্টিনকে আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন শহরও বলা হয়। এরপর মিসিসিপি নদীর তীরে নিউ ওরলিয়ানস ও অন্যান্য জায়গায় ফ্রান্স তাদের উপনিবেশ বিস্তার করতে থাকে। এরপর উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূল জুড়ে ব্রিটিশরা তাদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ১৬০৭ সালে জেমস টাউনের ভার্জিনিয়া এবং ১৬২০ সালে প্লাইমাউথের সেন্ট পিলগ্রিমসে ব্রিটিশ কলোনী তৈরি হয়। ১৭৮৪ রাশিয়ানরা প্রথম আলাস্কায় নিজেদের স্থায়ী বেস তৈরি করে। ১৭৫০-৬০ সালের দিকে দারিদ্র্যতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ধর্মীয় কারনে বড় সংখ্যায় ইউরোপীয়ানরা আমেরিকায় এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। এর মূল্য চোকাতে হয় আমেরিকায় হাজার হাজর বছর ধরে বসবাস করা আমেরিকার উপজাতিদের। ১৭৬০ এর মধ্যে অ্যাপলেশিয়ান পর্বতের পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে ব্রিটিশরা তাদের ১৩ টি কলোনী তৈরি করে। এই এলাকায় প্রায় ২.৫ মিলিয়ন আমেরিকান উপজাতি সম্প্রদায় থাকত। আমেরিকার বিখ্যাত নিউইয়র্ক, পেনসিলভেনিয়া, উত্তর ও দক্ষিন ক্যারোলিনা, নিউ জার্সি, ভার্জিনিয়ার মতন বিখ্যাত শহর গুলো ব্রিটিশরাই তাদের ১৩ কলোনীতে তৈরি করে, যা পরে ইউনাইটেড স্টেটসের রূপ নেয়।
অন্যদিকে অ্যাপেলেশিয়ান পর্বতের নীচে তখন একটি ফ্রান্সের উপনিবেশ তৈরি হয়ে গেছে। উত্তর আমেরিকা মূলত মাছের জন্য আদর্শ ছিল অন্যদিকে দক্ষিন আমেরিকার আবহওয়া তামাক, কফি ও ধান চাষের জন্য অনুকূল ছিল। এরজন্য ইউরোপীয়ান সংস্থাগুলো জোর করে আফ্রিকা থেকে লোকেদের এনে এখানে কাজ করাত এবং স্থানীয় আমেরিকান অধিবাসীদের বা রেড ইন্ডিয়ানদের জোর করে অন্যত্র বসতি স্থাপনে পাঠাত, অনেক সময় তো এদের হত্যাও করা হত। স্মল পক্স ও অন্যান্য রোগের কারনে স্থানীয় আমেরিকানদের জনসংখ্যা কমতে শুরু করে। আমেরিকাতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হয় যাকে সেভেন ইয়ারস ওয়ার বা সাত বছরের যুদ্ধ বলা হয়। মোটামুটি আমেরিকার সব প্রান্তেই এই যুদ্ধ হয়। এতে ব্রিটিশদের কাছে ফ্রান্সের শোচনীয় পরাজয় হয়। এর ফলে উত্তর আমেরিকাতে ফ্রান্সের কলোনী যাকে নিউ ফ্রান্স বলা হত তা ব্রিটেনের অধিকারে চলে আসে এবং এখানে ফ্রান্সের আধিপত্য শেষ হয়ে যায় মোটামুটি। উত্তর আমেরিকাতে এরপর দুটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি থাকে ব্রিটেন ও স্পেন। ব্রিটেন এই যুদ্ধে জয়লাভ তো করেছিল কিন্তু তাদের জন্য এই যুদ্ধ অনেক সমস্যার ছিল। এই যুদ্ধের ফলে ব্রিটেনের ঋন অনেক বেড়ে যায়। ব্রিটেন তখন ঠিক করে এসব ঋন তারা স্থানীয় আমেরিকান উপজাতিদের থেকেই আদায় করবে।
ব্রিটেন স্থানীয় মানুষের উপর বিভিন্ন ধরনের কর চাপায় কিন্তু তা দিতে অস্বীকার করে স্থানীয় মানুষ। এছাড়া কিছু আমেরিকান উপজাতি এই যুদ্ধে ব্রিটেনের হয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে লড়াই করোছিল। বদলে ব্রিটেন তাদের অ্যাপেলেশিয়ান পর্বতের পাশে বসবাস করবার জন্য জমি দিতে স্বীকৃত হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর ব্রিটেন তার কথা রাখেনি। ফলে স্থানীয় মানুষদের মনে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমতে শুরু করে। যার জন্য সমস্ত আমেরিকান উপজাতি এক হয়ে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে। এভাবেই আমেরিকায় স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্ম হয়। এই বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ সংসদ একটি আইন পাশ করায় যার নাম টী অ্যাক্ট। এই আইন অনুযায়ী আমেরিকানদের উপর থেকে সমস্ত কর তুলে নেওয়া হয় কিন্তু চা ব্যাবসার উপর কর রাখা হয়, এতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সবচেয়ে বেশী লাভ হয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা এটাও মানতে রাজি ছিলনা।
১৭৭৩ সালে একদল বিক্ষোভকারী বোস্টন শহরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে গিয়ে অনেক চা এর বাক্স সমুদ্রে ফলে দেয়। ইতিহাসে এই ঘটনা বোস্টন টি পার্টি নামে পরিচিত। এতে তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশদের ১০,০০০ পাউন্ডের ক্ষতি হয়েছিল। তাহলে বুঝতেই পারছেন তখনকার হিসাবে এটা কতটা ক্ষতি ছিল এবং ব্রিটিশরা এর ফলে কী করেছিল! ১৭৭৪ সালে ব্রিটিশ সংসদে ইনটলারেবল অ্যাক্ট পাশ করানো হয় এবং সমস্ত বানিজ্য বন্ধ করে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া হয়। এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। বিক্ষোভকারীরা অস্ত্র সংগ্রহ করতে শুরু করে কারন সবাই বুঝতে পেরেছিল যুদ্ধ এবার সময়ের অপেক্ষা। ১৭৭৪ সালে আমেরিকার ১২ টি কলোনীর প্রতিনিধিরা ফিলাডেলফিয়ায় বৈঠক করে প্রথম কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস তৈরি করে এবং ব্রিটিশ পন্য বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৭৭৫ সালে আমেরিকার স্বাধীনতাকামীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স বা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষনা করে। জুলাই, ১৭৭৬ সালে দ্বিতীয় কংগ্রেসের বৈঠকে আমেরিকার ১৩ টি কলোনী নিজেদের স্বাধীন হিসাবে ঘোষনা করে ব্রিটিশ সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এদিকে সাত বছরের যুদ্ধে হারের বদলা নিতে ফ্রান্সও আমেরিকানদের সাহায্য করতে শুরু করে এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। অন্যদিকে স্পেন এবং নেদারল্যান্ডসও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। সেসময় আমেরিকান সেনাকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল জর্জ ওয়াশিংটন। ১৭৮১ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ জেনারেল কর্নওয়ালিশ ইয়র্কটাউনে আত্মসমর্পন করে এবং এভাবে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়। ১৭৮৩ সালের প্যারিস চুক্তিতে ব্রিটিশরা স্বাধীন আমেরিকাকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। মিসিসিপি নদী পর্যন্ত আমেরিকার সম্পূর্ণ অংশ আমেরিকানদের দখলে আসে কিন্তু ফ্লোরিডা শহ তখনও পর্যন্ত স্পেনের অধীনে ছিল। ১৭৮৭ সালে আমেরিকার সংবিধান তৈরি হয়। পোটোম্যাক নদীর তীরে অবস্থিত ওয়াশিংটন শহরকে আমেরিকার রাজধানী ঘোষনা করা হয়। জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৩ টি আমেরিকান কলোনীকে নিজেদের সংবিধান ও গভর্নর দেওয়া হয়। অন্যদিকে পশ্চিমে নতুন রাজ্য গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার পর আমেরিকা বলতে ছিল উত্তর আমেরিকার পূর্ব প্রান্তে ১৩ টি ব্রিটিশ কলোনী নিয়ে গঠিত দেশ। কিন্তু ধীরে ধীরে আমেরিকার বিস্তার শুরু হয়। ১৮০৩ সালে থমাস জেফারসন ফ্রান্স থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে লুসিয়ানাকে কিনে নেয়। ১৮০০ সালে ফ্রান্স স্পেন থেকে কিংডম অফ আট্রুরিয়ার বদলে লুসিয়ানা নিজেদের অধিকারে আনে। মেক্সিকো উপসাগরের তীরে আমেরিকার দক্ষিন পশ্চিমে একটি প্রদেশ এই লুসিয়ানা। আসলে ব্রিটেনের কাছে লুসিয়ানায় পরাজিত হবার ভয়ে ফ্রান্স তাড়াতাড়ি এই প্রদেশ বিক্রি করে দেয়। লুসিয়ানা কেনার পর আমেরিকার আয়তন প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়। এই লুসিয়ানা প্রদেশ মিসিসিপি নদী থেকে রকি পর্বত এবং মেক্সিকো উপসাগর থেকে কানাডা সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। মেক্সিকোতে টেক্সাস নিজের স্বাধীনতা ঘোষনা করে। ১৮৩৫ সালে যুদ্ধের পর টেক্সাস স্বাধীন হয় কিন্তু ১৮৪৫ সালে আমেরিকা টেক্সাস অধিকার করে নেয়। আমেরিকা ও মেক্সিকোর সীমান্ত পাশাপাশি হওয়ায় ১৮৪৬ সালে সীমান্ত নিয়ে দুইদেশের যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৮৪৮ সালে আমেরিকা জয়লাভ করে। যুদ্ধের পর গোডালপে হিডালগো অনুযায়ী মেক্সিকো তার ৫০ শতাংশ জমি আমেরিকাকে দিয়ে দেয়।
আমেরিকার আজকের ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, কলোরাডো, নেভাডা, অ্যারিজোনা, মেক্সিকো, ইউটা প্রদেশ এককালে মেক্সিকোর ছিল। ১৮৪৬ সালে আমেরিকা ব্রিটেন থেকে অরিগানোকেও নিজের মধ্যে যুক্ত করে। ক্যালিফোর্নিয়া ও নেভাদা অঞ্চল আমেরিকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারন ১৮৪৮ সালে জেমস মার্শাল এখানে সোনার খনি আবিষ্কার করেছিল যা আমেরিকার অর্থনীতিকে পুরো পাল্টে দেয়। আমেরিকার উত্তরাংশ মূলত শিল্পাঞ্চল ছিল এবং দক্ষিনাংশের মানুষ এসব জায়গায় কাজ করত। যার জন্য উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকার মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। ১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হবার পর এই দূরত্ব কমতে থাকে এবং দক্ষিনাঞ্চলের মানুষ মূল আমেরিকার সাথে মিশে যায়। তবে এর আগে আমেরিকার উত্তরাংশ এবং দক্ষিনাংশের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং ১৮৬৫ সালে উত্তরাংশ জিতে যায় তারপর আমেরিকা এক হয়ে যায়।
১৮৬৬ সালে ব্রিটেনের ভয়ে রাশিয়া আলাস্কা আমেরিকাকে বিক্রি করে দেয়। যে আলাস্কাকে কেনা আমেরিকার ভুল বলা হচ্ছিল, পরে দেখা যায় আলাস্কাতে তেল, গ্যাস, সোনা, মাছের ভান্ডার রয়েছে। ২০১৫-১৯ এর মধ্যে আলাস্কা আমেরিকার পঞ্চম বৃহত্তম তেলের উৎস ছিল। এতদিন পর্যন্ত ইউরোপীন দেশ গুলো আমেরিকাতে কলোনী তৈরি করছিল কিন্তু আমেরিকাতে শিল্প বিপ্লবের পর অর্থনীতি মজবুত হবার পর আমেরিকা বিশ্বে তার প্রভাব বিস্তার শুরু করে। ১৮৯৮ সালে প্রশান্ত মহাসাগরে হাওয়াইকে দখল করে কিউবার দিকে এগোয় আমেরিকা। কিউবাতে তখন স্পেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছিল এবং বিদ্রোহীদের আমেরিকা সাহায্য করছিল কিন্তু হাভানা বন্দরে রহস্যময় ভাবে আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে আমেরিকা ও স্পেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৮৯৮ সালে আমেরিকা ও স্পেনের যুদ্ধের পর পুর্তোরিকো, গুয়াম, কিউবা এবং ফিলিপিন্স আমেরিকার দখলে আসে। পরে ফিলিপিন্স এবং কিউবাকে স্বাধীনতা দেয় আমেরিকা এবং এই ভাবে গঠিত হয় আজকের সুপার পাওয়ার ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা। আজও আমেরিকাকে হারানোর ক্ষমতা বিশ্বের কোন দেশের নেই।